ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

‘নিজের ভবিষ্যৎ কেউ বলতে পারে না, দেখতে পারে না’

ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫১, ২৯ জানুয়ারি ২০২২   আপডেট: ১২:০১, ২৯ জানুয়ারি ২০২২
‘নিজের ভবিষ্যৎ কেউ বলতে পারে না, দেখতে পারে না’

বাংলাদেশের চাকরি ছেড়ে নতুন কর্মস্থলে যোগ দিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে ছিলেন ওটিস গিবসন। কথা বলার সময়টুকুও যেন তার নেই! থিতু হয়ে সময় দেবেন বলে কথা দিলেন। কিন্তু হঠাৎ অসুস্থতায় পিছিয়ে যায় আলোচনা। তাই নিজ থেকে সময় চেয়েছিলেন। 

গত সপ্তাহ হুট করে ফোন দিয়ে বললেন, ‘আর ইউ ফ্রি রাইট নাও।’ মুঠোফোনের এ থেকে পাশ উত্তর, ‘গিভ মি ফাইভ মিনিটস।‘ এরপর রাইজিংবিডির প্রতিবেদক ইয়াসিন হাসানের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলাপ বাংলাদেশের সাবেক পেস বোলিং কোচের। কথার ঝাঁপি খুলে দুই বছর বাংলাদেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করলেন এই ক্যারিবিয়ান গ্রেট।

পিএসএল শুরু হয়ে গেল। নিশ্চয়ই ভালো কিছুর অপেক্ষায় আছেন?
ওটিস গিবসন:
হ্যাঁ এখানে উৎসবের আমেজ। ক্রিকেট এখানে ভালোবাসার আরেক নাম। বাংলাদেশেও তাই। ক্রিকেট পাগল জাতি। প্রথমবার কাজ করছি। বেশ ভালো অনুভূতি। মুলতান সুলতান দলটাও দারুণ। বেশ ভালোমানের খেলোয়াড় পেয়েছি।

জাতীয় দলের দায়িত্ব ছেড়ে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে গিয়েছেন। সিদ্ধান্তটা কঠিন ছিল কি না?
ওটিস গিবসন:
মোটেও না। আমার জন্য সহজ ছিল। কারণ বাংলাদেশে আমার চুক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছিল। চুক্তি নবায়ন নিয়ে কথাও হচ্ছিল না। তাই বাইরে কাজ খোঁজা জরুরী ছিল। মুলতান দল অফার করায় আমাকে খুব একটা চিন্তা করতে হয়নি।

জাতীয় দলের সঙ্গে কাজ করা আর ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে কাজ করার পার্থক্যটা কোথায়?
ওটিস গিবসন: 
পার্থক্য বেশ। এসব টুর্নামেন্ট চার সপ্তাহেই শেষ। হুট করেই শুরু হয়। আবার দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যায়। এখানে নির্দিষ্ট দলের বিপক্ষে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে এগোতে হয়। যা কিছু শেখানো হয় সেটা একেবারেই সাময়িক। নির্দিষ্ট দিনে কিভাবে সাফল্য পেতে হবে সেসব নিয়ে কাজ হয়। আর জাতীয় দলে কাজ হয় একটা প্রক্রিয়ার ভেতরে। ওখানে ক্রিকেটারদের গড়তে হয় আন্তর্জাতিক মঞ্চে পারফর্ম করার জন্য। সেখানে কাজটা কঠিন। পরীক্ষা বেশি। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয় বলেই সাফল্যর জন্য অপেক্ষা করতে হয়।

যাক আপনার জীবনের জন্য শুভকামনা। এবার একটু বাংলাদেশ প্রসঙ্গতে আসি। দুই বছর এখানে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। বিপিএল দিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে যুক্ত হয়েছিলেন। এরপর জাতীয় দলের দায়িত্ব পেয়েছেন। শুরুতেই বলেছিলেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট পাগল জাতি। এখানে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?     
ওটিস গিবসন:
অবশ্যই ভালো। আমি যতুটুক সময় কাটিয়েছি উপভোগ করেছি। ক্রিকেটারদের নিয়ে দারুণ সময় কেটেছে। পেসারদের নিয়ে আমার কাজ ছিল। আমি এই সময়ে বেশ ভালোমানের পেসার পেয়েছি। যাদের শেখার আগ্রহ ছিল। তাসকিন, রাহী, ইবাদত, হাসান মাহমুদরা নিজেদের উন্নতি করেছে। তাদের পারফরম্যান্স এখন প্রশংসিত হচ্ছে। তারা ম্যাচ জিতিয়েছে। পেস বোলিংয়ের মোমেনটাম পাল্টে দিয়েছে। আমি এজন্য অবশ্যই তৃপ্ত তাদের নিয়ে।

