ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

বন্যার ভয়ঙ্কর রূপ দেখল উপকূল 

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪৯, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪   আপডেট: ১৬:০৩, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
বন্যার ভয়ঙ্কর রূপ দেখল উপকূল 

ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, উচ্চ জোয়ারের প্রভাব, নদী ভাঙন আর লবণাক্ততার মতো সংকটগুলো উপকূলের মানুষের কাছে গা সওয়া। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে বন্যার সাথে বসবাসের অভিজ্ঞতা তাদের নেই। যে উপকূল বন্যার পানি সরে যাওয়ার পথ; সেই উপকূলই এবার বন্যায় আক্রান্ত। উজান থেকে আসা ঢল এবং অতি ভারী বৃষ্টির পানি কোথাও কোথাও আটকে গিয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। অন্যান্য বছর বর্ষায় উপকূল ডুবে উচ্চ জোয়ারের পানিতে। কিন্তু এবার এর সঙ্গে যোগ হয়েছে উজানের ঢল। দুই-এ মিলে এবারের বন্যার ভয়ঙ্কর রূপ দেখল উপকূল। বয়সী ব্যক্তিরা বলেছেন, ‘উপকূলের এমন বন্যা এর আগে দেখিনি। বন্যা আমাদের অনেক ক্ষতি করে গেল। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অনেক সময় লাগবে।’ বন্যার্ত মানুষ এখনো চিন্তিত— কবে নাগাদ বন্যার পানি সরে যাবে, কবেই বা তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন।  

কোথাও কোমর পানি, কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও মিলছে না ঠাঁই। উপকূলের কোথাও বেড়িবাঁধ ভেঙে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, আবার কোথাও বেড়িবাঁধে পানি আটকে বন্যা হয়েছে। যে বেড়িবাঁধ উপকূলের জোয়ারের পানি আটকানোর জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল, সেই বাঁধে আটকে গেল উজানের পানি। কারো বসতি ঘর বিধ্বস্ত, কারো শেষ সম্পদটুকুই গেছে ভেসে। যে বাড়ির উঠোনে কখনো বন্যার পানি ওঠেনি, তার ঘরের দোতলা অবধি এবার বন্যার পানি। উপকূলের দিকে চোখ ফেরালে এখন এ দৃশ্যগুলোই ভেসে ওঠে। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের উপকূলজুড়ে বন্যায় বিপর্যস্ত লাখ লাখ মানুষ। নিচু এলাকা জোয়ারের পানিতে ভাসছে। সৃষ্টি হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতি। কিছু এলাকায় পানি আটকে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। উপকূলের পূর্ব থেকে পশ্চিম সবখানের মানুষই এখন কমবেশি বন্যায় আক্রান্ত; যেটা খুবই অস্বাভাবিক। 

আরো পড়ুন:

এবারের বন্যা কবলিত ১২টি জেলার মধ্যে ৬টি উপকূলীয় জেলা। এগুলো হচ্ছে খুলনা, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর এবং কক্সবাজার। এ ছাড়াও উচ্চ জোয়ারের চাপে উপকূলীয় আরো অনেকগুলো জেলা-উপজেলা বন্যা কবলিত হয়েছে। খুলনার পাইকগাছা, কয়রা, পটুয়াখালীর কলাপাড়া, ভোলার বিভিন্ন চরাঞ্চল, কক্সবাজারের নিম্নাঞ্চল সহ অন্যান্য অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সরকারি হিসাবে বন্যায় ৫৮ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত বলা হলেও বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা অনেক বেশি বলে বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে। কেননা, উপকূলের বন্যা কবলিত অনেক এলাকার হিসাব এই তালিকায় নেই। বন্যা পরিস্থিতির মধ্যে থাকলেও উপকূলের অনেক এলাকা বন্যা কবলিত এলাকার তালিকার বাইরে। নোয়াখালী জেলায় ২১ লাখ এবং লক্ষ্মীপুর জেলায় এখনো ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছে বলে সূত্রগুলো বলছে। উপকূলের বেড়িবাঁধের বাইরে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ বসবাস করে; যারা বর্ষাকালে চরম সংকটের মুখোমুখি। অনেকে এই সময়ের জন্য সাময়িকভাবে বসতি স্থানান্তর করে। 

