ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

নবম পর্ব

দোগারি পর্বতে বাংলাদেশের প্রথম অভিযান

 ইকরামুল হাসান শাকিল  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:২৬, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১৯:২৭, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
দোগারি পর্বতে বাংলাদেশের প্রথম অভিযান

ছোট একটি গ্রামের আগে স্থানীয়দের গাছের গুঁড়ি দিয়ে বানানো একটি ব্রিজ ছিল। এর উপর দিয়েই গাড়ি চলাচল করতো। পানির স্রোত আর পাহাড়ি ধ্বসে ব্রিজটি ভেসে গেছে। মানুষ এখন চলাচলের জন্য একটি মাত্র লম্বা গাছের গুঁড়ি ফেলে রেখেছে। তার উপর দিয়েই একে একে আমাদের পেরিয়ে আসতে হলো। 

রাস্তার দুই পাশে মাত্র পাঁচ-ছয়টা পরিবারের বাস। ছোট বাচ্চারা রাস্তার মধ্যেই খেলছে। ছোট একটি দোকান পেলাম। মুহিত ভাই বললেন, এখানে চা বিরতি হোক। সবাই সেই দোকানের ভিতরে বসার জন্য আলাদা একটি রুমে গিয়ে বসলাম। দশ-বারো বছরের এক মেয়ে দোকান চালাচ্ছে। সে আমাদের সবাইকে আদা দিয়ে রঙ চা করে দিলো। কিলু আর নিমা দোকানের ভিতরে বসে মেয়ের সাথে গল্প করছে। কিছু সময় পর কিলু এসে জিজ্ঞেস করল, তোমরা ফুচকা খেতে চাও? মেয়েটা ফুচকাও বিক্রি করে। মুহিত ভাই প্রথমে এক প্লেট ফুচকা দিতে বললেন। একটা প্লেটে সুন্দর করে সাজিয়ে এক প্লেট ফুচকা নিয়ে এলো। আমরা সবাই খেলাম। বাহ, এই উচ্চতায় ছোট্ট একটি গ্রামে ফুচকাও পাওয়া গেল। খেতেও খারাপ হয়নি। মুহিত ভাই আরো এক প্লেট দিতে বললেন। 

পাহাড়ে সন্ধ্যা খুব দ্রুতই নেমে আসে। তাই বেশি সময় আর বসা গেল না। আমরা আবার ট্রেকিং শুরু করলাম। এই পর্যন্তই গাড়ির রাস্তা। এর পরে আর রাস্তা নেই। গ্রাম থেকে বেরিয়ে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। আমাদের সঙ্গে পোর্টার আছে যারা আমদের প্রয়োজনীয় মালামাল বহন করছে। জঙ্গলের ভিতরে একটু ফাঁকা জায়গা পাওয়া গেল। সেখানে সবাই বসে বিশ্রাম করছি। এমন সময় তামটিং শেরপা পেছন থেকে এসে বলল, আস গুরুংসহ কিচেন স্টাফ এখনো এসে পৌঁছায় নাই। তারা পেছনে ফেলে আসা গ্রামে আজ রাতে থাকবে। সামনের যে গ্রাম আছে রাতের অন্ধকারে সেখানে গিয়ে পৌঁছানো সহজ হবে না। সামনের পথ ঝুকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক।

তামটিং শেরপা মুহিত ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন সামনে যাবে নাকি পেছনে ফিরে যাবেন। মুহিত ভাই, কিলু এবং তামটিং পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন আমরা আর পেছনে ফিরে যাব না। পেছনে যারা আছে তারা কাল সকালে আসবে এবং আমরা সামনে এগিয়ে গিয়ে মাইকোটে রাতে থাকবো। পোর্টাররা আমাদের আগেই রওনা দিয়ে দিলো। আমরাও একটু দ্রুত গতিতে হাঁটতে শুরু করলাম। জঙ্গলের ভিতরে বড় একটি পাহাড় ধ্বস হয়ে পুরো এলাকা একদম নদীতে নেমে গেছে। একে অপরের হাত ধরাধরি করে বিকল্প রাস্তা তৈরি করে এই বিপজ্জনক জায়গাটি পেরিয়ে নদীর পাড়ে নেমে এলাম। নদীর পাড় ধরেই অনেকটা পথ আসার পর একটি ঝুলন্ত ব্রিজ পেলাম। ব্রিজ পেরিয়ে লম্বা খাড়া চড়াইয়ে উঠে এলাম। এখান থেকে মাইকোট গ্রামটির কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে দেখেই বুঝতে পারলাম গ্রামে বিদ্যুৎ আছে। যেহেতু সন্ধ্যা হয়ে গেছে তাই গ্রামের বৈদ্যুতিক লাইটের আলো দেখা যাচ্ছে। 

