ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

সাইকেলে চড়ে রামনাথের বানিয়াচং

হোমায়েদ ইসহাক মুন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৪, ১১ অক্টোবর ২০২২   আপডেট: ১৭:৩৬, ১১ অক্টোবর ২০২২
সাইকেলে চড়ে রামনাথের বানিয়াচং

দীর্ঘ ১৬ বছর পরে রওনা হয়েছি বানিয়াচংয়ের পথে। যেখানে বাংলার প্রথম ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি। শত বছর আগে যিনি পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছেন সাইকেলে চড়ে। আমরাও তাঁর অনুপ্রেরণা নিয়ে সাইকেলে যাচ্ছি বিদ্যাভূষণ পাড়ায়, রামনাথের বাড়িতে।

ভূ-পর্যটক ও ভ্রমণ লেখক রামনাথ বিশ্বাস জন্মেছিলেন ১৮৯৪ সালে,  এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচংয়ের বিদ্যাভূষণ পাড়ায়।  লিখেছেন ৩২টি ভ্রমণ বিষয়ক বই। ২০০৬ সালে তার বসতভিটা দেখতে গিয়েছিলাম। এবার যাচ্ছি তার বসতভিটা উদ্ধারের প্রয়াসে। রামনাথ বিশ্বাস ১৯৪৭ এর পরে এই প্রিয় গ্রাম ছেড়ে কলকাতা চলে যান, সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। রামনাথ বিশ্বাস পৃথিবী পরিভ্রমণ করে এসে বলেছিলেন: ‘বাইন্নাচুং আমার দুইন্যাই।’

এরপর তার বড় ভাই কৃপানাথ বিশ্বাস এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা এই গ্রামে বসবাস করেছেন।পরবর্তী সময়ে তারাও কলকাতা পাড়ি জমান। এরপর স্থানীয় এক দখলদার বহু বছর থেকে রামনাথের বসতভিটায় নিজের জায়গা করে নিয়েছে। সম্প্রতি রামনাথের বাড়ি দেখতে গিয়ে সাংবাদিক রাজীব নূরসহ বেশ কয়েকজন দখলদারদের হামলার  শিকার হন। তারপরই তোলপাড় শুরু হয়। অনেক লেখালেখি হয়েছে ইতোমধ্যে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে। রামনাথকেও সবাই চিনতে শুরু করেছে। এই গ্রামে এমন গুণীজনের  স্মৃতিতে একটি পাঠাগার এবং বাইসাইকেল জাদুঘরের দাবি উঠেছে। 

আমরা সবাই এর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলাম। যারা নিয়মিত সাইকেল চালাই, দেশে বিদেশে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি, আমরা সবাই একত্রিত হলাম হবিগঞ্জ টাউন হলের সামনে। ডিসি মহোদয় আমাদের আশ্বস্ত  করলেন কিছু একটা এবার হবে। সরকার রামনাথের বাড়ি পুনরুদ্ধারের জন্য কাজ করবেন। আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেবেন  'ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কমিটি'র সদস্যরা। কমিটির আহ্বায়ক ভূপর্যটক ও লেখক আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল। যুগ্ম আহবায়ক কবি শাহেদ কায়েস ও কথাসাহিত্যিক রুমা মোদক।

উজ্জ্বল ভাই আমাদের এ কালের রামনাথ। তাঁর  অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশটা শুধু ঘুরতে বাকি রয়েছে। বাকি মহাদেশগুলোর মধ্যে ৬০টি দেশ ভ্রমণ করেছেন, তার মধ্যে ৩৫টি দেশ তিনি ঘুরেছেন শুধু সাইকেলে চড়ে। উজ্জ্বল ভাই নিজেও রামনাথের  বিশ্বভ্রমণে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং তিনিই আমাদের তাঁর সম্পর্কে জানান। এরপর রামনাথের বাড়ি ঘুরে এসে আমরা লেখালেখি শুরু করি। ‘দেশে বেড়াও দেশের মানুষ' খণ্ড-১ রামনাথ বিশ্বাসকে উৎসর্গ করা হয়। বইটি বের করে 'বাংলাদেশ টুরিজম এক্সপানশন ফোরাম' সংক্ষেপে বিটিইএফ নামে এদেশের আদি ভ্রমণ দল। 

