ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

যত দিন রক্তাক্ত, তত দিনই কবি || সিকদার আমিনুল হক

সিকদার আমিনুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ২৮ জুন ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যত দিন রক্তাক্ত, তত দিনই কবি || সিকদার আমিনুল হক

সিকদার আমিনুল হক

বাংলা-কাব্যলক্ষ্মী এ পর্যন্ত যে কবিদের জন্ম দিয়েছেন তাদের মাঝে ভিন্ন এক স্বর সিকদার আমিনুল হক (১৯৪২-২০০৩)। তার অকাল মৃত্যুর পর লেখা এক দীর্ঘ কবিতায় অগ্রজ কবি সৈয়দ শামসুল হক লিখেছিলেন, ‘তোমার মতো কেউ কবিতা লিখত না, লিখবে না’। সংকেতময় এই একটি পঙ্‌ক্তি দিয়েই শনাক্ত করা যায় তাকে। কবি হিসেবে সূচনা থেকেই তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র। এ স্বাতন্ত্র্য স্বোপার্জিত। বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার কিছুদিন পর কবির সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন শিহাব শাহরিয়ার।

 

সিকদার : সম্ভবত তুমি শুরু করতে চাচ্ছ। আমি জানি না, এই সাক্ষাৎকারের যথার্ প্রয়োজন কতখানি। আমি আশা করব, সিনেমা তারকাদের বেলায় সিনেমা পত্রিকাগুলি যা করে, বোকা বোকা প্রশ্ন, অর্থহীন কৌতূহল, তুমি তা করবে না।

 

শিহাব : আপনি নিশ্চিত থাকুন। আমি তা করব না। কারণ আমি একজন কবির মুখোমুখি। তারকাদের ভক্তরা; আমি ছায়াছবির কথা বলছি, তাদের কল্পনার মানুষকে বায়বীয় দেখতে চায়। কিন্তু কবিতার পাঠক, সংখ্যায় অল্প হলেও মননশীল ও যুক্তিবাদী।

 

সিকদার : এবং সে সঙ্গে আমার মনে হয়, আত্মকেন্দ্রিক ও সব ব্যাপারে খুঁতখুঁতে।

 

শিহাব : (হেসে) তা তো বটেই। বিশেষত আধুনিক কবিতা, খুব উঁচুমার্গের কয়েকজনের সম্পত্তি। (একটু থেমে) এবার সিকদার ভাই, ঠিক প্রশ্ন নয়, বোকা বলুন আর যাই বলুন; এ বছর বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার জন্যে আপনাকে প্রথমেই অভিনন্দন জানাচ্ছি।

 

সিকদার : (হেসে) অভিনন্দনের উত্তরে সামাজিক রীতি হলো ধন্যবাদ জানানো। তোমাকে ধন্যবাদ।

শিহাব : পুরস্কার প্রসঙ্গে আবারও প্রশ্ন করতে হচ্ছে। আশা করি বিরক্ত হবেন না।

সিকদার : বেশ হব না।

 

শিহাব : সাহিত্য পুরস্কার হিসেবে বাংলা একাডেমি পুরস্কার বেশ সম্মানের। তো, এই পুরস্কার পাওয়ার পর আপনার অনুভূতি কী?

সিকদার : প্রথমত বলা দরকার যে, এই পুরস্কার এখন আর সম্মানের, তা আমি মনে করি না। গত দশ-বারো বছর থেকেই পুরস্কার এত অযোগ্য ও মৌলিক লেখক নয়, এমন লোককে দেয়া হচ্ছে যে; এই পুরস্কার সম্পর্কে সাধারণের মধ্যে এখন কোনো আগ্রহ নেই। গাছের ওপর লিখেছেন কিংবা চার পাঁচটা বই নিয়ে একটা শহরের পুরোনো রাস্তাঘাট; অট্টালিকা ইত্যাদি নিয়ে একটা নতুন বই দাঁড় করিয়েও এই পুরস্কার পেয়েছেন। যার সাথে মৌলিক সৃষ্টির কোনো প্রশ্ন নেই।

 

শিহাব : আপনার ধারণা কেন এমন হয়?