আরেকটি বিষয় বলতে চাই, বাংলাদেশে খুব সাফল্য চায়। কিন্তু ক্রিকেটে কুইক বলতে কোনো শব্দই নেই। আপনি চটজদলি কোনো সাফল্য পাবেন না। এজন্য আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যারা বড় হয়েছে তারা প্রত্যেকে নিজেদের গড়েছে। তারপর সাফল্য পেয়েছে। আমি ছেলেদের মধ্যে ক্ষুধা দেখেছি। তাদের আনন্দ নিয়ে অনুশীলন করতে দেখেছি। দেখেছি নতুন কিছু শিখতে। তাই বলছি, ওরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। সেভাবেই ওদের যত্ন করা উচিৎ।

তাদের একধাপ এগিয়ে নিতে কোথায় পরিবর্তন আনা উচিৎ বলে মনে করছেন?
ওটিস গিবসন:
আমি মনে করি মানসিকতা, বিশ্বাসে পরিবর্তন আনা উচিৎ। সেটা কি রকম- টেস্ট হোক, ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টি…প্রত্যেক অধিনায়ককে চিন্তা করতে হবে আমার পেসাররা আমাকে ম্যাচ জেতাবে। ব্রেক থ্রু এনে দেবে। পেসারদের কাজ বল পুরোনো করা নয়। ওরা নতুন বলে উইকেট নিয়ে দলকে এগিয়ে নেবে। শুধু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই নয়, ঘরোয়া ক্রিকেটে এই চিত্রটা বদলাতে হবে। যেমন, জাতীয় লিগে অবশ্যই পেসারদের সারাদিনে তিন চার স্পেলে বোলিং করাতে হবে। সেটাও দীর্ঘ সময়ের জন্য। তারা যেমন বলই করুক, দীর্ঘ সময়ের সাফল্যের জন্য আপনাকে তাদের ওপর আস্থা রাখতে হবে। পাশাপাশি উইকেটের উন্নতি করতে হবে। প্রস্তুতিতে আপনি তাদের এমন কিছু উইকেট দিন যেগুলোতে খেলে তারা এশিয়ার বাইরে খেলার অভ্যাস তৈরি করতে পারবে। তারা আগাবে এভাবেই।

এসব তো প্রায় সময়ই বলা হয়। আপনি যখন দায়িত্ব ছিলেন তখন এসব নিয়ে কথা হয়েছিল বিসিবির সঙ্গে?
ওটিস গিবসন:
অবশ্যই। আমার জায়গা থেকে আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি তাদের জন্য সেরা প্রস্তুতি দেওয়ার। বিসিবি করছে কি করছে না সেই সিদ্ধান্তটা সম্পূর্ণ তাদের। তবে আমার চেষ্টার ঘাটতি ছিল না। সেটা ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বললেই বুঝতে পারবেন।

আপনার সময়ে সেরা সাফল্য কোনটিকে বলবেন?
ওটিস গিবসন:
 অবশ্যই নিউ জিল্যান্ড টেস্ট। সেখানে পেসাররা বাংলাদেশকে এমন সাফল্য দিয়েছে যা এদেশের ক্রিকেটে অনন্য উচ্চতায় থাকবে। দেশের বাইরে বাংলাদেশ টেস্ট জিততে পারে, পেসাররা জেতাতে পারে এটাই তো প্রমাণ করেছে। এটাকে অবশ্যই আমার অর্জন হিসেবেই ধরবো। তাদের উন্নতিতে সামান্য অবদান আমার ছিল। 

কোনো নির্দিষ্ট ক্রিকেটারের কথা যার সাফল্যে আপনি অভিভূত?
ওটিস গিবসন:
আমার চোখে আমার সব শিষ্যই সমান। তাদের প্রত্যেকের উন্নতি হয়েছে সবাই সেটাই বলছে। তবে সাফল্যর কথা চিন্তা করলে তাসকিনই তাদের সবার থেকে এগিয়ে। যেহেতু মোস্তাফিজের পছন্দ সীমিত পরিসরে। তাকে এখানে বিবেচনায় আনার দরকার পড়ে না। সব ফরম্যাট মিলিয়ে আমি বলবো তাসকিন নিজেকে গড়েছে আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেটার হিসেবে। তার শেখার তাড়না অনেক, কঠোর পরিশ্রম করতে পারে। সে ব্যক্তিগতভাবে ফিটনেস নজর দেওয়ায় পরিশ্রমের মাত্রা বেড়েছে। আপনি তার ক্যারিয়ারের শুরু আর বর্তমান অবস্থার পার্থক্য মূল্যায়ন করলেই বুঝবেন। নিজেকে ভেঙে গড়েছে। ফ্যান্টাস্টিক।