বন্যা কবলিত মানুষ আশ্রয় ও খাদ্যের জন্য ছুটছেন এখানে-সেখানে। উঁচু বাড়ির ছাদ, সরকারি ভবন, উঁচু ভিটে কিংবা রাস্তাঘাট-বেড়িবাঁধ এখন অনেকের আশ্রয়স্থল। দিন যতই গড়াচ্ছে সংকট ততই বাড়ছে। প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের কাছে সাহায্য যাচ্ছে না। বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট অনেক স্থানে। বহু মানুষের ঘরে রান্না হচ্ছে না। শুকনো খাবার সংগ্রহও তাদের পক্ষে কঠিন হচ্ছে। এবারের বন্যায় উপকূলের একটি বড় অংশ বন্যা কবলিত হলেও বহু মানুষের কাছে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছেনি। দেশব্যাপী ত্রাণ বিতরণে ব্যাপক সামাজিক উদ্যোগ থাকলেও ত্রাণগুলো প্রত্যন্ত এলাকার বানভাসীদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।  

ঘূর্ণিঝড়ের পর বন্যা 

মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ঘূর্ণিঝড়ের পর বন্যায় ভাসিয়ে নিল খুলনার পাইকগাছা এবং কয়রা উপজেলার বহু মানুষের বাড়িঘর। উচ্চ জোয়ারের চাপে বেড়িবাঁধ ভেঙে পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের গ্রামের পর গ্রাম ডুবেছে পানিতে। মাটির ঘরগুলো পানির তোড়ে ধ্বসে পড়েছে। মাছের খামার, ফসলি মাঠ, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ধানের গোলা সবই ডুবেছে জোয়ারের পানিতে। আমন ধানের এই মৌসুমে কৃষক যখন ধান রোপণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, ঠিক তখনই এলো এই বিপর্যয়। মাত্র তিন মাস আগে মে মাসের শেষ দিকে এই এলাকায় প্রবল ধাক্কা দিয়েছিল ঘূর্ণিঝড় রেমাল। তখনও বেড়িবাঁধ ভেঙে ডুবেছিল গ্রামের পর গ্রাম। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ পথে বসেছিল। বহু পরিবার তখন রাস্তার ওপরে বসবাস করেছে। জীবন জীবিকা, খাদ্য, বিশুদ্ধ খাবার পানি, বসবাসের স্থান, চিকিৎসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে চরম সংকট ছিল। যে মানুষগুলো নিজের বাড়িতে বসবাস করতো, তারা রাস্তার উপরে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করেছে দিনের পর দিন। বিভিন্ন জনের সহায়তা আর ঋণ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। রেমাল ধাক্কার পরে অনেকেই ঘরবাড়ি গুছিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু এবারের বন্যা এলোমেলো করে দিয়ে গেছে। ভাঙা বেড়িবাঁধ সংস্কার করা সম্ভব হলেও দেলুটির বিভিন্ন এলাকা এখনো পানির তলায়। ফলে বহু পরিবার আশ্রয় নিয়েছে রাস্তার উপরে, অন্যের বাড়িতে অথবা স্কুল ভবনে।

