ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

মায়ের আদেশে আব্বার জানাজা পড়ে দলে যোগ দেই: শহীদুল 

সাইফুল ইসলাম রিয়াদ  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১২, ২০ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৫:০৮, ২০ ডিসেম্বর ২০২০
মায়ের আদেশে আব্বার জানাজা পড়ে দলে যোগ দেই: শহীদুল 

আকবর আলীর কথা এখনো কেউ ভুলেনি। বোনের মৃত্যু শোক চেপে বুকে পাহাড়সম ব্যথা নিয়ে বিশ্বজয় করেছিলেন। দেশের প্রতি ভালোবাসা কিংবা ক্রিকেটের প্রতি নিবেদন থাকলেই এমন কিছু সম্ভব। এবার বাবার মৃত্যু শোক চেপে দল জেমকন খুলনাকে  বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপের ট্রফি জয়ে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন পেসার শহীদুল ইসলাম। 

জানাজা পড়েই দলে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। তবে সেখানে কাজ করছিল বাবার ইচ্ছা পূরণের দৃড়সংকল্প আর কঠোর প্রতিজ্ঞা। দল উঠেছে কোয়ালিফায়ারে। গ্রুপ পর্ব শেষে এবার বাঁচা মরার লড়াই। ঠিক ওই সময়ে দুঃসংবাদটা পেলেন শহীদুল। হারিয়েছেন প্রিয় বাবা হাবিবুর রহমানকে। মুহূর্তেই হোটেল ছেড়ে চলে যান বাবাকে শেষ দেখতে। বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে ফাইনালে উঠবে চ্যাম্পিয়ন হবে। সেই ইচ্ছা পূরণ করতে মায়ের সাহসে শহীদুল দলের সঙ্গে যোগ দেন বাবার জানাজা শেষেই।  

‘মায়ের আদেশে আব্বার জানাজা পড়ে আমি দলে যোগ দিই। এই পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট দরকার ছিল আমার মায়ের। আমার সাপোর্টটা উনার দরকার ছিল। কিন্তু উনিই আমাকে নিজে থেকে বলেছেন আমার কথা চিন্তা করিস না, তোর বাবার ইচ্ছা ছিল তুই ফাইনাল খেলবি চ্যাম্পিয়ন হবি তুই খেলতে যা। আমি এদিকে ঠিক আছি। আমার জন্য তুই চিন্তা করিস না। আসলে উনার এই কথায় আমাকে অনেক সাহস জুগিয়েছি’-রাইজিং বিডিকে মুঠোফোনে এভাবেই বলেছেন শহীদুল। 

ছবি : মিলটন আহমেদ

ঠিক এক সপ্তাহ আগে ১৩ ডিসেম্বর রাতে বাবাকে হারান এই পেসার। এই সাতদিনেই তার পৃথিবী সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। মাথার ওপর থেকে সরে গেছে ছায়া। আবার নিজের ক্যারিয়ারে যুক্ত হয়েছে সাফল্যের পালক। পেয়েছেন চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ। কিন্তু তার কাছে এই চ্যাম্পিয়নের কোনো অর্থ ছিল না। ট্রফি নিয়ে আনন্দ-উল্লাস বলতে কিছুই ছিল না। তার কাছে শুধু একটা বিষয়ই ছিল, বাবার ইচ্ছা পূরণ করতে হবে।  

ফাইনালে শেষ ওভারে জয়ের জন্য প্রতিপক্ষ গাজী গ্রুপ চট্টগ্রামের প্রয়োজন ছিল ১৬ রান। অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ ভরসা করেছেন শহীদুলের ওপর। প্রথম দুই বলে ৩ রান দেওয়ার পর তৃতীয় ও চতুর্থ বলে টানা দুই উইকেট। শেষ বলে ছক্কা হজম করলেও তাতে জয়ের জন্য যথেষ্ট ছিল না। দলকে চ্যাম্পিয়ন করেছেন শহীদুল, পূরণ করেছেন বাবার ইচ্ছাও। কিন্তু বাবা দেখে যেতে পারলেন না। 

কাঁপা কণ্ঠে শহীদুল বলেন,  ‘এই পরিস্থিতিতে অনুভূতিটা আসলে বোঝা যাচ্ছিল না। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যে আনন্দ, যে মজা সেটা একেবারে ক্ষীণ হয়ে গেছে।’ 

