ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ইস্তাম্বুল: নীল জলে পা ডুবিয়ে যে নগর থাকে অপেক্ষায় || ষষ্ঠ পর্ব

ফাতিমা জাহান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইস্তাম্বুল: নীল জলে পা ডুবিয়ে যে নগর থাকে অপেক্ষায় || ষষ্ঠ পর্ব

গালাটা টাওয়ার থেকে বের হলে ভুলভুলাইয়ার মতো টাওয়ার ঘিরে চারপাশে অজস্র গলি চলে গিয়েছে। কোন পথ ধরে যে এসেছি মনে করতে পারছি না। প্রত্যেকটা পথ দেখতে একই রকম। আর পথের দুই পাশে নানান রেস্তোরাঁ আর স্যুভেনিয়রের দোকান। একজনকে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিলেন। গলি থেকে বের হয়ে রাস্তা পার হলেই বসফরাস। বসফরাসের তীর বাঁধাই করে দেয়া হয়েছে কংক্রিটে। বসে রইলাম তীরজুড়ে। ভ্রমণার্থীরা আসছেন যাচ্ছেন। বসফরাস নীল আলো জ্বেলে স্বাগত জানাচ্ছে তাদের।

বসফরাসে ভ্রমণের জন্য জাহাজে চড়ে বেড়ানোর ব্যবস্থা আছে, তবে রাতে তা আরো মনোরম। তাই ঠিক করলাম রাতে একবার ঘুরে যাব। দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে। বসফরাসের তীর ঘেঁষে আছে হরেক রেস্তোরাঁ। একটায় ঢুকে গেলাম।

পরবর্তী গন্তব্য ডলমাবাহচে প্যালেস। কারাকোয় থেকে ট্রাম ধরে যেতে হবে স্টেশনে।

ক্রিস্টাল ও সোনার তৈরী ডিনারসেট,  ডলমাবাহচে প্যালেস

 

ইস্তাম্বুলের রাস্তাঘাট ইউরোপের মতো সাজানো। চোখে পারফেক্ট ট্রিট। তিনটে স্টেশন বাদেই ডলমাবাহচে প্যালেস। প্যালেসে ঢোকার আগে প্যালেসের মসজিদ। মসজিদের কারুকাজ এতই মনোমুগ্ধকর যে মসজিদকেই আমি প্রাসাদের অংশ ভেবে বসেছিলাম। অথচ মসজিদ ছিল প্রাসাদের বাউন্ডারির বাইরে। খানিক হেঁটে প্রাসাদের মূল প্রবেশদ্বার। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সুলতান আব্দুল মেজিদ (১) ডলমাবাহচে প্যালেস নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। তখনকার সময়ে তার কাছে তোপকাপি প্যালেস ইউরোপীয় অন্যান্য প্রাসাদের সামনে পুরনো মনে হয়েছিল স্থাপত্যকলা ও সুযোগসুবিধায়। তাই বসফরাসের তীরে আরেকটি প্যালেস নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, পূর্ববর্তী বেশিকতাস সাহিল প্যালেস প্রাঙ্গণে। প্রাসাদ নির্মাণের কাজ শুরু হয় ১৮৪৩ সালে এবং শেষ হয় ১৮৫৬ সালে। স্থাপত্যবিদ গারাবেত আলইয়ান প্রাসাদের মূল নকশা করেন বারোক, রোকোকো, নিওক্লাসিক্যাল ও অটোম্যান শিল্পের ধরণ মাথায় রেখে। তুরস্কের পড়ন্ত অর্থনৈতিক অবস্থা থাকা সত্ত্বেও বিলাসবহুল প্রাসাদটি নির্মাণে সে সময়কার এক চতুর্থাংশ বাৎসরিক রেভিনিউ খরচ হয়েছিল। এখনকার মুদ্রায় যা প্রায় দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান।

