ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

দুর্গম পথে খরস্রোতা খালের বাঁকে

ফেরদৌস জামান  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:২৫, ২২ ডিসেম্বর ২০২১  
দুর্গম পথে খরস্রোতা খালের বাঁকে

ঝিরির পরতে স্রোতের কলতান: সূচনা পর্ব

আপাতত গন্তব্য চন্দ্রপাড়া। কারবারী চন্দ্র ত্রিপুরার নামেই বসতির নামকরণ হয়েছে। সম্পর্কে চন্দ্র আমার দুই সহযাত্রী নূর ও শরিফ ভাইয়ের বন্ধু। তরুণ কারবারী চন্দ্র নিজেই নৌকার মালিক। ভাগিনাকে নিয়ে সে আগে থেকেই আমাদের প্রতীক্ষায় ছিল। মামা-ভাগিনার দক্ষ চালনায় খালের বুক চিড়ে নৌকা চললো উজানে।

নিরন্তর বয়ে চলা খাল কোনো কোনো বাঁকে ভীষণ খরস্রোতা। টালমাটাল নৌকা পাথরের আঘাতে যেন মুহূর্তেই টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। কয়েক মাস আগে হড়কা বান বয়ে গিয়েছে। তার সাক্ষী হয়ে খালের বুকে নুয়ে আছে মরা বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা। পাহাড়ের গায়ে পলিথিন এবং কাপড়ের টুকরোগুলোর ঝুলে থাকা দেখে অনুমান করা গেল বাণের স্রোত কতটা উঁচু দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। চন্দ্রের ভাষ্য- এমন বাণ জীবনে তার এই প্রথম দেখা।

চলতি পথে হঠাৎ দৃষ্টিগোচর হলো একদল উন্মুক্ত বানর। বৃক্ষের শাখায় শাখায় মুক্ত মনে খেলে বেড়াচ্ছে। তারই মাঝ দিয়ে অসম্ভব বাজে শব্দ করে এগিয়ে চললো আমাদের নৌকা। তাতে বানর দলের কোনো বিকার নেই। খাল ঢুকে গেল আরও গভীরে। দুই পাশে পাহাড়ের উচ্চতা বেড়ে ক্রমেই পৌঁছে গেল মেঘের কাছে। পাহাড়ের গায়ে সাদা মেঘ থমকে আছে, যেন বাতাসের ছোঁয়া পেলেই তুলার মত উড়ে যাবে অন্য কোথাও।

প্রায় দুই ঘণ্টা পর বিরতি দিলাম ছোট্ট এক বাজারে। ঘাট থেকে উঠে যাওয়া পাকা সিঁড়ির উপরে বাজার। হড়কা বাণের জ্বলজ্যান্ত সাক্ষী এই বাজার। মাত্র কয়েক মিনিটের বন্যায় ভেসে গিয়েছে সমস্ত দোকনপাট। কিছু কিছু দোকান ঘর নতুন করে আবারও দাঁড়িয়ে গিয়েছে। হাতে গোনা ছয় সাতটা দোকান। ওষুধ, তেল, লবণ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মধ্যে যা পাওয়া যায় তাতে আশপাশের কয়েকটা বসতির ভালোই চলে যায়। আধা ঘণ্টার বিরতিতে আমরা এদিক-সেদিক একটু দেখে নিলাম। 

ওদিকে কারবারী চন্দ্র ভিজিএফ কার্ডধারীদের মাঝে বিতরণের জন্য চালডালের হিসাব সেরে নিলো। এরপর বিশ মিনিটে পৌঁছে গেলাম তার পাড়ায়। খালের ধার ঘেঁষে পাহাড়ের গায়ে চন্দ্রপাড়া। তার বাড়িতেই আমাদের খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত। চন্দ্রের পরিবারের সাথে আমার সহযাত্রীদ্বয়ের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। শরিফ ভাই তো চন্দ্রের মাকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেন। 

ঘরের ছোট্ট জানালা দিয়ে খালের পুরো বাঁক দেখা যায়, কাঁশ বনের মাঝ দিয়ে বয়ে গিয়েছে ভাটির টানে। পাহাড়ি খালের এমন একটা বাঁকে পাড়ার অবস্থান, হলফ করে বলা যায় ভবিষ্যৎ ভালো। চন্দ্র জাতিতে ত্রিপুরা, তবে স্বভাবে আধা বাঙালি। সন্তানদের সদরের বিদ্যালয়ে আবাসিকে রেখে পড়ায়। সে তথাকথিত পাহাড়ি নয়, জুমে চাষ করে ফসল ফলানোর সময় নেই, কাজ করিয়ে নেয় দিন মজুর কামলা দিয়ে। তার মতে ফসল কেনাবেচার কারবার করেই বেশি লাভ। ওঠাবসা অনেকটাই বাঙালিদের সাথে। পাশাপাশি মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং ভবিষ্যতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে দাঁড়ানোর আশা রয়েছে। সে লক্ষ্যে প্রস্তুতিও চলমান। বয়সে তরুণ হলেও সে অন্য কারবারীদের মত নয়। ভিজিএফ এর চালডাল বিতরণে তার সরাসরি সম্পৃক্ততা। রাজনীতি করার সুবাদে এই প্রাধান্যটুকু পেয়ে থাকে, স্থানীয়ভাবে যাকে অনেক উঁচু দরের একটা বিষয় হিসেবে দেখা হয়। সোজা কথা সে সমাজের পিছিয়ে পড়াদের দলে থাকতে রাজি নয়। 