গত ২৭ সেপ্টেম্বর ছিল বিশ্ব পর্যটন দিবস। এটাই উত্তম সময় রামনাথকে পুরো দেশের মানুষের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার। দুঃখজনক হলো কলকাতায় রামনাথ বিশ্বাস নামে লেন আছে, তাঁর নামে পুরষ্কার দেওয়া হয় অথচ এ দেশের সাইক্লিস্টরা তাঁর ব্যাপারে তেমন কিছুই জানেন না। অন্যদের কথা নাই বা তুললাম। পর্যটন দিবসে ঠিক হলো আমরা দেশের সব প্রান্ত থেকে সাইক্লিস্টরা যাবো বিদ্যাভূষণ পাড়ায়। দূরত্ব  ২২ কিলোমিটার। সকাল ১০টায় জড়ো হতে শুরু করলো হবিগঞ্জ, নবিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ঢাকা, দিনাজপুর, নড়াইল থেকে আগত রাইডাররা। আমি একদিন আগে পারাবত এক্সপ্রেসে শায়েস্তাগঞ্জ পৌঁছে সিএনজি অটোরিকশায় হবিগঞ্জ চলে আসি। আমার সঙ্গী হয় মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আকাশ আর মাসুদ। তাদের এমন আয়োজনের  কথা বলতেই রাজি হয়ে যায়। রামনাথ সম্পর্কে তাদেরও বেশ কৌতূহল রয়েছে। তারা অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে আমাদের সাইকেল র‌্যালিতে   ভলান্টিয়ারিং করবে। আগেরদিন বিকেলে আমরা তাসনুভা শামীম ফাউন্ডেশনের জামাল ভাইয়ের সাথে পথ শিশুদের জন্য কিছু খাবার বিতরণ কাজে সহায়তা করি।

সকালবেলা নবিগঞ্জের তারেক আমার জন্য বৃন্দাবন কলেজের এক ছোট ভাইয়ের সাইকেল ধার করে এনে দিলো। তারেকের সাথে পরিচয় এক যুগ আগে ২০১০সালে সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত 'ক্লেমন রাইড ফর গ্রিন' রাইডে। সবাইকে 'আমিই রামনাথ' লেখা সাদা টিশার্ট বিতরণ করা হলো। বলে দেওয়া হলো, ১০কিলো পরে রত্না নদীর উপরে বেইলি সেতু্র সামনে থামতে। হালকা নাস্তা পানির ব্যবস্থা আছে। তপ্ত দুপুরে সবাই সাইকেল চালানো শুরু করে দিলাম। রত্না ব্রীজের কাজ চলছিল তাই সাইকেল নিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম। অন্যদের বেশ সময় লাগলো ব্রিজ পার হতে। সাইকেল চালানোর সময় পরিচয় হলো হবিগঞ্জ সাইকেলিং ক্লাবের সদস্য আশরাফুলের সাথে। বৃন্দাবন কলেজে একাউন্টিং বিভাগে চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। সাইকেল র‌্যালিতে আসার আগে সে তেমন কিছুই জানতো না রামনাথ সম্পর্কে। এখানে আসার পরে রামনাথকে জানার আগ্রহ তৈরি হয়েছে এবং তাঁর বই সংগ্রহ করে পড়বে বলে জানালো। নাকিবও একই ক্লাবের সদস্য, বয়সে আরো তরুণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রস্তুতি নিচ্ছে। সাইকেল তাদের জন্য অন্যরকম এক নেশা। সুযোগ পেলেই ছুটে চলে দূর-দূরান্তের পথে। রামনাথের কথা তেমন কিছুই জানে না তারা। এখন তাদের মনেও আরো উৎসাহ উদ্দীপনা আর কৌতূহল দেখতে পেলাম। 

