ঢাকা     রোববার   ১৯ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

যৌন নিপীড়নের ঘটনায়, রাজনীতির খেলায় মাতবেন না

সুমন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৭, ২১ এপ্রিল ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যৌন নিপীড়নের ঘটনায়, রাজনীতির খেলায় মাতবেন না

প্রতীকী ছবি

চন্দন লাহিড়ী : সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যৌন নিপীড়নের ঘটনাটি এখন দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। সারাদেশে এ ঘটনার প্রতিবাদে চলছে নানা রকম কর্মসূচি। এসব কর্মসূচিতে সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে যেমন ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছেন; আবার তেমনি তারা সোচ্চার হচ্ছেন নিপীড়কদের বিরুদ্ধে এবং একই সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্তদের ব্যর্থতায়।

 

ঘটনার ধারাবাহিকতায় পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের  বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা এবং ঘটনা পরবর্তী ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব জ্ঞানহীন বক্তব্য নিয়ে সচেতন মহল হতাশা প্রকাশ করেছেন। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, যৌন হয়রানির ঘটনায় এলাকায় কর্তব্যরত শাহবাগ থানার এসআই আলী আশরাফকে ক্লোজড করা হয়েছে। এ ছাড়া ঘটনার সঙ্গে জড়িত চার বখাটেকে শনাক্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু তাদের নাম বা পরিচয় এখনো জানতে পারেনি তারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই দিনের ঘটনার ছবি এবং ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলসহ সংবাদ মাধ্যম সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ধরে কয়েকজনকে চিহ্নিত করে তাদের ছবি প্রচার করেছে। কিন্তু অভিযুক্ত কেউ এখনো গ্রেপ্তার হয়নি।

 

এদিকে গত ১৯ এপ্রিল দৈনিক সমকালে প্রকাশিত রিপোর্টে একটি হেডিং ছিল এ রকম, যৌন নিপীড়নের শিকার, প্রায় বিবস্ত্র এক নারী ঢুকে পড়লেন রোকেয়া হলে। হলে আশ্রয় নেওয়ার পর তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে যান ওই হলের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইশাত কাশফিয়া ইরা। এই ধরনের মর্মান্তিক, বিভৎস ঘটনায় লজ্জিত গোটা পুরুষ সমাজ।  যদিও এর প্রতিবাদে এখনো সবাই সরব নন। এ রকমের নানা খবর, ভিডিও ফুটেজ নিয়ে সংবাদপত্র এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বর্তমানে সরব আছে।   অন্যদিকে, অপরাধীদের চিহ্নিত করতে কারও কাছে কোনো তথ্য থাকলে তা জানাতে বলেছে পুলিশ, তথ্যদাতার নাম-পরিচয় গোপন রাখা হবে বলেও পুলিশের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। এ ঘটনার পরপরই যার যা করার কথা ছিল তা না করায়, তাদের ভূমিকা, ঘটনা সম্পর্কে তাদের সংবেদনশীলতা ইত্যাদি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। মোটকথা, এটাই সত্যি যে, যার যা করার কথা, তা না করলে মানুষের সন্দেহ, উদ্বেগ বাড়ে বৈ কমে না।

 

পুলিশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যথাযথ ভুমিকা পালনে ব্যর্থতায় মানুষের মাঝে প্রশ্ন, কাদের রক্ষার জন্য এহেন ভূমিকা তারা পালন করছে। আর তাদের এ ধরনের ব্যর্থতার দায়ভার গিয়ে পড়ছে সরকারের কাঁধে। অবশ্য যথারীতি তা পড়ারই কথা। কারণ এই ব্যর্থতার জন্য সরকারও অপদার্থদের বিরুদ্ধে চোখে পড়ার মতো কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত গ্রহণ করেনি। ফলে ঘটনাটি নিয়ে সবার মাঝেই রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

 

এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ডয়চে ভেলের কাছে দাবি করেছেন, ‘যৌন নিপীড়নের সঙ্গে জড়িতরা কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, তারা বহিরাগত’। এটি বলার মধ্যে দিয়ে তিনি দেরিতে হলেও যৌন নিপীড়নের ঘটনাটি স্বীকার করলেন। এবার দায়িত্বে অবহেলার জন্য নিশ্চয়ই তিনি প্রক্টরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন- এমনটাই সকলের প্রত্যাশা।

 

একইদিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের ঘটনার সঙ্গে অভিযুক্ত আট জনকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাময়িক বহিষ্কার করেছে। এই ঘটনায় ছাত্রলীগ পাঁচজনকে তাদের সদস্যপদ থেকে বহিষ্কার করেছে। যদিও অভিযুক্তদের এখনও গ্রেফতার বা বিচারিক প্রক্রিয়ার মুখোমুখি করা হয়নি। তাৎক্ষনিক এ উদ্যোগের ফলে জনজীবনে খানিকটা স্বস্তি এলেও টিএসসির ঘটনায় মানুষের হতাশার মাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘটনার রিপোর্ট এবং ফুটেজ প্রকাশের কারণে একাত্তর টেলিভিশনের একজন সাংবাদিক এবং তার পরিবারকে হত্যার হুমকি দিয়েছে বলে, তথাকথিত মৌলবাদী সংগঠন এর নামে খবর বেরিয়েছে। যে কেউ কিংবা ঘটনার সঙ্গে অভিযুক্তরাও এ মৌলবাদী সংগঠনের নাম ব্যবহার করে হুমকি প্রদান করতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

 

