মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি
তিস্তাপাড়ে দুর্ভোগ কমেনি, পুনর্বাসনে নেই কার্যকর পদক্ষেপ
নিয়াজ আহমেদ সিপন, লালমনিরহাট || রাইজিংবিডি.কম
ক্ষতিগ্রস্ত ঘর মেরামতে ব্যস্ত তিস্তাপাড়ের একটি পরিবার
পানি নামতে শুরু করলেও লালমনিরহাটের তিস্তাপাড়ের হাজারো মানুষের জীবনে স্বস্তি ফেরেনি। ঘর, ফসল এবং রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতির পর টিকে থাকার নতুন সংগ্রাম শুরু হয়েছে সেখানে। স্থানীয়রা ত্রাণ নয়, বরং দ্রুত কার্যকর পুনর্বাসন এবং প্রতি বছরের দুর্বিষহ বন্যা থেকে মুক্তি পেতে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) দুপুর ১২টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে বিপৎসীমার ৪৩ সেন্টিমিটার নিচে। গেল রবিবার রাতে তিস্তার পানি এই পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
তিস্তার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত একটি সড়ক
তিস্তা পাড়ের বাসিন্দারা জানান, তিন দিনের ভারী বৃষ্টি আর উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। গত রবিবার সন্ধ্যা ৬টায় ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। রাতে তা বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তিস্তাপাড়ে রেডএলার্ট জারি করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। অতিরক্ত পানির চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে ফ্লাড বাইপাস কেটে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে তারা। নির্ঘুম রাত কাটে তিস্তা পাড়ের লাখো মানুষের। লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার কিছু অংশ বন্যার কবলে পড়ে।
পানি সরে যাওয়ায় এখন জেগে উঠেছে কাদা আর বালুতে ভরা উঠান এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি। আদিতমারী উপজেলার গরীবুল্লাহ পাড়ার জাহেদা বেগমের মতো অসংখ্য মানুষ এখন নিজেদের সাধ্যমতো ঘর মেরামতের কাজ করছেন। ঘর কোনোরকম ঠিক করাই তাদের কাছে প্রধান চ্যালেঞ্জ।
জাহেদা বেগম বলেন, “এই বছর পাঁচবার বানের পানি দেখলাম। প্রতিবারই ঘর আর জিনিসপত্রের ক্ষতি হয়। সরকার থেকে ত্রাণ দিলেও, আমাদের ঘর মেরামত করার জন্য বা নতুন করে বাঁচার জন্য কোনো সাহায্য পাই না। এবার নিজের হাতেই ঘর ঠিক করছি।”
মাটি দিয়ে ঘরের ফাঁকা হয়ে যাওয়া স্থান পূরণের চেষ্টায় এক নারী
সোবাহান মিয়া বলেন, “আমার জীবনটা তো এই তিস্তার পাড়েই কাটল। ছোটবেলাতেও বন্যা দেখেছি, এখনো দেখছি। প্রতিটি প্রজন্ম শুধু কষ্টই করে যাচ্ছে। এখন আর ত্রাণ চাই না, দরকার স্থায়ী মুক্তি। শুনতে পাই, সরকার তিস্তা মহাপরিকল্পনা করবে। আমাদের একটাই অনুরোধ, যেন দ্রুত সেটা হয়। আমাদের সন্তানদের অন্তত এই দুর্বিষহ চক্র থেকে তারা যেন বাঁচান।”
রহমান মিয়া বলে, “পানি সরে গেছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের রাস্তাঘাট সব ভেঙে গেছে। বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। বাজারে যাওয়া খুব কষ্টকর। অসুস্থ হলে হাসপাতালে নেওয়া আরো কঠিন। প্রশাসন শুধু তালিকা তৈরির কথা বলে, কিন্তু আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ঠিক করতে কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। আমরা চাই, দ্রুত রাস্তা ঠিক করা হোক।”
বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষকরা। রোপা আমন, চিনাবাদাম ও সবজির ক্ষেত সম্পূর্ণ তলিয়ে যাওয়ায় তারা এখন বড় ধরনের ক্ষতির মুখে। অনেক কৃষক ঋণ করে জমি আবাদ করেছিলেন, সেই ঋণ কীভাবে শোধ করবেন সেই দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তাদের।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক জামিরুল বলেন, “কয়েক বিঘা জমির আমন ধান আর সবজি সব পচে গেল। এখন খাব কী আর ঋণ শোধ করব কীভাবে? প্রতি বছর একই অবস্থা, এই সমস্যার স্থায়ী কোনো সমাধান হয় না।”
ফসল হারানো কৃষক আব্দুল বলেন, “ঋণ করে জমিতে আমন ধান লাগিয়েছিলাম, সব তলিয়ে গেল। বীজতলা, সবজি ক্ষেত, চিনাবাদাম—কিছুই আর নেই। কষ্ট করে ফসল ফলাই, তিস্তার পানি এসে এক রাতে সব শেষ করে দেয়। সরকার যদি দ্রুত ক্ষতিপূরণ দিত, তবে ধারদেনা শোধ করার একটা পথ খুঁজে পেতাম। না খেয়ে থাকতে হবে এবার।”
ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা প্রসঙ্গে আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিধান কান্তি হালদার বলেন, “তিস্তা তীরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তাদের সর্বাধিক সহযোগিতার জন্য আমরা প্রস্তুত আছি।”
পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উত্তম কুমার দাশ বলেন, “পাটগ্রামের দহগ্রামে কিছু রাস্তাঘাট ও ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে তাদের সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছি। এবারের বন্যায় মানুষ বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন, তাই তারা দাবি করছেন তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের।”
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, “লালমনিরহাটের পাঁচটি উপজেলায় বন্যায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার তালিকা তৈরির জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা এই তালিকা প্রস্তুত করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছেন। একইসঙ্গে, ক্ষতিগ্রস্তদের কোনো ধরনের সহায়তা প্রয়োজন কিনা, সে বিষয়েও তারা খোজ নিচ্ছেন।”
তিনি আরো বলেন, “আমরা বিশেষ করে পাটগ্রামের আঙ্গরপোতা এলাকাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে আপাতত ১০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দিয়েছি। যদি সেখানে আরো চালের প্রয়োজন হয়, সে জন্য আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। এছাড়াও, অন্য উপজেলাতেও ত্রাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।”
ঢাকা/মাসুদ