‘আমার কাছে কোনো চাপ মনে হয়নি। আমার কাছে চাপ নিয়ে কোনো চিন্তা করার সুযোগ ছিল না। আমার মাথায় শুধু একটা জিনিষই কাজ করছিল বাবার ইচ্ছাটা আমার হাতে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দায়িত্বটা আমার হাতে। আমি পারলে বাবার ইচ্ছা পূরণ হবে। না পারলে বাবার ইচ্ছাটা আমার কারণে নষ্ট হবে। চিন্তা ছিল এটাই আমি আমার বাবার ইচ্ছাটা পূরণ করতে যাচ্ছি।’ 

খুলনার ট্রফি উৎসর্গ করা হয় শহীদুলের বাবাকে। বাবার মৃত্যু থেকে ফাইনাল পর্যন্ত পুরোটা সময় আগলে রেখেছিলেন মাশরাফি মোর্ত্তজা ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদরা। টিম ম্যানেজম্যান্ট পাশে ছিল সবসময়। খেলার সিদ্ধান্ত ছিল শহীদুলের ওপরই। তিনি চাইলে খেলতে পারবেন না চাইলে না। 

শহীদুল বলেন, ‘খেলার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ আমার উপরে ছিল।  মাশরাফি ভাই, মাহমুদউল্লাহ ভাই আমাকে ঘটনার দিন থেকে ফাইনাল পর্যন্ত উৎসাহ দিয়ে গেছে। আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছে। যাতে ভেঙে না পড়ি এই ব্যাপারে অনেক সমর্থন দিয়েছে। টিম মিটিংয়ে বলা হয়েছিল ম্যাচটা আমরা ওর বাবার জন্য খেলব। এ জন্য আমি আমি মাশরাফি ভাই রিয়াদ ভাই সহ টিমের সবার প্রতি কৃতজ্ঞ। উনারা চেষ্টা করছে। এটা আমার সারা জীবন মনে থাকবে।’ 

ফাইনালের মঞ্চে বল হাতে সেরা পারফরম্যান্সটিও করেছেন এই পেসার। বল হাতে ৩৩ রান দিয়ে নিয়েছেন সর্বোচ্চ দুই উইকেট। তার বলে আউট হওয়া মোসাদ্দেক-সৈকত দুজনেই ততক্ষণে খুলনার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের থামিয়ে দলকে জয়ের উল্লাসে ভাসান এই পেসার। শুধু এই ম্যাচ না; খুলনার হয়ে পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই কাটান দুর্দান্ত। সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির তালিকায় আছেন পাঁচ নম্বরে। ৮ ম্যাচে নিয়েছেন ১৫ উইকেট।

শুধু এখানেই নয় ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলছেন ধারাবাহিক। শেষ বিপিএলে ১৩ ম্যাচে ১৯ উইকেট নিয়ে হয়েছেন পঞ্চম সেরা উইকেটশিকারি। খেলেছেন এর আগের বিপিএলও। নেটে বোলিং করতে গিয়ে তাকে পছন্দ হয়ে যায় টম মুডির। সেই আসরেও মাশরাফির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভালো বোলিং করেছেন নারায়নগঞ্জের পেসার। জাতীয় ক্রিকেট লিগ ও বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগেও দ্যুতি ছড়াচ্ছেন। বন্ধ হয়ে যাওয়া ঢাকা লিগ খেলেছেন আবাহনীর জার্সিতে।

তবে শুধু বোলিং নয় ব্যাট হাতেও দলের জন্য ভূমিকা রাখতে দেখা যায় তাকে। প্রথম শ্রেণীর ২৯ ম্যাচে ৬৪১ রানই সবচেয়ে বড় প্রমাণ। আছে চারটি অর্ধশতকও। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ব্যাটিংয়ের সুযোগ খুব একটা পান না। সদ্য শেষ হওয়া টুর্নামেন্টেও একটি ম্যাচে অপরাজিত ছিলেন ১৭ রান করে। বল হাতে শহীদুল অনেক উইকেট নেবেন, ব্যাট হাতে করবেন রান; জয় করবেন অনেক ট্রফি। শহীদুলের আক্ষেপ একটাই থাকবে বাবা আর দেখতে পারবেন না কখনো। 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়