এখন আর চড়াই নেই। পথটা প্রায় সমতল। রাস্তাটি পাহাড়ের গা বরাবর সোজা চলে গেছে গ্রামে। আমরা আমাদের রুকস্যাক থেকে হেডটর্চ বের করে মাথায় পরে নিলাম। লাইটের আলোতে ধীরে ধীরে গ্রামে চলে এলাম। গ্রামে প্রবেশের আগে অল্প একটু পথ উপরে উঠে একটি গেইট পেয়ে গেলাম। এখানে দাঁড়িয়ে আছি সানভি ভাইয়ের জন্য। তিনি আমাদের থেকে সামান্য একটু পেছনে। পোর্টারদের মধ্যে একজন পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছে। তাই তাকে এগিয়ে আনতে দুইজন পোর্টার আবার নিচে নেমে গেল। আমরা গ্রামের ভিতরে ঢুকে সরু গলি পথ হাঁটছি। রাতের অন্ধকারে বৈদ্যুতিক আলোতে গ্রামটিকে দেখতে দারুণ লাগছে। তবে পুরো গ্রামটি ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। এদিকে শরীর ভীষণ ক্লান্ত সবার। একটি বাড়িতে ঢুকলাম। বাড়িটি লজ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। 

মাইকোট গ্রামটি বেশ বড়। পাহাড়ের রিজ লাইনের উপরে লম্বা আকৃতির গ্রাম। এখানে যেমন অন্যসব গ্রামের মতো পুরনো বাড়িঘর আছে তেমনি রড সিমেন্টের দুই তলা, তিনতলা বাড়িও আছে। আমরা যে লজে উঠেছি সেটা তিনতলা। নিচ তলায় মুদির দোকান। দ্বিতীয় তলায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। আমাদের যে রুমটি দেওয়া হলো সেখানে দুইটি ডাবল বেড। আমরা চারজন এক রুমেই আছি। পাশের রুমে নেপালী চার শেরপা। পোর্টাররা অন্য রুমগুলোতে উঠেছে। একদম উপরে রান্না ঘর আর খাবারের জায়গা। ছাদের অর্ধেক অংশ ফাঁকা আছে। এই ফাঁকা অংশে একটা বেঞ্চ রাখা আছে। যেখানে খোলা আকাশের নিচে বসে পুরো গ্রাম দেখা যায়। প্রথমেই আমি বাড়িটির নিচ থেকে উপর পর্যন্ত ঘুরে দেখলাম। 

গায়ে থাকা ঘামে ভেজা পোশাক পরিবর্তন করে শুকনা পোশাক পরলাম। তরপর সবাই ছাদে চলে এলাম। ডাইনিং রুমের টেবিলের উপরে বড় এক ফ্লাক্সে আদা চা রাখা আছে আমাদের জন্য। কিলু আমাদের সেখানে নিয়ে এসে চা খেতে বললো। আমার নিজেদের মতো করে মগে চা নিয়ে ছাদের খোলা অংশে চলে এলাম। পুরো গ্রামটা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যে জোনাকির মিটমিট করে জ্বলছে বৈদ্যুতিক আলো। গ্রামটা নিচের দিকে নেমে গেছে। আমরা প্রচণ্ড শীতের মধ্যেই খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে চা পান করছি আর গল্প করছি। আমাদের কিচেন স্টাফ আজ নেই। তারা সকালে এসে পৌঁছাবে। তাই এই লজেই খাবারের ব্যবস্থা হচ্ছে। লজের মালকিন নিজের আমাদের জন্য রান্না করছেন। সাথে কিলু, তামটিং, নিমা আর আংডু সাহায্য করছে। 