তুর্কী ভাষায় ডলমাবাহচে শব্দের অর্থ ‘বাগানের সমারোহ’। আমার নিজের ভাষায় আমি যাকে বলি গুলবাহার। তুরস্কের সর্ববৃহৎ এ প্রাসাদটির আয়তন প্রায় ১১.১ একর। ২৮৫টি কক্ষ, ৪৮টি দরবার হল, ৬টি হামাম বা স্নানঘর ও ৪৬টি শৌচাগার নিয়ে প্রাসাদ পারি দিয়েছে প্রায় দেড়শ বছর। মূল প্রাঙ্গণে সবুজের সমারোহ। ডানে বায়ে ফুলবাগান আর চমৎকার তার বিন্যাস। ডানদিকে ক্লক টাওয়ারের তিনতলা সরু ভবন, ভবনের গায়ে ইউরোপীয় ক্লাসিক্যাল কারুকাজ। ভবনের মাঝখানে একটি ঘড়ি রাখা আছে। সামান্য এগোলেই ডানপাশে সুলতান আব্দুল মেজিদ (১) এর কামান রাখা আছে। তামার তৈরি কামানটি এখন রোদে জলে সবুজ রং ধারণ করেছে বাগানের সঙ্গে মিলিয়ে। কামানে সূক্ষ্ম কারুকাজের সঙ্গে লেখা আছে ফারসি শব্দাবলী।

ডলমাবাহচে প্যালেস থেকে বসফরাস

 

প্রবেশদ্বারের বিশাল দেয়াল খোদাই করা আছে ইউরোপীয় ক্লাসিকাল নকশায়। ধূসর বর্ণের সামান্য কারভড দেয়ালের মাঝখানের দরজাটি মুখরিত হয় হাজার মানুষের বিস্ময়ে। দুয়ার পার হয়ে আরেকটি মাঝারি আকারের দরজা। এরপর বিশাল উদ্যান। শীতকাল শেষে এখানে টিউলিপের চাষ হয়। আমার বন্ধুর ছবিতে দেখেছি। এখন গোলাপে আচ্ছাদিত। উদ্যানের মাঝখানে জলাধার,  জলের রং শ্যাওলা সবুজ, একটা রিমঝিম ভাব আসে। জলাধারের মাঝখানে লহরীর ফোয়ারা। সেখান থেকেও জল পরছে। জলাধার পার হলে হাতের বাঁ দিকে কোষাগারের দ্বার যা এখন বন্ধ আর ডান দিকে অবধারিতভাবে চেয়ে আছে বসফরাস। আর সোজা হাঁটলেই প্রাসাদের মূল ভবন, তুষার শুভ্র রং যার।  এত বিশাল প্রাসাদ যে তাক লেগে যায়! প্রাসাদে ঢোকার আগেই সমন শুনলাম-ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ। হায় হায়! এত বড় প্রাসাদের এত কিছু দেখার আছে, ছবি না তুললে মনে রাখবো কীভাবে?  প্রথম কক্ষে ছাদের নকশা আর ছোট ছোট ঝাড়বাতি দেখার মত। আস্তে আস্তে দ্বিতীয় তৃতীয় কক্ষ পার হচ্ছি আর প্রাসাদের জৌলুশ যেন বেড়েই চলেছে। ১৪টন সোনা আর অগুনতি আসল ক্রিস্টাল কাচের ব্যবহার হয়েছে প্রাসাদে। বসফরাসের দিকের কক্ষগুলো মন্ত্রী আর সাম্রাজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দফতর। আর পেছনের কক্ষগুলো হিসাবরক্ষক, ইত্যাদি পদাধিকারীদের দফতর হিসেবে ব্যবহার করা হতো। নিচতলার বাকি কক্ষগুলো সাধারণত মিটিং বা অতিথি আপ্যায়নের কক্ষ। যার ছাদ থেকে বেয়ে পড়ছে বারোক, রোকোকো নকশা, সে নকশায় রয়েছে নানা রঙের চিত্রকলা আর সোনার কারুকাজ। প্রতি কক্ষের শান শওকত বাড়িয়েছে কক্ষের মাঝখান থেকে ঝুলে পড়া ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি, বা কোন কোন বিশালাকৃতির ঝাড়বাতি মেঝেতে স্ট্যান্ডের ওপর রাখা। একেকটা কক্ষের নকশা যেমন আলাদা তেমনি আলাদা ঝাড়বাতির নকশা, আসবাবপত্রও আলাদা ডিজাইনের, বাড়তি সংযোজন দেয়াল সমান আয়না, যার ফ্রেমে সোনার কারুকাজ। সুলতানের অনেকগুলো বৈঠকখানা ছিল আলাদা অতিথিদের জন্য। আর তাতে ছিল ভিন্ন ডিজাইনের সোফা সেট, ভিন্ন ভিন্ন ডাইনিং রুমেও ছিল ভিন্ন খাবার চেয়ার টেবিল।

