আঁধার পেরিয়ে স্টোকস ‘বিচ্ছুরণ’
ইয়াসিন হাসান, মেলবোর্ন থেকে || রাইজিংবিডি.কম
শেষ ওভার কতটা ভয়ংকর হতে পারে সেটা নিশ্চয়ই বেন স্টোকসের থেকে ভালো অন্য কেউ জানেন না! কতটা কষ্ট দিতে পারে, কতটা কাঁটা বিধে রক্তক্ষরণ করাতে পারে সেই ধারণাও বুঝি নেই কারও। তাইতো ফাইনাল জয়ের জন্য যখন ৭ বলে ১ রান দরকার তখন ওয়াসিমকে মিড উইকেটে পাঠিয়ে প্রান্ত বদল করেই বাধভাঙ্গা উল্লাসে মেতে ওঠেন স্টোকস।
লিয়াম লিভিংস্টোন রান পূর্ণ করার পর দৌড়ে তার কাঁধে চড়ে বসেন। স্যাম কারান, আদিল রশিদরা দৌড়ে ঢুকে পড়েন মাঠে। অধিনায়ক জস বাটলার ডাগআউটে বসেই উল্লাসে আত্মহারা। ততক্ষণে পাকিস্তানকে ৫ উইকেটে হারিয়ে ইংল্যান্ডের ঘরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা।
ক্রিকেটের নন্দনকানন ইডেন গার্ডেনে শেষ ওভারে চার ছক্কা হজম করে ২০১৬ সালে যে শিরোপা স্টোকস হাতছাড়া করেছিলেন সেই দুঃখ ভোলার নয়। টি-টোয়েন্টি শিরোপা থেকে ইংলিশরা যখন এক পা দূরে তখন কার্লোস ব্র্যাথওয়েটের ব্যাটে চার ছক্কা হজম করে রাতের অন্ধকারে হারিয়ে যান স্টোকস। আঁধার নেমে আসে তার জীবনে।
এরপর অনেক কিছুই স্টোকস পেয়েছেন। মর্যাদার অ্যাশেজ জিতিয়েছেন, জিতেছেন ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ। কিন্তু সুযোগ পেয়েও টি-টোয়েন্টি শিরোপা জেতা হয়নি। ছয় বছর পর পেস অলরাউন্ডার সেই দুঃখ ভুললেন ৮ হাজার ৯৩৮ কিলোমিটার দূরের মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এমসিজি)। চিরশত্রু অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে স্টোকস দায়মোচন করে ইংল্যান্ডকে এক যুগ পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের স্বাদ দিলেন।
গুমোট আবহাওয়ায় পাকিস্তানকে আগে ব্যাটিংয়ে পাঠিয়ে ১৩৭ রানে আটকে রাখে ইংল্যান্ড। বোলিং আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন স্যাম কারান। ৪ ওভারে ১২ রানে ৩ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা বাঁহাতি পেসারই নির্বাচিত হয়েছেন। আর গোটা টুর্নামেন্টে ১৩ উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টেও হয়েছেন তিনি।
তবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মাঠে সব আলো কেড়ে নিয়েছিলেন ওই একজনই, বেঞ্জামিন অ্যান্ড্রু স্টোকস। ৪৯ বলে ৫২ রানের অপরাজিত ইনিংসে ছিল ৫ চার ও ১ ছক্কা। মাঝারিমানের পুঁজির বিপরীতে যে প্রতিকূল পথ পেরিয়েছেন স্টোকস সেজন্য তার ইনিংসটি আলাদা করে দেখা হচ্ছে।
ইংল্যান্ড যেবার শেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ট্রফি জিতেছিল তখন অনূর্ধ্ব ঊনিশে ছিলেন এ পেস অলরাউন্ডার। কয়েক বছরের ব্যবধানেই ইংল্যান্ড দলের ভরসার আরেক নাম স্টোকস। নানা চড়াই উৎরাই আর হাজারও অলিগলি পেরিয়ে ক্রিকেট বিশ্বের সেরাদের কাতারে তার নাম। তাইতো প্রত্যাশা আকাশচুম্বি। এবার স্টোকস হতাশ করেননি।
শাহীন শাহ আফ্রিদি, হারিস রউফ, নাসিম শাহদের গতিময় বোলিংয়ে ব্যাটসম্যানরা যখন আতঙ্কে তখন দেয়াল হয়ে দাঁড়ান স্টোকস। রউফের ১৪৯ কিলোমিটার গতির বল মোকাবেলা করেছেন সিদ্ধহস্তে। নাসিমের ইনসুইং, আউটসুইং খেলেছেন দেখেশুনে। ঠিক একইভাবে আফ্রিদি, শাদাব খানকে চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায়, অসীম সাহস নিয়ে সামলে নিয়েছেন। স্টোকসের ইনিংসটি ছিল একেবারেই সাজানো-গোছানো।
কখন প্রতি আক্রমণে রান করতে হবে, কখন এক-দুই রান নিয়ে প্রান্ত বদল করবেন, কখন ডট খেলে বোলারদের হতাশ করবেন, সবকিছুই মনে হচ্ছিল ছক কাটা পরিকল্পনায়। বাজে বল ছাড়া শাসন করেননি। ভালো বল সমীহ করেছেন।
বলা হয়, ২০১৯ সালের অ্যাশেজে লিডসে তার অপরাজিত ১৩৫ রানের ইনিংসটি সর্বকালের অন্যতম সেরা ইনিংস। রঙিন পোশাকে ওই বছরই ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতাতে ফাইনালে অপরাজিত ৮৪ রান করেছিলেন। এবার টি-টোয়েন্টি স্মরণীয় করে রাখলেন ৫২ রানের ঝকঝকে ইনিংসে। তিন ফরম্যাটে তিন সেরা ইনিংসে দলকে যে সাফল্য দিয়েছেন স্টোকস তাতে তো অমরত্বের স্বীকৃতি পেয়েই যাবেন।
আঁধার পেরিয়ে স্টোকস বিচ্ছুরণের দেখা মিললো মেলবোর্নের ২২ গজে। ব্যাটিংয়ে রান পেয়েছেন। বোলিংয়ে পেয়েছেন উইকেট। ৩২ ছোঁয়ার অপেক্ষায় থাকা চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটার বুঝিয়ে দিয়েছেন সাফল্যের জন্য লেগে থাকতে হয়। মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হয়। দৃঢ় ইস্পাত মনোবল আর নিজের কর্মনিষ্ঠা নিয়ে যেতে পারে গন্তব্যে। ভুলিয়ে দিতে পারে সব কষ্ট। বলা হয়, মানুষের দুঃখ সারাজীবন থাকে না। ব্যর্থতা শেষেই সাফল্য আসে। আঁধারের পরই দেখা মিলে জয়সূর্যের। স্টোকস দেখিয়ে দিলেন এভাবেও ফিরে আসা যায় ক্রিকেটে, জীবনে।
ঢাকা/আমিনুল