‘তিন মাসের ব্যবধানে একবার ঘূর্ণিঝড়ের ধাক্কা এবং বন্যার প্রবল চাপে আমরা সব হারিয়েছি। সারাজীবনে গচ্ছিত সম্পদ শেষ হয়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের পর ঋণ নিয়ে ঘরবাড়ি ঠিক করেছিলাম। সেইঘর ছেড়ে আবার রাস্তায় উঠে আসতে হয়েছে। আমরা এখন কোথায় যাবো? কীভাবে আবার নতুনভাবে শুরু করব?’ দেলুটির অনিমেশ কান্তি রায়, রাশিদা বেগম, তাহরিন বেগম, শহর আলী গাজীসহ আরো অনেকে এমন কথাই বলছিলেন। চারিদিকে লবণ পানির চিংড়ি ঘের করা হলেও খুলনার পাইকগাছার দেলুটি এলাকাটি যুগ যুগ ধরে লবণ পানি মুক্ত ছিল। এলাকার মানুষ বিভিন্ন ধরনের ফসল আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। প্রচুর পরিমাণে ধান হতো এ এলাকায়। সাম্প্রতিককালে তরমুজ আবাদ করে এ এলাকার বহু মানুষ লাভবান হয়েছেন। কিন্তু পরপর দুটো প্রাকৃতিক বিপদ তাদের নতুন করে সংকটে ফেলেছে।

খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা এবারের বন্যায় প্লাবিত হয়েছিল। জোয়ারে আসা পানিতে তলিয়ে যায় বাড়িঘর।  এখনো অনেক স্থানে বাড়িঘরে পানি রয়েছে। জোয়ারের সময় তাদের সংকট বাড়ে। কয়রার মহেশ্বরীপুর, উত্তর বেদকাশী, বাগালী, মহারাজপুর, দক্ষিণ বেদকাশী, এবং কয়রা সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় বাসিন্দাদের চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। বেড়িবাঁধের নাজুক অবস্থা এই অঞ্চলের মানুষকে বিপন্নতার মুখে ফেলছে। ক্ষতিগ্রস্ত হেমায়েত উদ্দিন, আলী হোসেন, ফারজানা বেগমসহ আরো অনেকে বলছিলেন, ‘আমরা প্রায় সারাবছর প্রাকৃতিক বিপদগুলোর সাথে লড়াই করে টিকে থাকি। কিন্তু কীভাবে লড়াই করছি, কীভাবে টিকে আছি, সে খোঁজ কেউ নেয় না। মারাত্মক সংকটের সময় সামান্য কিছু সহায়তা আমরা পাই; কিন্তু পুনর্গঠনে আমাদের খোঁজ কেউ নেয় না।’ সকলের দাবি, ‘একমাত্র শক্ত এবং টেকসই বেড়িবাঁধই আমাদের বাঁচাতে পারে।’ 

ভাসালো উজানের ঢল 

এবারের বন্যায় উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। এই দুই জেলার বহু মানুষ এখনো পানিবন্দি। বন্যার পানি সরছে; কিন্তু খুব ধীর গতিতে। এই দুই জেলা বন্যার পানিতে সপ্তাহেরও বেশি সময় ডুবে থাকা অনেকটা অস্বাভাবিক ঘটনা। স্থানীয় বাসিন্দারাও বিষয়টি মেনে নিতে পারছে না। যে পথ দিয়ে উজানের ঢল সমুদ্রের দিকে নেমে যাবে; সেই পথ বন্ধ থাকায় এই জেলা দু’টি মারাত্মক বন্যার মুখোমুখি হয়েছে। নদী-নালা-খালবিল ভরা হয়ে গেলে অবস্থা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে; তা এবার লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর মানুষদের দেখিয়ে দিয়ে গেল বন্যা। বন্যায় সবচেয়ে বেশি মানবিক বিপর্যয়ের শিকার ফেনীর পানি কমতে শুরু করলেও লক্ষ্মীপুরে অনেক স্থানে বন্যার পানি বাড়ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। ভারী বৃষ্টিপাত বন্যা পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে দিচ্ছে। বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছে আতঙ্ক। শুধু গ্রামাঞ্চল নয়, লক্ষ্মীপুর শহর অবধি ডুবেছে বন্যার পানিতে। লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা নাছিমা বেগম বলেন, ‘লক্ষ্মীপুরে আমরা এমন অবস্থা এর আগে কখনো দেখিনি। ঘরে পানি ঢুকে গেছে। বেশ কয়েকদিন ধরে আমরা চরম দুর্ভোগে আছি।’ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র বলছে, যে পরিমাণ পানি চাপ, সে হিসেবে পানি রেগুলেটর দিয়ে বের হতে পারছে না। অন্যদিকে বৃষ্টির কারণে পানির উচ্চতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর চারিদিকে চোখ ফেরালে এখন শুধু থইথই পানি। বাড়িঘর, পুকুরঘাট, রাস্তাঘাট, নলকূপ, শৌচাগার সবকিছু তলিয়ে আছে পানিতে। আমন মৌসুমে কৃষকেরা যে আমন আবাদের জন্য ব্যস্ত ছিল, সেই আমন ক্ষেত ডুবে আছে বন্যার পানিতে। স্কুল, কলেজে পানি ঢুকে আছে। পানি প্রবেশ করায় অনেক মসজিদে এখন আর নামাজ হয় না। দুর্গত এলাকার বাসিন্দারা পানিবাহিত রোগসহ নানা জটিল রোগের শঙ্কায় রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে বৃদ্ধ এবং শিশুরা। সুপেয় পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। বন্যার পানির সঙ্গে শৌচাগার একাকার হয়ে আছে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেও বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে বন্যা কবলিত এলাকার মানুষেরা। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বন্যা কবলিত পৌর এলাকা, লাহারকান্দি, মান্দারী, দিঘলী, দত্তপাড়া, বাঙ্গাখাঁ, পার্বতীনগর, কুশাখালী, তেওয়ারীগঞ্জ, ভবানীগঞ্জের মিয়ার বেড়ি এবং কমলনগর উপজেলার চরকাদিরার একাংশ, রামগতি উপজেলার চর বাদাম, চর পোড়াগাছা ইউনিয়নে গিয়ে মানবিক বিপর্যয় লক্ষ্য করা গেছে।