হবিগঞ্জ থেকে বিশজন সাইক্লিস্ট এসেছে র‌্যালিতে অংশ নিতে। নাকিবের থেকেও ছোট রাব্বি, ক্লাস টেন-এ পড়ে। কুমিল্লা থেকে সাইকেল চালিয়ে চলে এলো হবিগঞ্জ। আমাদের গল্প বলল, মায়ের ব্যগ থেকে না বলে ১০০টাকা নিয়ে বের হয়েছে, আর বন্ধুদের থেকে আরো ১৫০টাকা খুঁজে নিয়েছে। এরপর হবিগঞ্জ পৌঁছে আবার মাকে বলেও দিয়েছে একশ টাকা চুরির কথা। কথা শুনেই মনে হলো বেশ উচ্ছ্বসিত সে। ইফাজ তাদের দলনেতা, কুমিল্লা সাইক্লিং ক্লাব থেকে তারা এসেছেন ৪জন। জিজ্ঞেস করতেই বলল, পথে কোন অসুবিধা হয়নি, ওদের উৎসাহ দিয়ে গাইড করে এখান পর্যন্ত চলে এসেছি। ইরফান তাদের দলে সবচেয়ে ছোট, ক্লাস নাইনে পড়ে। প্রথম প্রথম বাসা থেকে সাইকেল নিয়ে দূরে গেলে বেশ ঝামেলা করত। বেশ কিছু লম্বা দূরত্বে রাইড দিয়ে তার এখন আত্মবিশ্বাস এসেছে। রামনাথ সম্পর্কেও সে বেশ উচ্ছ্বসিত। র‌্যালি শেষ করেই আবার চালিয়ে ফিরে যাবে কুমিল্লা। এই অল্প বয়সে ইরফানদের লম্বা দূরত্বে চালাবার যে অভিজ্ঞতা হলো, এক সময় এরাইতো রামনাথের মত সাইকেলে করে পৃথিবীর পথে বেড়িয়ে পড়বে। শুধু দরকার প্রবল ইচ্ছাশক্তির। নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছেন কারিসমা খুরশীদ। নভেরা নামে নারায়ণগঞ্জে মেয়েদের সাইকেল গ্রুপের প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি। তার মেয়ে এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে, তা সত্ত্বেও নিজেকে আর আটকে রাখতে পারেননি। হবিগঞ্জ রাইডে চলে এসেছেন। বললেন, ‘আমার একটাই নেশা সাইকেল চলানো, তাই চলেই এলাম।’

বানিয়াচংয়ের রাস্তাটা সরু চলে গেছে দুই পাশের বিলের মাঝখান দিয়ে। মাঝে মাঝে রাস্তায় বড় গাছের সারি, তাতে কড়া রোদে শীতল ছায়ার মৃদু সস্তি। হাওড় ও বিলে ছোট ছোট সাদা শাপলা শালুক। চোখের বড্ড আরাম। ইচ্ছে হচ্ছিল সাইকেল থামিয়ে কিছুক্ষণ বসে যাই। কোশা নৌকায় করে জেলেরা মাছ ধরছে। বিকেলে ফেরার পথে তাজা মাছের দেখাও পেলাম। আজমেরিগঞ্জের রাস্তাটা দেখে আমাদের পুরনো দিনের ভ্রমণের কথা মনে পড়ে গেলো। ভৈরব থেকে বিশাল নৌকায় করে আজমেরিগঞ্জ হয়ে আমাদের ভ্রমণের দল বানিয়াচং এসেছিলাম। এরপর মুন সিনেমাহলের মাঠে তাবু গেড়ে থেকেছি। স্কুল ঘরে রান্না করেছিলাম রাত অব্দি। বানিয়াচং শহীদ মিনার পার হয়ে রামনাথের বাড়িতে সবাই গিয়ে জড়ো হলাম। ছবি তোলা হলো। দখলদারকে দেখলাম দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে আমাদের কর্মকাণ্ড। প্রশাসনের লোকবল সেখানে উপস্থিত ছিল। 

এদিকে শহীদ মিনারে প্রতীকী অনশনে বসেছিলেন সাংবাদিক দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু, ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাস ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু চৌধুরী, সাংবাদিক মোশাহেদ, প্রাক্তন চেয়ারম্যান মোঃ আলী মোমিন প্রমুখ। সমকালে লেখালেখি করার সময় থেকে বিষ্ণুদার সাথে পরিচয়। আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন। আমরা তার অনশন ভাঙালাম। ইউএনও এবং আরো বিশিষ্টজনরা কথা বললেন, সবাই রামনাথের বসতভিটা পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে সচেষ্ট। 

শেষ হলো কর্মসূচি। ফিরতি পথে বিকেলটা ছিল মোহনীয়। হাওড়ে সূর্য ঢলে পড়ছে, আমাদের সাইকেলও এগিয়ে চলেছে। ধার করা সাইকেল  ফেরত দিয়ে হবিগঞ্জ সার্কিট হাউজে চলে এলাম। রামনাথের বাড়ি থেকে ফিরে আসার সময় বারবার বলেছি, ‘হে রামনাথ বিশ্বাস! আমাদের তোমার স্মৃতি দাও। সেই গল্প বলো যা আমাদের শক্তি দেবে। পৃথিবীটা দেখার বড় শখ।’
 
লেখক: কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স এসোসিয়েশন

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়