নিচতলার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ সুলতানদের ব্যবহৃত তৈজসপত্র। প্লেট, গ্লাস, জগ, কাপ বেশিরভাগই সোনা বা রূপা দিয়ে তৈরি, আর কিছু আসল ক্রিস্টালের। কোন কোন প্লেট বাটি, গ্লাস আবার ক্রিস্টালের ওপর সোনার কারুকাজ খচিত,  কোনটায় আবার সোনা, হীরের যুগলবন্দী যাকে বলা হয় বোহেমিয়ান আর বাক্কারা ক্রিস্টাল। এই তৈজসপত্র আসতো ফ্রান্স থেকে। প্রাসাদের সবচেয়ে মনোরম অংশ সাধারণত বলা হয়ে থাকে এর সিঁড়ি। কারণ সিঁড়ির রেলিং আসল ক্রিস্টাল দিয়ে তৈরি, সাথে শোভা বাড়িয়েছে পেতল আর মেহগনির ফ্রেম। আর সিঁড়ি মোড়া লাল টুকটুকে কার্পেট দিয়ে। সিঁড়িটি প্রাসাদের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত একদম ওপরে গোলাকার ছাদ কাচে ঘেরা। সিঁড়ি গোল হয়ে চারটি বাঁক নিয়ে প্রবেশ করেছে প্রাসাদের চার কোণায়। দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ছবি তোলা নিষেধ। এশিয়ায় বিভিন্ন মন্দিরের ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ জানতাম, প্রাসাদে ছবি তোলা নিষেধ এই প্রথম দেখলাম।

এই সেই প্রাসাদ যেখানে তুর্কী নির্ভীক নেতা কামাল আতাতুর্ক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন ১৯৩৮ সালের ১০ নভেম্বর।

সোনার গ্লাস, জগ,  ডলমাবাহচে প্যালেস

 

মোট ছয় জন সুলতানের আবসস্থল ডলমাবাহচে প্যালেসের দোতালা নিচতলার চেয়েও বেশি অভিজাত্যপূর্ণ ও বিলাসবহুল। দোতালায় নিচতলার মত হরেক অভ্যর্থনা কক্ষ, সুলতানের বসার ঘর বা খাবার ঘর। হারেম বা অন্দরমহলে প্রবেশ নিষেধ। তোপকাপি প্যালেসের মত এ প্রাসাদের হারেম দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত নয়। এমনকি রসুইঘর, কোষাগার বা অন্যান্য কক্ষও দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত নয়। দোতালার আসবাবপত্র আর ছাদ বা দেয়ালের নকশা আরো শৌখিন। সোফাসেট, ডাইনিং টেবল চেয়ার বা পিয়ানোতেও রয়েছে খানিক সোনার ছোঁয়া। প্রাসাদের যত্রতত্র ঘোরাঘুরি করার অবকাশ নেই। যে দিক থেকে নির্দেশনা দেয়া আছে সেদিক থেকে ঢুকে বের হয়ে যেতে হয়। সুলতানের বসার ঘরগুলো পেরিয়ে চলে এলাম প্রাসাদের আরেক অংশে যার ছাদ উন্মুক্ত। এর পরের কক্ষ সুলতানের হাম্মাম বা স্নানঘর। হাম্মামের ছাদে কাচের নকশা আর তাতে ঝারোখার মতো অসংখ্য নকশা। ঝারোখার ফোকর দিয়ে হাওয়া এসে ছুঁয়ে যায় সুলতানের হাম্মামের এলাবাস্টার খচিত অনন্যসাধারণ দেয়ালের খোদাই। রোদ এসে সে নকশার ওপর আরো নকশা কেটে যাচ্ছে। (চলবে)

 

**




ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়