সিকদার : হয় এ জন্যে যে পুরস্কারের ঠিক কোনো নীতিমালা নেই। কী কাজে দেওয়া হবে, কেন দেওয়া হবে; এটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। আমার মতে পুরস্কারের দুটি ক্রাইটেরিয়া হতে পারে। এক, যারা সৃষ্টিশীল লেখক, তাদের মধ্য থেকে বয়সের ক্রম অনুসারে দুজন লেখক নির্বাচন করা। দুই, তা না হলে বছরের শ্রেষ্ঠ দুটি গ্রন্থ (যেকোনো শাখার হোক) পুরস্কৃত করা। তার লেখক একদম অপরিচিত হতে পারেন। কিংবা তার বয়স ১৮ বছর হলেও ক্ষতি নেই। যদি শেষটিই গ্রহণ করা হয়। তবে একই লেখক যোগ্যতায় বা কাজের শ্রেষ্ঠতার কারণে বারবার পুরস্কৃত হতে পারেন। এর মাঝামাঝি কোনো ব্যবস্থার কথা আমার জানা নেই।

 

শিহাব : পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে ইতিপূর্বে যথাযোগ্য পাত্রে পুরস্কার পড়েনি। আপনার বক্তব্য জানতে চাই।

সিকদার : তুমি ঘুরেফিরে একটা প্রশ্নেই আটকে আছ; পুরস্কার। এটাকে এত গুরুত্ব দিয়ে দেখার কিছু নেই। তোমার বয়স অল্প, বাঁচবে অনেক দিন, তেমন প্রার্থনাই করি, তুমি নিজের চোখেই দেখে যেতে পারবে, পুরস্কার পাওয়ার ক’জন কবি বা লেখক টিকে থাকবে। পুরস্কার পাওয়ার পরই শ্রান্ত-ক্লান্ত; তাদের কি দেখতে পাচ্ছ না। আসল ব্যাপার হলো ভালো লেখা। তোমার মৃত্যুর পর সেটাই তোমার পক্ষে দাঁড়াবে। কাল অন্তত নির্মম।

 

পুরস্কার নিয়ে অল্পবিস্তর রাজনীতি সব দেশেই আছে। তবে সেটা পাঁচজন একই মাপের শ্রেষ্ঠের মধ্যে একজনকে বেছে নেয়ার প্রশ্ন। কিন্তু এ দেশ অদ্ভুত দেশ। ম্যাজিকওয়ালাকে একুশের পদক দেয়া হয়, ম্যাজিকের সঙ্গে একুশের কী সম্পর্ক আমি বুঝি না। তার জন্য শিল্পকলা একাডেমীর পুরস্কার থাকতে পারে।

 

আমাদের দেশে যত পুরস্কার আছে তার সঙ্গে রাজনীতি কোনো না কোনোভাবে জড়িত। তোমার দল সরকারে থাকলে পুরস্কার পাবে, না থাকলে পাবে না। এটাই হচ্ছে পরিষ্কার ব্যাপার।

 

শিহাব : তরুণ কবিরা আপনাকে ‘কবিদের কবি হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে’- কেন?

সিকদার : আগেও শুনেছি তুমিও বললে। সম্ভবত আমার কবিতার মধ্যে তাদের অনিষ্ট স্বপ্ন কল্পনা ও সফলতা দেখতে পায়। তবে এখনই এই মুকুট পরতে চাই না। আরো বিশ বছর বাঁচতে দাও; তখন দেখা যাবে। তবে একটা কথা মনে রাখবে, সাধারণ পাঠকের কাছে তুমি জনপ্রিয় হলে কি হলে না, সেটা বড় প্রশ্ন নয়। ওটা ঝড়ের মতো। কিছুক্ষণ তার স্থিতি। তুমি সমকালীন লেখকদের কাছে যতক্ষণ না বড় লেখক হিসেবে গ্রাহ্য হচ্ছো; আন্তরিকভাবে- ততক্ষণ বুঝবে তোমার সৃষ্টি অপূর্ণ।

 

শিহাব : আপনার সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘প্রতীকী কবিতার একমাত্র প্রতিনিধি আপনি?’ প্রতীকী কবিতা কেন লেখেন?

সিকদার : ফরাসি কবিতার আঙ্গিক ও কবিতার ব্যক্তি তার ওপর জোর দিই বলেই সম্ভবত তুমি আমাকে প্রতীকী কবিতার একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছো। একমাত্র কি না, সেটা তর্কের ব্যাপার। তবে, আমার কথা হলো সমস্ত কবিতার ব্যাপারে সত্য নাও হতে পারে। পরাবাস্তবতাও কোনো কোনো কবিতায় ব্যবহৃত হয়নি, তা কী করে বলবে? বিশেষ একটি দেহে একজন কবির সব কবিতা দাঁড়াবে বিকশিত বা বিচ্ছুরিত হবে, তা বলা সম্ভবত সংগত নয়। তবে ভের্লেন, ব্যারো, রিলকে, বোদলেয়ার এদের পাশে স্থান দিলে- সংযম রাখা এরপরে সত্যি কঠিন হবে।

 

শিহাব : কোন সংযমের কথা আপনি বলছেন?