উজান থেকে আসা ঢল এবং টানা বৃষ্টিতে নোয়াখালীতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এখনো জেলার আটটি উপজেলার ৮৭টি ইউনিয়নের ২১ লাখ ২৫ হাজার ৫শ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছে। ১৩০৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে দুই লাখ ৬৪ হাজার ৭৪৩ জন মানুষ আশ্রিত রয়েছে। এখন নতুন করে অনেক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রমুখী হচ্ছে। তবে কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্রে কথা বলে জানা গেছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আর জায়গা নেই। তাই অনেকেই বাধ্য হয়ে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে।

রুদ্ধ অপসারণের পথ

উজান থেকে আসা ঢল লক্ষ্মীপুর-নোয়াখালীতে গিয়ে আটকে থাকা অনেকের কাছেই বিস্ময়কর। এ অঞ্চলের বয়সী ব্যক্তিরাও এবারের ভয়াবহ বন্যা দেখে অবাক হয়েছেন! দখল-দূষণে নদীনালাকে মেরে ফেলে আমরা যে নিজেদের কী ক্ষতি ডেকে আনছি; তা দেখিয়ে দিয়ে গেল এবারের বন্যা। এই দুই জেলার ফুসফুস বলে খ্যাত ভুলুয়া নদী। নদীটি দুই জেলাকে মায়ের মতো আগলে রেখেছে। যুগ যুগ ধরে এই নদী দুই জেলার প্রাণ-প্রকৃতি বাঁচিয়ে রেখেছিল। কিন্তু নদীটির দখল-দূষণ এতটাই বেড়েছিল; যা আর ধারণ করার সুযোগ নেই। ফলে নদী উপচে উজানের ঢল ও বৃষ্টির পানি লোকালয় ডুবিয়েছে। ভুলুয়া নদীর দখল ও অব্যবস্থাপনায় পানিবন্দি লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর ৩ লাখ মানুষ। কিন্তু পরোক্ষভাবে ভুলুয়া নদীর এই অবস্থাই দুই জেলাকে ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি করেছে। নদীর দুই তীরে লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলার অন্তত ২০টি ইউনিয়ন অবস্থিত। নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ ইউনিয়নগুলোর মানুষ রয়েছেন চরম দুর্ভোগে। 

