ভূমিকম্প! ভূমিকম্প!! মুহম্মদ জাফর ইকবাল
মুহম্মদ জাফর ইকবাল || রাইজিংবিডি.কম
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
১.
সেদিন একজন এসে আমাকে জানাল, ভূমিকম্প নিয়ে নাকি ফেসবুকে তুলকালাম কাণ্ড হচ্ছে। ফেসবুকের কাণ্ডকারখানা নিয়ে আমি খুব বেশি মাথা ঘামাই না। তবুও জানতে চাইলাম তুলকালাম কাণ্ডটা কী রকম! যে খবর এনেছে সে আমাকে জানাল, নেপালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের পরেই আলোচনা হচ্ছে যে, ভূমিকম্পটা নাকি বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসছে। শিলিগুড়ি হয়ে সেটা নাকি যেকোনো সময়ে বাংলাদেশে ঢুকে দেশটাকে তছনছ করে দেবে। আলাপ-আলোচনায় শুধু আতঙ্ক আর আতঙ্ক।
শুনে আমার মনে হলো, ভূমিকম্প নিয়ে আমার কিছু একটা লেখা উচিত। আমি ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ নই কিন্তু আমি প্রায় পাঁচ বছর ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় ছিলাম। ছোট-বড়, মাঝারি অসংখ্য ভূমিকম্পের মাঝে টিকে থাকতে হয়েছে। তখন যে বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলো হয়েছে সেটা এখনো আমার কাজে লাগে। পিএইচডি শেষ করে আমি তখন পোস্টডক করার জন্য লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের কাছে ক্যালটেকে যোগ দিয়েছি, তখন প্রথমেই আমাকে জানিয়ে দেওয়া হলো, এটা ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। খুব কাছ দিয়ে বিখ্যাত (কিংবা কুখ্যাত!) সান এন্ড্রিয়াস ফন্ট লাইন গিয়েছে। সেখানে যেকোনো মুহূর্তে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার চেয়েও বড় একটা ভূমিকম্প হবে। কাজেই সব সময় সতর্ক থাকা ভালো। আমার ল্যাবরেটরির সামনেই আটতলা মিলিক্যান লাইব্রেরি। বিল্ডিংটা তৈরি করে সেটা নাকি ডানে-বাঁয়ে, সামনে পেছনে দুলিয়ে দেখা হয়েছে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করতে পারি কি না! পৃথিবীর সবাই ভূমিকম্পের মাত্রা মাপার রিখটার স্কেলের নাম শুনেছে। সেই স্কেলের নামকরণ হয়েছে ক্যালটেকের প্রফেসর রিখটারের নামে।
ভূমিকম্প নিয়ে কী কী সতর্কতা নেয়া উচিত শুনতে শুনতে আমিও সতর্ক থাকা শিখে গেলাম। বড় ভূমিকম্পে বিল্ডিং ধসে তার নিচে চাপা পড়ে মারা যাবার যেটুকু আশঙ্কা, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি আশঙ্কা আচমকা কোনো ছোটখাটো ভূামিকম্পে ওপর থেকে কোনো ভারী জিনিস মাথার ওপর পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলা। তাই দেখতে দেখতে আমি সতর্ক থাকার অভ্যাস রপ্ত করে ফেললাম। মাথার ওপরে কিছু রাখি না, ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি দেয়ালে হুক দিয়ে বেঁধে রাখি। তখন একটা টাইম প্রজেকশন চেম্বার তৈরি করছিলাম। তার ভেতরে বিশেষ আইসোটপের যে গ্যাস তার দাম ২৫০ হাজার ডলার। ভূমিকম্পে চেম্বার উল্টে পড়ে গ্যাস বের হয়ে গেলে সুইসাইড করতে হবে। তাই ওপর থেকে ক্রেন দিয়ে চেম্বার শেকল দিয়ে বেঁধে রাখি। আমার পুত্রসন্তানের বয়স তখন দুই বছর। সে বাসায় ঘুরে বেড়ায়। আচমকা ভূমিকম্পে তার ওপর শেলফ, আলমারি কিংবা টেলিভিশন পড়ে যেন না যায়, সেজন্য সবকিছু দেয়ালের সঙ্গে বেঁধে রাখি।