ছুরি মাছের শুঁটকি, কুমড়া আর মুরগির মাংসের ঝোল এবং শাক ভাজি দিয়ে ভাত। খাওয়ার পর একেকজনের অবস্থা অজোগর সাপের মত হয়ে গেল, যেন তিন মাস পর খাবার খাওয়া। সংক্ষিপ্ত বিশ্রাম-অন্তে সকলেই প্রস্তুত মূল অভিযাত্রার জন্য। চন্দ্রের পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নৌকায় গিয়ে বসে পড়লাম। আকাশের ভাব পরিস্থিতি সুবিধার মনে হলো না। পানতলি ঘাট থেকে চন্দ্রপাড়া পর্যন্ত পৌঁছতে  বৃষ্টির কবলে পড়তে হয়েছে কয়েকবার। ফলে আমার অতি যত্নের ছাতাটার বারোটা বেজে যাওয়া সারা! দুই পশলা বৃষ্টির অন্তর্বর্তীকালে ছাতাটা মেলে পাশে কাত করে রেখেছি, বাতাসে বাতাসে শুকিয়ে গেলে তারপর ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখব। অমনি এক স্রোতের ধাক্কায় চন্দ্রের উশৃঙ্খল ভাগ্নেটা দড়মড় করে চিৎ হয়ে পড়ল আমার ছাতার উপর। উভয়েরই জান শক্ত। তা না হলে দুটোকেই পথে ফেলে আসতে হতো।

যাই হোক, আকাশ দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ সাদা ফকফকা, অন্য ভাগ কালো মেঘে ঢাকা। বৃষ্টির আশঙ্কা উড়িয়ে না দিয়ে চন্দ্র নৌকার হাল ধরল। এরই মধ্যে আকাশের কালো অংশ আমাদের পিছু ছুটতে ছুটতে মাথার উপর দিয়ে এগিয়ে গেল আরও সামনের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রকৃতির রূপ ও রং উভই বদলে গেল। সবুজ হয়ে উঠল আরও সবুজ। চারপাশজুড়ে নেমে এল ভুতুরে নিস্তব্ধতা। অথচ, যা কিছু দৃশ্যমান তার সবকিছুতে যেন কিসের তাড়াহুড়ো! 

আবহাওয়ার পূর্বাভাসস্বরূপ সতর্ক করে চন্দ্র বললো, নৌপথ ফুরাবার আগেই বৃষ্টি নামবে। ঠিক তাই, দুই মিনিটের মধ্যেই আকাশ এক অসংবদ্ধ প্রলাপে মেতে উঠল। সম্মুখেই বড়ই পাড়া, যেখানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা চাকমা জনগোষ্ঠীর বাস। প্রবল বৃষ্টি মাড়িয়ে আশ্রয় মিললো ছোট্ট একটা ঘরে। বর্ষায় তাদের বেরোবার সুযোগ নেই। অতএব, ঘরে বসে টুকরী, ডালা জাতীয় বিভিন্ন তৈজসপত্র এবং কৃষি উপকরণ বানানো অথবা তাঁতে কাপড় বোনাই কাজ। ঘরে আবদ্ধ হয়ে আছে তামাকের উৎকট গন্ধ। তা যেন বের হওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। কয়েক মিনিটেই মাথা গুলিয়ে উঠল। বৃষ্টি কখন ছেড়ে যাবে অপেক্ষা করতে গেলে তামাকের উৎকট গন্ধে নির্ঘাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে হবে। অগত্যা বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বেরিয়ে পড়তে হলো।

