ঢাকা     রোববার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৬ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্দশা ও কিছু প্রস্তাব

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৭ আগস্ট ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্দশা ও কিছু প্রস্তাব

একজন মুক্তিযোদ্ধা (প্রতীকী চিত্র)

আবুল কাশেম চৌধুরী : বঙ্গবন্ধু ছিলেন আজীবন সংগ্রামী জনদরদী গণমানুষের নেতা। তিনি ছিলেন শোষিতের নেতা- শোষকের নয়। স্বাধীনতা অর্জনের মূল লক্ষ্য ছিল সাধারণ গরিব মানুষের মুক্তি। গরিবি হটাও- দারিদ্র্য দূর করা এই মূলমন্ত্রে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে বাঙালি জাতি।

 

স্বাধীনতা অর্জনের ৪৪বছর পরেও বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা অভাব অনটনে কষ্টকর মানবেতর জীবন যাপন করছে। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০% দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় ৯০% ছিলেন কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর ও গরিব মানুষের সন্তান- অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত। মুক্তিযোদ্ধাদের কারো কারো হাতে আজ ভিক্ষার ঝুলি। (৫ আগস্টের (২০২৫) যুগান্তরে ছবি সহ এক মুক্তিযোদ্ধার করুণ কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে, যার এক হাতে মুক্তিযোদ্ধা সনদ অন্য হাতে ভিক্ষার থালা)।

 

অক্ষত সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা কষ্টকর জীবন যাপন করে সে দিকে কারো নজর থাকে না। অক্ষত মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়া-পরা,চিকিৎসা,বাসস্থান ও সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষা লাগবে না?  সরকার বিভাজনের সুযোগে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সুযোগ সুবিধা প্রদানে কৌশলে বিরত থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে দিয়েছে, কিন্তু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী হয় না সরকার। যা কারো কাম্য হতে পারেনা।

 

১৯৯৯ সালের শেষের দিকে মন্ত্রীসভার বৈঠকে মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ১৮ দফা কর্মসূচী আলোচনা-সিদ্ধান্ত গ্রহণ পূর্বক প্রধানমন্ত্রী তা বাস্তবায়নের কথা ঘোষণা করেন। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক উপদেষ্টা খন্দকার আসাদুজ্জামান মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ইফতার অনুষ্ঠানে ১৮ দফা কর্মসূচি পাঠ করেন, পরবর্তীতে তা কার্যকর করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার ২০০১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০০ টাকা মাসিক সম্মানী ভাতা চালু করেছিলেন। ১৫ বছরে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা ২৫ হাজার টাকায় উন্নিত হওয়া উচিত ছিল।

 

২০০৪ সালে ১৪ দলীয় জোট গঠনের পর ১৪ দলীয় নেতারা মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ২৬ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেন এবং ১ ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস ঘোষণা করেন। কোন মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলে তার পরিবারকে ২লাখ টাকা প্রদান করা হবে- ঘোষণা পত্র পাঠ করেন বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জননেতা প্রয়াত আবদুল জলিল ও আদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, রাশেদ খান মেনন। ১৪ দল ক্ষমতাসীন হয়ে সবকিছু বেমালুম ভুলে গেছেন।

 

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ১২ নং দফায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বেশ কয়েক দফা কমসূচী বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করা হলেও ১ দফাও কার্যকর করা হয়নি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে ২৮ জুন ২০০৯ প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছিলেন ৬০ বছর বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধারা বিনা খরচে রেল, বাসে, নৌ যানে ভ্রমণ করবে। সে ঘোষণা ২৪ জুলাই ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনেও করেছিলেন সরকার প্রধান, যা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচন প্রাগ ইশতেহারে বলা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যা কিছু করণীয় তা আওয়ামী লীগ তা করবে। আওয়ামী লীগ কি কি করবে তা বলা হয়নি।

 

প্রধানমন্ত্রী ২০১০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ঘোষণা করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। কিন্তু সে হাসপাতালের জন্য আজ পর্যন্ত জায়গা নির্ধারণ করা হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের নির্মিত মিরপুরের হাসপাতালটি আজ পরিত্যক্ত। প্রধানমন্ত্রী ২০১০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ঘোষণা করেছিলেন গরিব-ভূমিহীন মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সরকারি খরচে বাড়ি তৈরি করে দেবে সরকার। সে ঘোষণা কার্যকরের লক্ষ্যে গরিব ভূমিহীন মুক্তিযোদ্ধাকে বাড়ি করে দেওয়ার লক্ষ্যে ২০১১ সালে বাজেটে ২২৭কোটি ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ প্রদান করে। উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তাকে দায়িত্ব প্রদান করে অর্থ সহ নীতিমালা প্রেরণ করে সরকার। একবিঘার কম জমির মালিক মুক্তিযোদ্ধারা এই নীতিমালার আওতায় আসবে। প্রায় ক্ষেত্রে স্থানীয় এমপি নিজ হাতে দায়িত্ব গ্রহণ করে উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তাকে ঠুটোজগন্নাথ বানিয়ে  দলীয় বিত্তবান নেতাকর্মীদেরকে বাড়ি বরাদ্দ করেন এবং সে প্রকল্প ৪ বছরেও সমাপ্ত করা হয়নি।

 

 