এ ঘটনা দ্বারা এটি নিশ্চিত করে বলা যাবে না, ঘটনাটির সঙ্গে আসলেই কোনো মৌলবাদী সংগঠনই যুক্ত ছিল কিনা। এটি বলতে হলে কিংবা প্রমাণ করতে হলে অভিযুক্তদের অবশ্যই গ্রেফতার করেই তাদের পরিচয় জানতে হবে দেশবাসীকে। পাশাপাশি, যে কোনো মূল্যে এই নরপশুদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এদের কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। আজ যারা উদ্যোগ গ্রহণে গড়িমসি করছেন, তাদের এ কথা মনে রাখতে হবে যে, এই নরপশুদের হাতে কিন্তু তাদের মা-বোনরাও নিরাপদ নয়।

 

ইতিমধ্যে বিএনপি ঘটনার জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য। কারণ ক্ষমতায় যাবার লালসায় শতাধিক মানুষকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগে অভিযুক্ত এই দলটি এ ঘটনায় কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ধরাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বর্ষবরণের উৎসবের মধ্যে নারীর যৌন নিপীড়নের ঘটনায় লজ্জা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে ‘সকল নারীর কাছে’ ক্ষমা চাইলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান।

 

২০ এপ্রিল মগবাজারে কমিশন কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘নববর্ষের অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যৌন হয়রানি ও লাঞ্ছনার ঘটনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বিস্মিত, মর্মাহত ও লজ্জিত।’ ১৪ এপ্রিলের ওই ঘটনার পর পুলিশের ‘লোক দেখানো’ ভূমিকা নিয়েও হতাশাও প্রকাশ করেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘সকল নারীর কাছে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।’ এ ঘটনা আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে কী হিংস্রতা ও নগ্নতা আমাদের মনের গহীনে বাসা বেঁধেছে।

 

কী ঘৃণ্য মানসিকতা আমাদের পেয়ে বসেছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের এ ধরনের ক্ষমাপ্রার্থনা সাধারণ মানুষের মাঝে নানারকম প্রশ্ন তৈরি করেছে। এরফলে মানবাধিকার কমিশনের ক্ষমতাহীনতা বা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতাই আসলে ফুটে ওঠে বলে সকলের ধারণা। যারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না বা ব্যর্থ হচ্ছেন, তারা কেন এভাবে পদ আঁকড়ে থাকবেন এমন প্রশ্নও করছেন কেউ কেউ। ফলে এর সকল দায় গিয়ে পড়ছে সরকারের ওপর। অবশ্য তাই হবার কথা। এখন সবার মাঝেই প্রশ্ন কেন সবাই নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে আসল ঘটনাটি চাপা দেবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন? এ ঘটনার দায়ভারে লজ্জিত গোটা জাতি। আর এ দায়মুক্তি জন্য প্রয়োজন সময়ক্ষেপন না করেই  কঠোর পদক্ষেপ। দায়ভার এড়ানোর চেষ্টা সংকটের সমাধান না করে বরং ভয়াবহতার দিকেই নিয়ে যাবে।

 

প্রশাসনের নীরবতা এবং উদ্যোগহীনতার কারণে আজ প্রশ্ন উঠেছে, এ ঘটনার সঙ্গে কী ক্ষমতাসীনদের কারো কোনো সংযুক্তি আছে? এ কারণেই কী সবার নীরবতা বা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা? নাকি এ রকম আবহ তৈরি করে তারা তাদের নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করছেন?

 

এ ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগ জড়িত থাকতে পারে, বলে অনেকে সন্দেহ করছে।  আমার কথা হলো, ঘটনায়  জড়িতরা কেউ যদি ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত থাকেই তাহলে সবার আগে তাকে/তাদেরকে গ্রেফতার করে শাস্তির আওতায় আনলেই মানুষ সরকারের ভূমিকার প্রশংসা  করবে। যদি কোনো ছাত্র সংগঠনে এ রকম কোনো নরপশুর অস্তিত্ব থাকে তা মুছে ফেলার এটিই সঠিক সময়। যেমনটি ইতিমধ্যে আমরা জাহাঙ্গীরনগরের ঘটনায় দেখেছি। কিন্তু এসব না করে যারা  একে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছেন, তারা প্রকারন্তরে সরকারকেই বিপদে ফেলার প্রয়াস চালাচ্ছেন।

 

বর্তমান সরকার তো নারীর মানবাধিকার ইস্যূতে ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ গ্রহণ করে দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। সেই সরকার কেন এ ধরনের ব্যর্থতার দায় কাঁধে নেবে, সেটাই এখন সবার প্রশ্ন। এ ধরনের ঘটনার ব্যর্থতায় সরকারের শুধু মর্যাদাই ক্ষুন্ন হয় না, তৈরি হয় মানুষের অনাস্থাও। সুতরাং ঘটনাটি নানাদিক থেকে ক্ষতিয়ে দেখতে হবে এবং এইসঙ্গে দ্রুত অপরাধীদের গ্রেফতার করে শাস্তির আওতায় আনাসহ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্যে দিয়ে মানুষের বিশ্বাস এবং আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আমরা নিশ্চয়ই গুঁটি কয়েক বিকৃত মানসিকতার পশুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করব না। কারণ তাহলে যাদের হাতে এসব ঘটনা প্রতিকারের  দায়িত্ব ছিল- তাদের আদৌ আর কোনো প্রয়োজন থাকবে বলে মনে হয় না।

 

লেখক : মুক্ত সাংবাদিক। [email protected]

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ এপ্রিল ২০১৫/সুমন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়