আমার এত সতর্কতা বৃথা গেল না। হঠাৎ একদিন ভোরবেলা রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হানা দিল। ভূমিকম্পের হিসেবে এটা মাঝারি, কিন্তু তার কেন্দ্র (এপি সেন্টার) ছিল খুব কাছে। তাই আমরা সেটা খুব ভালোভাবে টের পেলাম। ছোট ছেলেকে বগলে নিয়ে সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে ধরে দোতলা থেকে নেমে ছুটতে ছুটতে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি। বাড়িঘর কাঁপছে, মাটি কাঁপছে, পায়ের তলা দিয়ে পানির ঢেউয়ের মতো তরঙ্গ ছুটে যাচ্ছে- সব মিলিয়ে অতিবিচিত্র একটা অভিজ্ঞতা! আমি যথেষ্ট বিচলিত হলেও স্থানীয় মানুষেরা সেটাকে বেশি গুরুত্ব দিল না। আমাদের গ্রুপের ইঞ্জিনিয়ার বলল, ‘কাজে আসছি, হঠাৎ মনে হলো, গাড়ির টায়ারটা ফেটে গেছে। নতুন গাড়ি, মুডটা অফ হয়ে গেল। পরে দেখি একটা ফালতু ভূমিকম্প!’ এই হচ্ছে তাদের প্রতিক্রিয়া!
বড় ভূমিকম্প হলে পরের কয়েক দিন আফটার শক হিসেবে ছোট ছোট ভূমিকম্প হতে থাকে। পায়ের নিচে মাটি ক্রমাগত কাঁপছে। কাঠের বাসা, যত ছোট ভূমিকম্পই হোক সেটা গুটুর গুটুর শব্দ করে জানান দেয়। আমার দুই বছরের ছেলেটির তাতে মহা আনন্দ। সে উল্লসিত মুখে ছুটে এসে আমাকে জানায়, ‘গুডু গুডু! গুডু গুডু!’ আমি তার আনন্দে অংশ নিতে পারি না। মনে মনে শুধু হিসেব করি, এটি ছিল রিখটার স্কেলে মাত্র ৬ মাত্রার ভূমিকম্প, তাতেই এই অবস্থা! লস অ্যাঞ্জেলেসের বড় ভূমিকম্পটা হবে কমপক্ষে ৮ মাত্রার। অর্থাৎ ১ হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী। সেটা যদি আসে তাহলে কী অবস্থা হবে? (রিখটার স্কেলে এক মাত্রা বড় হওয়া মানে প্রায় ৩০ গুণ বড় হওয়া! কাজেই দুই মাত্রা হচ্ছে ১ হাজার!) আমি রাতে ঘুমাতে পারি না। নিদ্রাহীন চোখে বাসার ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকি। ছোট-বড় আফটার শকের গুটুর গুটুর শব্দ শুনি।
তখন ইন্টারনেট ছিল না (গুজব এবং আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য ফেসবুকও ছিল না) তাই আমি একদিন ক্যালটেকের বুকস্টোর থেকে ভূমিকম্পের ওপর লেখা একটা বই কিনে ফেললাম। মানুষ যেভাবে ডিটেকটিভ উপন্যাস কিংবা ভূতের গল্প পড়ে আমিও বইটা সমান আগ্রহে শেষ করলাম। অজানা-অচেনা রহস্যময় ভূমিকম্প নিয়ে আমার ভেতরে যে আতঙ্ক ছিল, সেটা দূর হয়ে গেল। আমি আবার নাক ডেকে ঘুমাতে শুরু করলাম। ভালো ঘুমের জন্য জ্ঞান থেকে বেশি কার্যকর আর কিছু হতে পারে না।
২.
