স্পিনারদের আনন্দে সুপার ওভার রোমাঞ্চ
নিজেদের স্বর্ণযুগে কার্টলি এমব্রোজ, কোর্টনি ওয়ালস ভাগ্যিস বাংলাদেশ সফর করেননি! নয়তো পেসার হওয়ার খেসারত দিতে হতো নিশ্চিতভাবেই। একাদশে থাকতেন। কিন্তু বোলিং করার সুযোগ পেতেন না। যেমনটা জাস্টিন গ্রেভস এখন করছেন। কিংবা শেফরন রাদারফোর্ড।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট মানেই আক্রমণাত্মক বোলিং, ভয়ংকর বাউন্সার, গতি ও সুইংয়ের সুন্দর প্রদর্শনী। যা দিয়ে তারা বিশ্ব ক্রিকেট শাসন করেছেন লম্বা সময়। অথচ এমন একটা সময় আসল যখন তাদের একাদশে পেসার খেললেও, তার হাতে বল দেওয়ার সাহস পান না অধিনায়ক! মিরপুরের স্পিন রাজ্যে পেসার খেলানো মানে বিলাসিতা! অন্তত শেই হোপ এই বার্তাই ক্রিকেট বিশ্বকে দিতে চাইলেন।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং ইনিংসের ৫০ ওভার মধ্যে ৫০ ওভারই করলেন স্পিনাররা। গতি দিয়ে হাত ঘুরাতে পারেন এমন বোলার একাদশে আছেন দুজন। কিন্তু স্পিন দূর্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেই সাহসটা দেখাল না। তাতে প্রায় ৫৫ বছরের ওয়ানডে ক্রিকেট নতুন এক ইতিহাসের সাক্ষী হলো।
মিরপুরের ২২ গজে ওয়ানডে ক্রিকেটের ৪৯১২তম আন্তর্জাতিক ম্যাচ হলো। দীর্ঘ এই পথ পরিক্রমায় ওয়ানডে ক্রিকেট ম্যাচে এক ইনিংস হয়নি যেখানে কোনো পেসার এক ওভারও করেননি। ১৯৯৬ সালে এক ইনিংসে শ্রীলঙ্কা স্পিনারদের দিয়ে করিয়েছিল ৪৪ ওভার। আজ সেই রেকর্ড চুরমার করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৫০ ওভার করাল স্পিনারদের দিয়ে।
অতিথিদের এমন বোলিং আক্রমণের একমাত্র কারণ মিরপুরের উইকেট। যেখানে বল এদিক-ওদিক ছোবল দিল। চিরায়িত উচুঁ-নিচু বাউন্স হয়নি অবশ্য। বাংলাদেশের বোলিংয়েও একই চিত্র। চার স্পিনার নিয়ে একাদশ সাজানো বাংলাদেশের একমাত্র পেসার মোস্তাফিজুর রহমান। মিরাজ অবশ্য তাকে দিয়ে ৮ ওভার বোলিং করিয়েছেন। দুই পক্ষের স্পিনারদের মধ্যকার লড়াইয়ে ফলাফল নির্ধারণে চরম নাটকীয়তা হয়েছে।
বাংলাদেশের করা ২১৩ রানের জবাব দিতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজও করে ২১৩ রান। তাতে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো সুপার ওভারের অভিজ্ঞতা পায়। বাংলাদেশের মাটিতেও হয় প্রথম সুপার ওভার।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ শেষ ওভারে ৫ রানের সমীকরণ মেলাতে পারেনি। হিসেবের অমিলে শেষ ওভার মিরাজ কাকে দিয়ে করাবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। কিন্তু সাইফ হাসান বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। প্রথম দুই বল আকিলকে ডট খেলান। পরের দুই বলে আকিল ও হোপ ২ রান নেন। পঞ্চম বলে আকিল আউট হলে উত্তেজনা ছড়ায়। শেষ বলে ৩ রানের প্রয়োজেন পিয়েরে ব্যাট চালালেও মিড উইকেটে ক্যাচ তোলেন। দৌড়ে সোহান সেই ক্যাচ নেওয়ার চেষ্টা চালান। কিন্তু গ্লাভস ফসকে বেরিয়ে যায়। ওই সুযোগে ২ রান নিয়ে ম্যাচ টাই করেন হোপ ও পিয়েরে।
সুপার ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আগে ব্যাটিংয়ে নেমে ১০ রান তোলেন। মোস্তাফিজ রাদারফোর্ডের উইকেট পাওয়ার পরও হোপের শেষ বলে বাউন্ডারিতে পুঁজি দুই সংখ্যায় যায়। জবাবে বাংলাদেশ দুইটি ওয়াইড-একটি নো বল পাওয়ার পরও ৯ রানের বেশি করতে পারেনি। ১ রানের জন্য ম্যাচ জিততে পারেননি বাংলাদেশ। সুপার ওভার জিতে তিন ম্যাচের সিরিজে ১-১ এ সমতা আনল ক্যারিবীয়রা।
