ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

মেসির এই হাসিটা প্রাপ্য ছিল, ফুটবলকে ধন্যবাদ

সালেক সুফী, মেলবোর্ন থেকে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:০৫, ১১ জুলাই ২০২১   আপডেট: ২০:০৯, ১১ জুলাই ২০২১
মেসির এই হাসিটা প্রাপ্য ছিল, ফুটবলকে ধন্যবাদ

মারাকানার ঐতিহাসিক স্টেডিয়ামে চির প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রজিলকে ন্যূনতম ব্যাবধানে (১-০)  হারিয়ে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা ২৮ বছর পর কোপা শিরোপা জয় করেছে। তর্ক সাপেক্ষে সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার এই প্রথম দেশের হয়ে বৈষয়িক কোনো টুর্নামেন্ট জয়ী দলের অংশীদার হলেন। 

ফাইনালে সাধারণ মানের ম্যাচটিতে  গোলে পিছিয়ে পড়ার পর ব্রাজিলের একছত্র প্রধান্য ছিল বলা ভুল হবে না। তবে কিছু কৌশলগত ভুল ছিল। সারাক্ষন আক্রমণ করে খেলেও ব্রাজিল প্রতিপক্ষ ডিফেন্সের ফাঁক ফোকর উন্মোচনে ,চূড়ান্ত আঘাতের সময় তড়িঘড়ি করায় আসল কাজটি করতে পারে নি। 

আর্জেন্টিনা নিজেদের ডিফেন্স বা মাঝ মাঠ থেকে লম্বা বল দ্রুত গতির ডি মারিয়ার কাছে বার বার বল সাপ্লাই করেছে। প্রথমার্ধের শুরুতে সুকৌশলে ডি পল মাঝমাঠ থেকে ডি মারিয়ার দিকে তেমন একটা বল বাতাসে ভাসান। ব্রাজিলের ডিফেন্ডার লোদি সান্তোস এয়ারে বিট হন। ফাঁকায় বল পেয়ে যান ডি মারিয়া। এমন একটা সুযোগ আসবে, সম্ভবত সেজন্য ডি মারিয়াও প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু সুযোগটা দারুণভাবে কাজে লাগালেন তিনি। বলটা যে কোনা দিয়ে এসেছিল ডি মারিয়ার মুলত সেটা ডান পা দিয়েই রিসিভ করার জন্য পারফেক্ট পজিশন ছিল। কিন্তু ডি মারিয়া যে মুলত বাম পায়ের খেলোয়াড়। যাই করেন ঐ পায়ে। গোড়ালির আলতো টোকায় দুর্দান্ত টাচে বলকে মাটিতে নামিয়ে নিজের কাছেই রাখলেন। সামনে ফাঁকা পোষ্টে কেবল ব্রাজিলের গোলকিপার এডারসন। বিপদ বুঝতে পেরে পোস্ট ছেড়ে সামনে বাড়লেন ব্রাজিল কিপার। ডি মারিয়া মূহুর্তের চিন্তায় হালকা চিপ শটে বল তার মাথার ওপর দিয়ে জালে জড়ান। 

 দারুণ সুন্দর সেই গোলেই কোপা আমেরিকার ট্রফি আর্জেন্টিনার হাতে। 

বাতাসে ভেসে আসা বল ধরতে জায়গা বানানো। সেই বল রিসিভ করা। কোন সময় নষ্ট না করে দ্বিতীয় টাচেই গোল! ডি মারিয়ার বাম পায়ে যেন স্বয়ং ফুটবল ঈশ্বর ভর করেছিলেন রোববারের ফাইনালে!

ফাইনালে মন্টিয়েল ব্লেডের জন্য একটা কাজই নির্ধারিত ছিল। নেইমারকে চোখে চোখে রাখা। দক্ষতার সঙ্গে মন্টিয়েল সেই কাজটা সম্পন্ন করেন। নেইমার বল পান। কিন্তু ফিনিসিং দেওয়ার আগেই যে মন্টিয়েল তার সামনে বাধার পাহাড় যেন!