ভূমিকম্পের বই পড়ে আমি প্রথম যে বিষয়টা জানতে পারলাম সেটি হচ্ছে, ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ৬ মাত্রার ভূমিকম্প থেকে ১ হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী তার অর্থ এই নয় যে, সেই ভূমিকম্পের তীব্রতা, কম্পন বা ঝাঁকুনি ১ হাজার গুণ বেশি! এর অর্থ ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয় অল্প জায়গা জুড়ে। ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয় অনেক বেশি জায়গা জুড়ে। আমাদের পায়ের নিচে শক্ত মাটি দেখে আমরা ধরে নিই ভূমি হচ্ছে স্থির। আসলে ভূমি স্থির নয়, সেগুলো নানাভাবে বিভক্ত এবং সেগুলো এদিক সেদিক নড়ছে। আমরা যে ভূমিখণ্ডের ওপর আছি তার নাম ইন্ডিয়ান প্লেট। সেটা বছরে দুই ইঞ্চি করে উত্তর দিকে এগোচ্ছে এবং উত্তরের ইউরেশিয়ান প্লেটে ধাক্কা দিচ্ছে। সেই ধাক্কায় মাটি উপরে উঠতে উঠতে হিমালয় পর্বত তৈরি হয়ে গেছে! সব প্লেটেরই একটা পরিসীমা বা বাউন্ডারি থাকে, এই বাউন্ডারিতে ধাক্কাধাক্কি চলতে থাকে তাই নিয়মিতভাবে এই বাউন্ডারিতে ভূমিকম্প হতে থাকে! সেই ভূমিকম্প এতই নিয়মিত যে, বিজ্ঞানীরা আজকাল মোটামুটি আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেন, রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয় আনুমানিক ১০ বছরে একবার। ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয় আরো বেশি। আনুমানিক প্রতিবছরে একবার। হিসেবটি মনে রাখা বেশ সোজা। ভূমিকম্পের মাত্রা এক কমে গেলে তার সংখ্যা বেড়ে যায় ১০ গুণ। অর্থাৎ ৭ মাত্রার ভূমিকম্প বছরে ১০টি, ৬ মাত্রার ভূমিকম্প বছরে ১০০টি, ৫ মাত্রার ভূমিকম্প বছরে প্রায় ১ হাজার, ৪ মাত্রার ভূমিকম্প বছরে ১০ হাজার। এর চাইতে ছোট ভূমিকম্পের হিসাব নিয়ে লাভ নেই, সেগুলো ঘটলেও আমরা টের পাই না।
কাজেই আসল কথাটা হচ্ছে বছরে পৃথিবীতে ছোট-বড় হাজার হাজার ভূমিকম্প হচ্ছে এবং সেগুলোর প্রায় বেশিরভাগ হয় পৃথিবীপৃষ্ঠের সঞ্চারণশীল ভূখণ্ডের পরিসীমায়। সেজন্য নেপাল, সিকিম, ভুটানে এত ঘন ঘন ভূমিকম্প হয়। কারণ আমাদের ভূখণ্ডের পরিসীমা বা ফন্ট লাইন এই দেশগুলোর ভেতর দিয়ে গিয়েছে। আমাদের কপাল অনেক ভালো যে সেই ফন্ট লাইন খুব যত্ন করে বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে নিচে নেমে গেছে। বড় ফন্ট লাইনটা বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে না গেলেও উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড়, তেঁতুলিয়ার খুব কাছ দিয়ে গিয়েছে। দূরত্ব ৫০ কিলোমিটার থেকে কম। তাই যখন এই ফন্ট লাইনে ভূমিকম্প হয় বাংলাদেশের অন্য জায়গা থেকে সেভাবে টের না পেলেও উত্তরবঙ্গের মানুষ ভালোই টের পায়। বড় ফন্ট লাইন থেকে ছোটখাটো অনেক শাখা-প্রশাখা বের হয় এবং আমাদের দেশে এরকম কিছু ফন্ট লাইন থাকতে পারে, সেখানে থেকে ভূমিকম্প হতেও পারে। ভূমিকম্পটি এমন একটি ব্যাপার যে, কোথায় হবে এবং কোথায় হবে না, সেটি কেউ কখনো জোর দিয়ে বলতে পারবে না। আমি গত ৪৫ বছরে আমাদের দেশের কাছাকাছি যে ভূমিকম্পগুলো হয়েছে সেটি ভালো করে লক্ষ করেছি, ইচ্ছে করলে পাঠকরাও এই ছবিটা দেখতে পারেন। ছবিটা এক নজর দেখলে যে-কেউ বুঝতে পারবে যে, আমাদের দেশের ভেতরে ভূমিকম্প হওয়ার থেকে অনেক বেশি আশঙ্কা আশপাশের দেশগুলোতে ভূমিকম্প হওয়া।