তবে যতই উত্তেজনা ছড়াক, যত নাটকীয়তা হোক প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। উদ্দেশ্যহীন, স্পিনারদের আনন্দের দিনে নিশ্চিতভাবেই নিরানন্দ হচ্ছে ক্রিকেট। আধুনিক ক্রিকেট যে ধাঁচে এগিয়েছে, যে গতিতে আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে সেখানে নিরাপদ ক্রিকেট নষ্ট করে দিচ্ছে ক্রিকেটীয় আমেজ। যেখানে সাফল্য কেবলই একটি সংখ্যা। যা আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পারে সামান্য সময়ের জন্য। কিন্তু বড় পরিসরে, ক্রিকেটের বিশাল ক্যানভাসে রং ছড়াতে পারবে সামান্যই। বারবার যার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট।
দুই দল মিলিয়ে ১০০ ওভার বোলিং করেছে (সুপার ওভার বাদে)। যেখানে স্পিনাররা করেছেন ৯২ ওভার। এর আগে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে সর্বোচ্চ ৭৮.২ ওভার হাত ঘুরিয়েছেন স্পিনাররা। ২০১৯ সালে দেরাদুনে আফগানিস্তান-আয়ারল্যান্ড ম্যাচে। আইরিশ স্পিনাররা ৩৯ ও আফগান স্পিনাররা ৩৯.২ ওভার বোলিং করেছিলেন সেদিন। সেক্ষেত্রে এবার মিরপুর শের-ই-বাংলার নাম ইতিহাসের অক্ষয় কালিতে লিখা হয়ে গেল।
উইকেটে রান তোলা কঠিন ছিল। ওয়ানডে ক্রিকেটে শেষ কবে শর্ট লেগ, দুই স্লিপ নিয়ে ফিল্ডিং সাজাতে দেখেছেন? মিরপুর সেই স্বাদ ফিরিয়ে এনেছে। ডট বলের মহড়া ছিল দুই ইনিংসেই। আগে ব্যাটিং করতে নামা বাংলাদেশের ইনিংসে ডট ছিল ১৯৩টি। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১৭৩টি।
বাংলাদেশের পুঁজি দুইশ ছড়ায় রিশাদ হোসেনের শেষের ঝড়ে। নয় নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে ১৪ বলে ৩টি করে চার ও ছক্কায় ৩৯ রান করেন। স্ট্রাইক রেট ছিল ২৭৮.৫৭। তাতে দল বলার মতো পুঁজি পায়। সেই সঙ্গে একটি রেকর্ডও করেন তিনি।
ওয়ানডেতে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের অন্তত ২৫ রানের ইনিংসে এর চেয়ে বেশি স্ট্রাইক রেটে আর কেউ ব্যাট করতে পারেননি। এর আগের সর্বোচ্চ স্ট্রাইক রেট ছিল সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার, কেনিয়ার বিপক্ষে ২০০৬ সালে করেছিলেন ১৬ বলে ৪৪ রান। স্পিন বান্ধব উইকেটে বাকিরা পরীক্ষা দিয়েছে। সৌম্য ৮৯ বলে ৪৫, মিরাজ ৫৮ বলে ৩২ রান করে অপরাজিত থাকেন।
ওয়েস্ট ইন্ডিজকে শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ে রাখেন অধিনায়ক হোপ। ৬৭ বলে ৫৩ রান করে অপরাজিত থাকেন। বাকি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে কেসি কার্টি ৩৫, গ্রেভস ২৬ রান করেন। ব্যাটিংয়ের পর বল হাতে রিশাদ ৩ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের সেরা বোলার ছিলেন।
স্বল্প পুঁজিতে দুই দলই তীব্র লড়াই করেছে। ম্যাচ টাইয়ের পর সুপার ওভারে বিজয়ী নিষ্পত্তি হয়েছে। মূল ম্যাচে সহজ একটি ক্যাচ হাতছাড়া করে ম্যাচ টাই করার পর, সুপার ওভারে ৯ বল খেলার সুযোগ পেয়েও ১১ রান করতে না পারা নিশ্চিতভাবেই চরম ব্যর্থতা। তাতে সিরিজ জয়ের অপেক্ষা আরো বাড়ল স্বাগতিকদের।
একদিন পর বৃহস্পতিবারই সিরিজের শেষ ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হবে। দুই ওয়ানডের মতো শেষটায় স্পিনাররাই ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয় নাকি দেখার।
ঢাকা/ইয়াসিন