আবার ২০১৪ সালে আরও ১০ হাজার গরিব মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি  করে দেওয়ার প্রস্তাব মন্ত্রণালয় গ্রহণ করলেও একনেকে এ প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে কিনা জানা যায়নি। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি/ঘোষণা যেন কার্যকর না হয় সেজন্য একটি মহল সুকৌশলে কাজ করে চলেছে। ২০১০ ও ১১ সালে সরকার প্রধান কয়েকবার ঘোষণা করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরা সরকারি খরচে ¯œাতক পর্যন্ত লেখাপড়া করবে। প্রধানমন্ত্রীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ নেই তবে একটি মহল সুকৌশলে মুক্তিযোদ্ধা বিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

 

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর নতুন সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বারবার ঘোষণা করেন ২০১৫ সালের জুলাই থেকে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের ভাগ্যের পরিবর্তন করা হবে। তাদের সুযোগ-সুবিধা অনেক বাড়ানো হবে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই করা হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের ডিজিটাল সনদ দেওয়া হবে। আইডি কার্ড দেওয়া হবে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সনদ ও আইডি কার্ড দেয়ার  কাজ সমাপ্ত করবে মন্ত্রণালয়। মন্ত্রী আরো ঘোষণা করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদেরকে মাসিক সম্মানী ভাতা দশ হাজার টাকা ভাতা প্রদান করা হবে, বছরে ২টি সমপরিমান বোনাস দেওয়া হবে। সকল মুক্তিযোদ্ধাকে রেশন দেওয়া হবে। চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা হবে। কিছুই হলনা!

 

জাতীয় বাজেটে দেখা গেল সব শূন্য আর শূন্য! এর পরিপ্রেক্ষিতে নি¤েœ বর্ণিত দাবি বিবেচনার জন্য অনুরোধ করি। সেনা, নৌ, বিমান, বিডিআর (বিজিবি), পুলিশ, আনসার, মোজাহিদ, ভারতীয়, নৌ কমান্ডো লালমুক্তিবার্তা তালিকা (গেজেট) চুড়ান্ত হওয়া। যা বদল হওয়ার সুযোগ নেই। গেজেট ও তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মন্ত্রণালয় কর্তৃক ডিজিটাল সনদ ও আইডি কার্ড দেওয়া যেতে পারে। যাচাই-বাছাইয়ের পরে অন্যদেরকে ডিজিটাল সনদ ও আইডি কার্ড দেওয়া যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সকল প্রকার হয়রানি বন্ধ করা জরুরি।

 

শিক্ষিত-অশিক্ষিত সাধারণ-অসাধারণ কেউ নয়, আহত-অক্ষত সবাই মুক্তিযোদ্ধা। সকলেই সমান। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সাধারণ-অসাধারণ আহত-অক্ষত বলে বিভাজন করা সঠিক হবেনা। যুদ্ধের মাঠে কেউ অসাধারণ/শিক্ষিত বলে দাবী করেননি! একে অপরের সহযোদ্ধা ছিলেন মাত্র। শিক্ষিত বড় মাপের মুক্তিযোদ্ধাদের দেশপ্রেমের নজির প্রত্যক্ষ করেছি। মুক্তিযোদ্ধারা সকলে বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়েছে শেষ বয়সে মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকতে চায়। প্রায় ৮০% মুক্তিযোদ্ধা মানবেতর জীবন যাপন করে চলেছে, অনেকের মাথা গুজবার ঠাঁই নেই।

 

আমার প্রস্তাব :

ক. ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই করা উচিত।

খ. মুক্তিযোদ্ধাদের ডিজিটাল সনদ ও আইডি কার্ড দিতে হবে।

গ. মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক সম্মানী ভাতা যুগোপযোগী করে ২০ হাজার টাকা ও বছরে ২টি সমপরিমাণ টাকার বোনাস প্রদান করা উচিত।

ঘ. সকল সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাকে রেশন দেওয়া উচিত, গরিব মুক্তিযোদ্ধাদেরকেতো বাঁচতে হবে।

ঙ. চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা দরকার।

 

মন্ত্রণালয় আরো দশ হাজার বাড়ি গরিব মুক্তিযোদ্ধাদের প্রদানের যে প্রকল্প হাতে নিয়েছে তা তরান্বিত করা উচিত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা কী সুবিধা ভোগ করছে,  তা বিবেচনা করা উচিৎ।

 

সরকার বলছে দেশে উন্নয়ন হয়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, জিডিপি বেড়েছে, দারিদ্রতা কমেছে। এমনি অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা দরিদ্র থাকবে কেন? অভাব অনটনে মানবেতর জীবন যাপন করবে কেন মুক্তিযোদ্ধারা? যারা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করলো তারা কেন মানবেতর জীবন যাপন করবে? দরিদ্র জনগোষ্ঠির একটি বড় অংশ সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা- যারা সহজে হাত পাততে পারেনা, তাদের সংখ্যাও বেশি নয়- ৭০ থেকে ৮০ হাজার হতে পারে। সাধারণ গরিব মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি নৈতিক দায়িত্ব পালন করা জরুরি সরকার ও বিত্তবানদের।

 

২০০২ সালে বেগম খালেদা জিয়ার সরকার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে ঘোষণা করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলে মৃত মুক্তিযোদ্ধার দাফন/কাফন/সৎকার বাবদ ১৪,৯০০ টাকা প্রদান করা হবে। মৃত মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা প্রদান করা হবে, বাস্তবে তা করা হয়নি। মুক্তিযোদ্ধারা বেগম জিয়ার সরকারের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের কোন প্রকার মিল চায়না, যথার্থ পার্থক্য দেখতে চায়। কারণ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা।

 

আবুল কাশেম চৌধুরী : প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাক্তন সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য- বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল। [email protected]

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ আগস্ট ২০১৫/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়