ভুলুয়া নদী নোয়াখালী থেকে শুরু হয়ে লক্ষ্মীপুর জেলার মাঝ দিয়ে দক্ষিণে গিয়ে মেঘনা নদীতে মিলিত হয়েছে। নদীর দুই তীরে লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলার অন্তত ২০টি ইউনিয়ন অবস্থিত। নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ ইউনিয়নগুলোর মানুষ রয়েছেন চরম দুর্ভোগে। নদীর আশপাশের বাসিন্দারা জানান, প্রতিদিনই পানির পরিমাণ বাড়ছে। হাজার হাজার একর জমিতে ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। পুকুরের মাছও নষ্ট হয়েছে। বাসিন্দারা এখন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে থাকলেও পুরো এলাকায় শুকনো জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার মধ্য দিয়ে মেঘনা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ভুলুয়া নদের লক্ষ্মীপুর অংশের দৈর্ঘ্য ৭৬ কিলোমিটার। জলাধারটি আগে গড়ে ৩০০ মিটার চওড়া হলেও এখন কমে গড়ে ১০০ মিটার হয়ে গেছে। ভুলুয়া নদের চর কাদিরা সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে স্থানীয় বাসিন্দা রহিম মাঝি জানান, বিগত কয়েক বছরে রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে স্থানীয় নেতারা যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণ, মাছের ঘের তৈরি এবং বসতি স্থাপন করেছেন। এসব কারণে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে তেমন বৃষ্টি না হওয়ায় সমস্যা হয়নি, কিন্তু এবছর টানা দেড় মাসের বৃষ্টিতে পুরো ভুলুয়া এলাকা ডুবে গেছে।

এবার বন্যায় চরম মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে ফেনীতে। এ জেলার একটি অংশ উপকূল প্রভাবিত। কিন্তু অন্য অংশ; যেখানে বন্যা হওয়ার কোনো ভয়ই ছিল না; সেই এলাকাটিও এবার ভয়াবহ বন্যায় ডুবেছে। এমনকি ফেনী শহর অবধি। যেখানকার মানুষ বাড়ির উঠোনে বন্যার পানি আসার কথা ভাবতে পারেন না; তাদের দোতলা ডুবেছে বন্যার পানিতে। ফেনীর ইতিহাসে এবারের বন্যা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা। ফেনীর বিভিন্ন এলাকায় বানের পানি কমতে শুরু করেছে। পানি যতই কমছে, ততই বেরিয়ে আসছে ধ্বংসচিহ্ন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের অনেকে ঘরে ফিরেছে। আবার নতুন জীবন গড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু ফেনীর পানিও নামছে ধীরে। কোথাও কোথাও বেড়িবাঁধ আটকে দিয়েছে উজান থেকে আসা ঢলের পানি। 

ব্যবস্থাপনায় নজর দরকার

উপকূল ব্যবস্থাপনায় যে আরো জোরদার নজরদারি দরকার, তা আবারো মনে করিয়ে দিল এবারের বন্যা। উপকূল বছরের সব মৌসুমেই কোন না কোন প্রাকৃতিক বিপদের মুখোমুখি হয়। বর্ষাকালে এই বিপদ মারাত্মকভাবে বাড়ে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব অনেক আগেই দেখতে শুরু করেছে উপকূল। বর্ষাকালের বিপদগুলো ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বেড়িবাঁধের বাইরে, বেড়িবাঁধের উপরে এবং বেড়িবাঁধের নিকটবর্তী এলাকার মানুষেরা এই সময়ে চরম সংকটে থাকে। এ ছাড়াও উপকূলের একটি বড় এলাকাজুড়ে বেড়িবাঁধ নেই। সমুদ্র তীরে অবারিত সম্ভাবনা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা উপকূল সুরক্ষায় নজর দিতে হবে। উপকূলের বিপুল সম্ভাবনা বিকাশ এবং মানুষের বিপদের ঝুঁকি বিবেচনায় রেখে উপকূল ব্যবস্থাপনায় নজর বাড়াতে হবে; আনতে হবে পরিবর্তন। 
 

তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়