রান্না শেষ হতে হতে আমরা পুরো ফ্লাক্সের চা শেষ করে ফেললাম। গরম গরম ধোঁয়া উঠা ভাত, ডাল, সবজি আর মুরগির মাংস প্লেটে সাজিয়ে এনে টেবিলে রাখলেন। আমরাও পেট ভর্তি ক্ষুধা নিয়ে খাবার খেতে বসে গেলাম। মুহিত ভাই নিমাকে দুইটা কাঁচামরিচ কুচিকুচি করে কেটে আনতে বললেন। হিমালয়ে যতো উপরের দিকে উঠতে থাকবে খাবারের রুচি ততো কমতে থাকে। অতি সুস্বাদু খাবারও তখন খেতে ইচ্ছে করে না। খাবারের সাথে টক বা ঝাল কিছু হলে খেতে ভালো লাগে। নিমা ছোট একটি বাটিতে মরিচ কেটে এনে দিলো। সবাই সেই কাটা মরিচ নিয়ে খেতে লাগলাম। বাড়ির মালকিনের হাতে রান্না বেশ স্বাদ হয়েছে। এই কথা আমার না, মুহিত ভাই আর সানভি ভাইয়ের কথা। আমি আবার খাবারের স্বাদ তেমন বুঝতে পারি না। খাবার শেষে আমরা আমাদের পানির বোতলে গরম পানি নিয়ে নিলাম রাতের জন্য। কিছু সময় এখানেই গল্প করে সবাই সবার রুমে চলে এলাম। আগামীকাল আমাদের এ্যাক্লিমাটাইজেশনের দিন। আমরা এখানে একদিন বিশ্রাম করবো। আবহাওয়ার সাথে শরীরকে মানিয়ে নিতে। ভোরে উঠেই ট্রেকিং শুরু করতে হবে এমন কোনো তাড়া নেই। তবে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমানোর সুযোগ নেই। তাই দ্রুতই ঘুমিয়ে গেলাম। 

ভোর ছয়টা নাগাদ ঘুম ভাঙলো বিপ্লব ভাইয়ের ডাকে। বিপ্লব ভাই আমাদের সবাইকে ডেকে তুললেন। যদিও তিনি নিজেই কম্বলের ভিতর থেকে এখনো বের হননি। আমি উঠে গিয়ে বিপ্লব ভাইয়ের গায়ের উপর থেকে কম্বল সরিয়ে টেনে বিছানা থেকে নামালাম। সবাই বিছানা ছেড়ে ছাদে কিচেনে চলে এলাম। এখানে এসে দেখি টেবিলের উপরে আমাদের জন্য চা রাখা আছে। আমরা চা পান করে নিচে নেমে এলাম। অনেক ঠাণ্ডা পড়েছে। তাপমাত্রা দুই-তিন হবে। গরম গরম চা পানের পর শরীর বেশ চাঙ্গা হয়েছে। আমার এবার গ্রাম ঘুরে দেখতে বের হলাম। গ্রামের মানুষজন ভোরেই ঘুম থেকে উঠে কাজে বেরিয়ে পড়েছে। এই গ্রামের প্রধান শস্য ভুট্টা। পাহাড়ের ঢালে তারা ভুট্টা চাষ করে। জমি থেকে প্রায় সব ভুট্টাই তুলে এনেছে। এখন প্রতিটি বাড়িতেই ভুট্টার বড় বড় স্তুপ। শুকানো হচ্ছে, খোসা ছাড়ানো হচ্ছে। শুকনো ভুট্টা দীর্ঘদিন যেন ভালো থাকে সেজন্য বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সংরক্ষণ করা হচ্ছে বাঁশের চাটাইয়ের ঘের বা বড় ডালার ভিতরে। বাংলাদেশের গ্রাম অঞ্চলে ধান রাখার জন্য যে ডালা ব্যবহার করা হয় ঠিক সেটাই। কেউ কেউ ছাগল আর ভেড়ার পাল নিয়ে গ্রাম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ঘাস খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে। ছোট ছোট বাচ্চারা গলিতে গলিতে খেলা করছে। (চলবে) 

পড়ুন অষ্টম পর্ব : দোগারি পর্বতে বাংলাদেশের প্রথম অভিযান

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়