(তবে বিশেষজ্ঞরা অবশ্য ভয় দেখাতে ভালোবাসেন। তারা সব সময় বলছেন, আমরা খুব ঝুঁকির মধ্যে আছি! আমি বিশেষজ্ঞ নই। তাই আমার কথা বিশ্বাস করার কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু ছবিটা এক নজর দেখলেই হবে।)
তবে যে ঝুঁকির কথা কেউ অস্বীকার করবে না সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের কাছাকাছি যে বড় ফন্ট লাইন আছে সেখানকার বড় বড় ভূমিকম্পের ধাক্কা সামলানো। দূরত্বের সাথে সাথে কম্পনের তীব্রতা কমে আসে। দ্বিগুণ দূরত্বে গেলে চার গুণ কম্পন কমে আসে। ১০ গুণ দূরত্বে গেলে ১০০ গুণ কম্পন কমে আসে। সেটা হচ্ছে আমাদের ভরসা। নেপালের ভূমিকম্পটি বাংলাদেশ থেকে যথেষ্ট দূরে ছিল, তার পরও আমরা সেটা খুব ভালোভাবে টের পেয়েছি। যদিও সেটি দেশে ধ্বংসযজ্ঞ তৈরি করার মতো কিছু ছিল না। যদি এটা আরো কাছাকাছি কোথাও হতো, যেমন- ভুটানের দক্ষিণে কিংবা আসামে তাহলে দেশে অনেক বড় অঘটন ঘটানোর মতো তীব্রতা হতেই পারত। (তবে ভূমিকম্পটি থেকে দূরে সরে গেলেই যে বিপদের আশঙ্কা কমে যায় তা নয়। ১৯৮৫ সালে মেক্সিকো সিটিতে ভূমিকম্পে প্রায় ৬৫ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। যদিও এপি সেন্টারটি ছিল প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দূরে। তবে এটি অবশ্য সেখানকার খুবই বিচিত্র এক ধরনের ভূখণ্ডের কারণে। আমি যত দূর জানি, আমাদের দেশের ভূপ্রকৃতি মেক্সিকোর মতো নয়।)
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পটি হয়েছিল চিলিতে ১৯৬০ সালে। রিখটার স্কেলে সেটি ছিল বিস্ময়কর ৯.৫! সেই ভূমিকম্পে প্রায় ৬ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। দেশটি তখন রীতিমতো পরিকল্পনা করে তাদের দেশের বিল্ডিং তৈরির নিয়ম মেনে ভূমিকম্প সহনীয়ভাবে বাড়িঘর তৈরি করতে শুরু করে। ২০১৪ সালে তাদের দেশে যখন ভয়ংকর ৮.২ মাত্রায় একটা ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে, তখন তাদের দেশে মানুষ মারা গিয়েছে মাত্র ৬ জন। নিয়ম মেনে বিল্ডিং তৈরি করলে কী লাভ হয়, এটি তার একটি চমৎকার উদাহরণ। এর থেকে প্রায় ৬০ গুণ ছোট ৭ মাত্রার একটা ভূমিকম্পের কারণে ২০১০ সালে হাইতিতে মানুষ মারা গিয়েছে প্রায় ৩ লাখ। দরিদ্র দেশে নিয়মনীতি না মেনে ম্যাচ বাক্সের মতো দুর্বল বিল্ডিং তৈরি করলে তার ফল কী হতে পারে, এটা তার একটা খুব করুণ উদাহরণ। কাজেই ভূমিকম্প নিয়ে কেউ যদি আমাকে একটা মাত্র মন্তব্যও করতে বলে, তাহলে কোনো রকম বিশেষজ্ঞ না হয়েও আমি খুব জোর গলায় বলতে পারব যে, ঘনবসতি এলাকাগুলোতে আমাদের বিল্ডিংগুলো নিয়মনীতি মেনে তৈরি করতে হবে।
৩.