 আর্জেন্টিাইন কোচ স্কোলানি এই ম্যাচের একাদশ গড়ায় মুন্সিয়ানার পরিচয় দেন। তার আউট অফ দ্য বক্স বেশকিছু সিদ্ধান্ত দারুণ ডিভিডেন্ড দেয়। ডি মারিয়া মুলত বদলি খেলোয়াড় হিসেবেই নামেন। কিন্তু হিসেব বদলে ফাইনালে ডি মারিয়াকে সেরা একাদশে রাখেন স্কোলানি। ভালই জানতেন তিনি ফাইনালে মেসিকে তক্কে তক্কে রেখে বোতলবন্দি করার পরিকল্পনা কষছে ব্রাজিল। এই ফাঁকে যদি অন্য কাউকে দিয়ে গোল তুলে নেওয়া যায়, তাহলে ব্রাজিলের পরিকল্পনা মার খাবে।
 
হলোও ঠিক তাই!

 মেসিকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা ব্রাজিল ডি মারিয়ার জন্য নিরাপত্তা দিতে যেন ভুলেই গেল। বয়স হয়ে গেলেও ডি মারিয়া খুবই গতিশীল এখনো। মারিয়াকে চোখে চোখে রাখা, ওর উদ্দেশে পাঠানো লম্বা পাসে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু মেসির চলার ক্ষেত্র সংকীর্ণ করার প্রয়াসে ব্রাজিল কৌশলগত ভুল করে।  মারিয়ার জন্য নিরাপত্তা প্রাচীর গড়তে ভুলে যায়। সেই ভুলের খেসারত দেয় গোল খেয়ে। আর্জেন্টিনা ডি মারিয়াকে নিয়ে ফাইনাল খেলার ছক এঁকেছিল।  সবার দৃষ্টি যখন মেসির প্রতি তখন আন মার্কড ডি মারিয়া আসল কাজটি করে দিলেন। বড় খেলায় ছোট ছোট ভুলই ফলাফলের ব্যবধান গড়ে দেয়।

ব্রাজিল ক্রমাগত সংঘবদ্ধ আক্রমণ করে গেলেও দূর পাল্লার শট খুব কম নিয়েছে আর্জেন্টিনার পোষ্টে। হাতে গোনা যে কটি বরাবর।  লক্ষ্য ছিল কোনো ভাবে বক্সে প্রবেশ করে পেলব ছোয়ায় বল জালে জড়ানো। যখন এই কৌশল কাজ করেনি তখন দ্বিতীয়ার্ধে কৌশল পরিবর্তন করা উচিত ছিল।  কিন্তু আক্রমণ ধারায় পরিবর্তন না আনায় ব্রাজিল খেলা নিয়ন্ত্রণ করেও গোলের দুয়ার খুলতে পারেনি। আর্জেন্টিনা গোলকিপার মার্টিনেজ কয়েকটি ভালো প্রচেষ্টাও রুখে দেন। পুরো টুর্নামেন্টে দারুণ খেলা মার্টিনেজ ফাইনালে চমৎকার পারফরমেন্স উপহার দেন। 

পুরো ম্যাচে নেইমার বেশ কয়েকটি মুভমেন্ট সৃষ্টি করেও কাজের কাজটি করতে পারেন নি। অবশ্য ভাগ্য কিছুটা ব্রাজিলের পরিপন্থী ছিল. খেলার শেষ দিকে মেসি সহজ সুযোগ পেয়েও লিড বাড়াতে পারেননি। এত সহজ গোল মিস করতে মেসিকে সম্ভবত এই প্রথম দেখলাম। 

আর্জেন্টিনার এই শিরোপা অর্জন মেসিকে সম্মানিত করার জন্য অপরিহার্য ছিল। এতো বড়ো মাপের একজন খেলোয়াড় কোনো আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের শিরোপা পাবে না, ফুটবল ঈশ্বর এত নিষ্ঠুর নন! মেসির হাতে ২৮ বছর পর শিরোপা ধরা দিলো। সেটিও চির প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে তাদের মাঠে হারিয়ে।  ব্রাজিল এই প্রথম মারাকানায় কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনালে হারল। 

 শেষবার আর্জেন্টিনা কোপা আমেরিকার ট্রফি জিতেছিল ১৯৯৩ সালে। মেসির বয়স ছিল তখন ৬ বছর। আজ ৩৪ এ পৌছে মেসি সেই টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনাকে চ্যাম্পিয়ন করালেন। জাতীয় দলের হয়ে ট্রফি হাতে মেসির এমন হাসিটা আসলে প্রাপ্য ছিল। 

ফুটবলকে ধন্যবাদ!

সালেক সুফী: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ক্রীড়া অনুরাগী। 

মেলবোর্ন/ এমএম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়