আবারও সেই খাল। সারাটা পথই খালের সর্পিল মানচিত্র। কে জানে কতবার এপাড় ওপাড় করতে হবে। বৃষ্টির দাপটে ইতোমধ্যেই খালের বুকে নেমেছে নতুন পানি। পানির উচ্চতার সাথে সাথে স্রোত বেড়ে গেল কয়েক গুণ। কঁচিকাচার দল আনন্দ-স্নানে মাতোয়ারা। অপরিচিত মানুষের উপস্থিতি তাদের আনন্দ উল্লাসে যুক্ত করল নতুন মাত্রা। স্ব-উদ্যোগে দেখিয়ে দিলো খাল পার হওয়ার নিরাপদ জায়গা কোনটি হবে। সহায় সম্বল মাথায় নিয়ে তাদের নির্দেশিত জায়গা দিয়ে পার হওয়ার পর ছোট্ট বালুকাবেলা পেরিয়ে আবারও খাল। খালের সারা দেহে ছড়িয়ে থাকা নানা আকৃতির পাথর খণ্ডগুলোই আমাদের চলার পথ। হঠাৎ কোনো এক বাঁক থেকে দেখা দিলো রুপালি রঙের জলের ধারা। পাহাড়ের সবুজ দেয়ালে ফুটে উঠা ঝরনার নাম কি তা ঠিক জানা হয়ে উঠল না। 

ঝরনার কাছাকাছি গিয়ে খাল বাঁক নিয়েছে হালকা বামে, আর সেখানেই আমাদের আপাতত শেষবারের মত এপাড় থেকে ওপাড়ে যাওয়া। স্রোত পাথরে আছড়ে পড়ে নিরন্তর বয়ে চলা খালের বুকে সৃষ্টি করছে এক উদ্দাম নৃত্য। শরিফ ভাইকে নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। কারণ তিনি সাঁতার জানেন না। তার সব থেকে বড় শক্তি মনোবল। তা বোধহয় আমাদের চেয়েও কয়েক গুণ বেশি। আর এই মনোবলের উপর ভর করেই দীর্ঘ দিন চষে বেড়াচ্ছেন পাহাড় পর্বতের আনাচে কানাচে। স্রোত ঠেলে ওপাড় গেলেই চোখের সামনে ঝরনা। পতন মুখ থেকে মাত্র কয়েক গজ গড়িয়ে এসে মিশেছে খালের বুকে। 

ঝরনার বাম পাশ দিয়ে একটা পথ উঠে গিয়েছে ঠিক পাহাড়ের মাথায়। তারপর হাজিরাংপাড়া নামক বসতি পাশে রেখে এগিয়েছে সামনের দিকে। পাহাড়ে ধান কাটার ধুম, তাই হাজিরাং পাড়ায় একজন মানুষেরও দেখা মিলল না। পুরো পথ ছনের লকলকে পাতার সমারোহে মিশে একাকার। বিগত দুই-তিন মাসে একজন মানুষেরও পা পড়েছে বলে মনে হলো না। শুধু চলছি আর চলছি। কিন্তু পথ শেষ হওয়ার নাম নেই। এক পর্যায়ে তো মনে হলো- এ পথ কোনো দিনই শেষ হবার নয়।

বেশ কিছুক্ষণ পর পথের প্রান্তে হঠাৎ আলোর মত দেখা দিল কয়েকটা ঘরের ছোট্ট বসতি রেম্বুকপাড়া। সেখানেও কোনো মানুষে দেখা নেই। ঘুরে বেড়াচ্ছে কিছু উন্মুক্ত শূকর। মাদি শূকরটার বুক থেকে মাটির কাছাকাছি ঝুলে পড়েছে নিরস চার জোড়া স্তন। সেই লোভে কেউমেউ করে পিছু ছুটছে এক দল শাবক। এমন নিদারুণ দৃশ্য বসতিটাকে যারপর নেই সুন্দর করে তুলেছে। ধরণীর সমস্ত ক্লেশ কি রেম্বুকপাড়ার উপর দিয়েই বয়ে গেছে? 

দুর্গম পথের পর আলোর দেখা পেলাম বলে খুশি হয়েছিলাম। অথচ, দুই মিনটও লাগল না, মনে হলো যত দ্রুত সম্ভব বিদায় হই কিন্তু শরীর তো মানতে চায় না। বসতির মধ্যখানে ছাউনি দেয়া উঁচু একটা মাচা। চারপাশ নিরাপত্তা বেষ্টনিতে আবদ্ধ। ভেতরে ঢোকর জন্য ছোট্ট একটা দরজা কিন্তু তা আবার দড়ি দিয়ে বাঁধা। বিশ্রামের জন্য একটুখানি বসা ঠিক হবে কিনা এমন ভাবনা চিন্তা শেষ না হতেই সম্মুখের ঘর থেকে ধির কদমে নেমে এলেন মাথার চূড়ায় ঝুটি বাঁধা এক যুবক। যুবকের কাখালে একটা ন্যাংটা শিশু আর পিছে পিছে এক দল শূকর। এগিয়ে এসে যা বললেন তার মাঝ থেকে শুধু এতটুকু বোঝা গেল- বসতে মানা নেই। (চলবে)

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়