আর মোস্তাফিজ…
ওটিস গিবসন:
অবশ্যই সে দলের সেরা বোলার। এটা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। তার বৈচিত্র্য তাকে এগিয়ে নিয়েছে। সীমিত পরিসরে সে দারুণ। বিভিন্ন ফ্রাঞ্চাইজি লিগে খেলছে। তবে তার একটা বিষয় বুঝতে হতো, এখন বয়স কম। সাদা বলের পাশাপাশি লাল বলের ক্রিকেটও খেলতে পারত। সে খুব ভালো লাল বলের ক্রিকেটার হতে পারে। এজন্য তার মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। আপনি দেখবেন, সে যদি লাল বলে সাফল্য পায় তাহলে সীমিত পরিসরে আরো ধারালো হবে।  লাল বলে ধৈর্য ধরে সাফল্য পেতে হয়। তপস্যার দরকার। কিন্তু একটা বড় প্রশ্ন থেকেই যায়, সে কি নিজে চায় লাল বলে খেলতে? যদি উত্তরটা না হয় তাহলে জোরাজুরি না করাই ভালো।

ছেলেরা আপনার যাওয়ার খবর শোনার পর বলেছে, আপনাকে মিস করবে। আপনি আর কিছুদিন থাকলে ভালো হতো…
ওটিস গিবসন:
এটা ওদের ভালোবাসা ছাড়া কিছু নয়। হয়তো নিজেদের কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলেই এসব বলছে। ওদের ধন্যবাদ দেওয়া ছাড়া আর কিছু বলার নেই।

বাংলাদেশে কি আর থাকার সুযোগ ছিল?
ওটিস গিবসন:
কিভাবে থাকবে? আমাকে তো অফার করতে হবে! আমার চুক্তি শেষ। আমি নতুন চাকরি খুঁজে চলে এসেছি।

কিন্তু বিসিবি তো বলছে আপনার চুক্তি নবায়ন নিয়ে প্রস্তুাব দেওয়া হয়েছিল?
ওটিস গিবসন:
সত্যি-ই কি তাই? বিসিবি কারো নাম বলেছে?

খালেদ মাহমুদের নামই বলেছে। তাকে বলা হয়েছিল নিউ জিল্যান্ডে আপনার সঙ্গে কথা বলতে?
ওটিস গিবসন:
আমাকে কি অফার করা হয়েছিল? আচ্ছা যাক…সেসব পুরোনো কথা। বিসিবির কথায় ভুল ছিল। আমাকে কোনো অফার করা হয়নি। আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন খালেদ মাহমুদ। কিন্তু আমার সঙ্গে চুক্তি বাড়াবে কিনা সেসব নিয়ে কথা হয়নি। তিনি বোর্ডের ভাবনা নিয়ে আমাকে পরিস্কার কিছুই বলেননি। ধরে নিতেই হবে আমার এখানে থাকা হচ্ছে না। আরেকটি বিষয়, সিইও সুজনকে আমি মেইল দিয়েছিলাম। যার উত্তরের জন্য আমি সপ্তাহখানেক অপেক্ষা করেছি। এরপরই আমি চলে আসার সিদ্ধান্ত নেই।

বিসিবির সঙ্গে সম্পর্কটা আরো সুন্দরভাবে শেষ হতে পারত কি না?
ওটিস গিবসন:
সুন্দরভাবে হতে পারত কিনা সেটা বলতে পারছি না। তবে আরো পেশাদার হতে পারত।

এজন্য কি কষ্ট আছে?
ওটিস গিবসন:
মোটেও না। আমরা পেশাদার লোক। এটা নিয়ে তো পড়ে থাকলে চলবে না?

বিসিবির ভুলগুলো তো ধরিয়ে দিতে পারতেন…
ওটিস গিবসন:
বিসিবির ভুল ধরানো তো আমার কাজ না। তারা আমার এমপ্লয়ার। আমার কাজ বোর্ডের ভুল ধরানো নয়, খেলোয়াড়দের ভুল ধরানো।

আবার ফিরবেন বাংলাদেশ ক্রিকেটে?
ওটিস গিবসন:
দুই বছর আগে যেমন ব্যাটে-বলে সব মিলেছিল বলে বাংলাদেশে এসেছি, ঠিক সেরকম ভাবেই সব কিছু হতে হবে। নিজের ভবিষ্যৎ কেউ বলতে পারে না, দেখতে পারে না।

চট্টগ্রাম/রিয়াদ  

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়