ঠিক কী কারণ জানা নেই, ভূমিকম্প নিয়ে মানুষের ভেতরে এক ধরনের রহস্যময় আতঙ্ক কাজ করে। ভূমিকম্প শুরু হলেই মানুষ পাগলের মতো ছোটাছুটি শুরু করে। ২৮ এপ্রিল নেপালের ভূমিকম্পটির কারণে আমরা দেশে যে কম্পন অনুভব করেছি সেই কম্পনেই দেশের অনেক মানুষ দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছোটাছুটি করে আহত হয়েছে। কেউ কেউ মারাও গিয়েছে। ভূমিকম্পের খুঁটিনাটি জানার আগে আমি নিজেও যথেষ্ট ভয় পেতাম। এখন ভয় কমে গেছে, কৌতূহল বেড়েছে অনেক বেশি। দেশের সবার অন্তত দুটি জিনিস জানা উচিত। একটি হচ্ছে, যখন এখানে ভূমিকম্প হয় তখন সবারই ধারণা হয় তাদের পায়ের নিচে যে মাটি সেই মাটিতে ভয়ংকর অশুভ একটা কিছু শুরু হয়েছে। এর থেকে বুঝি আর রক্ষা নেই। মূল ব্যাপারটি মোটেও সেরকম নয়। প্রায় সব ক্ষেত্রেই ভূমিকম্পের কেন্দ্রটি বহু দূরে। সেখানকার ভূমিকম্পের ছোট একটা রেশ আমরা অনুভব করছি। ভয় না পেয়ে ঠান্ডা মাথায় এটা ঘটে যেতে দিলে কিছুক্ষণের মধ্যেই থেমে যাবে। আজকাল তথ্যপ্রযুক্তির যুগ, কিছুক্ষণের মধ্যেই ভূমিকম্পটির নাড়িনক্ষত্র ইন্টারনেটে চলে আসবে। ইউএসজিএস-এর একটা অসাধারণ ওয়েবসাইট রয়েছে (earthquake.usgs.gov) সেখানে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে ভূমিকম্প হলেই তথ্যটি কয়েক মিনিটেই চলে আসে। মজার ব্যাপার হচ্ছে ইউএসজিএস-এর এই ওয়েবসাইটটি খুলে বসে থাকলে কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা যাবে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও একটা ভূমিকম্প হয়েছে। আমরা যদি নিজের চোখে দেখি সারা পৃথিবীতে হাজার হাজার ছোট-বড় ভূমিকম্প হচ্ছে এবং পৃথিবীর মানুষ এর মাঝেই শান্তিতে দিন কাটাচ্ছে তাহলে আমার ধারণা আমাদের এই যুক্তিহীন ভয়টা অনেক কমে আসবে। ভূমিকম্প হলে কী করা উচিত তার কিছু নিয়মকানুনও ঠিক করা আছে, সেগুলো জানা থাকলেও ভালো। আর কিছু না হোক সেগুলো করার চেষ্টা করে একটু ব্যস্ত থাকা যায়!
ভূমিকম্প নিয়ে দ্বিতীয় আরেকটা বিষয় আমরা একটু চিন্তা করে দেখতে পারি। সেটি হচ্ছে এই দেশে ভূমিকম্পে মৃতের চেয়ে গাড়ি চাপায় মারা যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। গাড়ি চাপা পড়ে বছরে চার হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়। ভূমিকম্পের কারণে বছরে চারজন মানুষও মারা যায় কি না সন্দেহ। তার পরও ভূমিকম্প আমরা অসম্ভব ভয় পাই। কিন্তু গাড়িতে উঠতে বা রাস্তায় হাঁটাচলা করতে একটুও ভয় পাই না! শুধু গাড়ি দুর্ঘটনা নয়, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, এমনকি বজ্রপাতেও দেশে অনেক মানুষ মারা যায়। সেগুলো নিয়েও আমাদের কারো ভেতরে এতটুকু ভীতি নেই। কিন্তু ভূমিকম্প নিয়ে আমাদের অনেক ভয়! এই ভয় যুক্তিহীন। এটাকে লালন করে মনের শান্তি নষ্ট করার কোনো অর্থ নেই। পৃথিবীর সবাই জানে, লস অ্যাঞ্জেলেস এলাকায় যেকোনো মুহূর্তে একটা ভয়ংকর ভূমিকম্প হবে! আমি যখন লস অ্যাঞ্জেলেস এলাকায় ছিলাম, প্রায় প্রতিটি মুহূর্ত সেটার জন্য অপেক্ষা করেছি। তারপর পঁচিশ বছর পার হয়ে গেছে, এখনো সেই ভূমিকম্প ঘটেনি! কবে ঘটবে কেউ জানে না। কাজেই ভূমিকম্পকে ভয় পেয়ে কোনো লাভ আছে?
বরং এটা নিয়ে গবেষণা করে অনেক লাভ আছে। আমার ছাত্রছাত্রীরা তাদের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রজেক্ট হিসেবে ভূমিকম্প মাপার সিসমোগ্রাফ বানিয়েছে! অনেকগুলো বানিয়ে পুরো দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়ে আমরা ইচ্ছে করলে সারা দেশ চোখে চোখে রাখতে পারি। আমাদের দেশের ভেতরে কোথায় কোথায় ফন্ট লাইন আছে সেগুলো খুঁজে বের করতে পারি। ভূমিকম্পের আগে ভূমিকম্প হওয়ার সময় এবং ভূমিকম্প শেষে কী কী করতে হবে সেই বিষয়গুলো স্কুল কলেজের সব ছেলেমেয়েদের শেখাতে পারি। (সিলেট শহরের কেন্দ্রস্থলে এর ওপরে বিশাল একটা বিলবোর্ড ছিল, হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা সেটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিয়েছে। কারণ সেই বিলবোর্ডটিতে আমার একটা বিশাল ছবি ছিল!)
এই দেশে ভূমিকম্প নিয়ে অনেক গবেষণা করা সম্ভব। সত্যি কথা বলতে কি, কোনো রকম যন্ত্রপাতি ছাড়াই সিলেটে আমার ঘরে বসে একবার আমি খুব চমকপ্রদ একটা এক্সপেরিমেন্ট করে ফেলেছিলাম। পদ্ধতিটা জানা থাকলে অন্যেরাও সেটা চেষ্টা করে দেখতে পারে। আমি একদিন আমার অভ্যাস অনুযায়ী মেঝেতে বসে সোফায় হেলান দিয়ে কাজ করছি। হঠাৎ একটা ছোট ঝাঁকুনি টের পেলাম। আমার মনে হলো এটা সম্ভবত কোনো একটা ভূমিকম্পের পি ওয়েভ। আমি সাথে সাথে ঘড়ি দেখা শুরু করলাম। প্রায় ৩০ সেকেন্ড পার হওয়ার পর যখন কিছুই হচ্ছে না এবং আমি প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছি তখন হঠাৎ করে এস ওয়েভ এসে মূল ভূমিকম্প শুরু করে দিল। যখন আশপাশে ফ্ল্যাটের মানুষজন আতঙ্কে চিৎকার করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নামছে তখন আমি ঘরের ভেতরে বসে আনন্দে চিৎকার করে বলছি, ‘কোনো ভয় নেই! এই ভূমিকম্পের এপি সেন্টার ৩০০ কিলোমিটার দূরে!’ বলা বাহুল্য, নিজের আবিষ্কারে আমি নিজেই মোহিত!
ভূমিকম্প নিয়ে এখনো অনেক রহস্য অজানা। ভয় পেয়ে সেই রহস্য দূরে সরিয়ে না রেখে সবাই মিলে রহস্য ভেদ করাটাই কি বেশি অর্থপূর্ণ কাজ নয়? বাংলাদেশের মানুষ সব রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামলে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পারে- এই ভূমিকম্পকে কেন শুধু শুধু ভয় পাবে? প্রয়োজনে অবশ্যই আমরা এর মুখোমুখি হতে পারব।
বি.দ্র. : মুহম্মদ জাফর ইকবালের নিয়মিত কলাম (সাদাসিধে কথা) হিসেবে লেখাটি রাইজিংবিডি ডটকমে গত বছর ৮ মে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় লেখাটি পুনরায় প্রকাশ করা হলো।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ জানুয়ারি ২০১৬/তারা
রাইজিংবিডি.কম