সিকদার : নিজের সৃষ্টিতে স্থির, অবিচল ও অতৃপ্তি থাকা। আমি সব সময় সন্দেহ আর দ্বন্দ্বে থাকতে চাই। যত দিন রক্তাক্ত, তত দিনই কবি। নির্দ্বন্দ্ব হলে আমাকে কাফন পরিয়ে দিও।

 

শিহাব : অনেকে বলেছেন, বাংলা কবিতার এখন দুর্দিন, মন্দা, ক্রান্তিকাল চলছে- আপনি কী বলেন?

সিকদার : সমকালের চোখে দ্রষ্টব্যের আংশিকই ধরা পড়ে মাত্র। সেটাকে শেষ বিচার কিংবা অমোঘ হিসেবেও ধরবে না। সবকালেই দেখা গেছে, বিশেষত বুড়োদের চোখে, আর অব্যবহিত কালটাই নিকৃষ্ট অথর্ব। সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার সত্যি পরিচয় পাবে আরো পঞ্চাশ বছর পরে। তবে একই সময়ে একই কালে ঝুড়ি ঝুড়ি বড় বা প্রতিভাবান কবি জন্মায় না। পেলেও বুঝতে হবে সেই ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব অনন্ত সময়ের সঙ্গে যুক্ত হলো।

 

শিহাব : আমাদের কি বলবেন, এত লোক কেন কবিতা লিখতে আসেন? সামাজিকভাবে কি কবিতা লেখা খুব গৌরবের কিংবা লাভজনক কোনো ব্যবসা?

সিকদার : তুমি চমৎকার বলেছো শিহাব। ব্যবসা শব্দটি; হ্যাঁ, তা হলে আমাদের অনেকেরই একটা উপায় হয়ে যেত। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। সামাজিক মেলামেশায় দেখেছি লোকে কবি বলে পরিচয় দিলে (অবশ্য অন্যরাই পরিচয় করিয়ে দেয়, কোন কবিই নিজে থেকে নিজেকে কবি বলে জাহির করে না) একটু অবিশ্বাস ও বাঁকা চোখে তাকায়। যেন কোনো বিপজ্জনক লোকের সঙ্গে দেখা হলো। আমার ক্ষেত্রে তো ব্যাপারটা আরো বিপরীত ও ভয়াবহ। কারণ বাঙালি ধরেই নিয়েছে, কবি হবেন দরিদ্র, ক্ষ্যাপা, উষ্কখুষ্ক দীর্ঘ চুল, যত্নহীন দাড়ি, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, অপরিষ্কার দীর্ঘ পাজামা-পাঞ্জাবি ও এই হারাচ্ছেন তো ওই হারাচ্ছেন গোছের মানুষ। কবি জসীমউদ্দীন সম্ভবত এই ধরনের কবির বেশ সজ্ঞানেই ধরেছিলেন। তাকে নিয়ে, নিজে হারানোর অনেক গল্প আছে। চাঁদপুরে আমাদের স্কুলের বার্ষিক মিলাদে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন- এক সময় দেখা গেল স্কুলের চৌহদ্দি কেন, শহরেই তিনি নেই; রেললাইন ধরে লাকসামের দিকে আপন মনে হেঁটে যাচ্ছেন। কাণ্ডজ্ঞান আছে, এমন লোক স্বাভাবিক মাথায় এটা করবে না; উন্মাদ হলে আলাদা কথা। যাকগে, যা বলছিলাম, তোমরা তো জান আমি বেশভূষায় একটু শৌখিন। কোনো সমাগমে আমার স্যুট-টাই কারো চেয়ে মলিন কিংবা জুতো পলিশ ছাড়া কিংবা ঢলঢলে হবে, তা হতেই পারে না। এগুলির সঙ্গে আমি কবিত্বকে গুলিয়ে ফেলি না। আমি সব সময় ঝকঝকে আকর্ষণীয় থাকতে চাই।

 

শিহাব : সেসব জায়গায় সুন্দরী ও সুশ্রী মেয়েরা থাকে বলেই কি?

সিকদার : অবশ্যই। আমি কবি। মেয়েদের প্রতি আমার দুর্বলতা থাকবে না কিংবা মেয়েরা আমার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকাবে না- এটা মনে হয় মানুষ হিসেবেও আমার পরাজয়। ... নারীর মতো প্রিয় অবসর আর হয় না। গ্যটে, বায়রন, শামসুর রাহমান এদের অগণিত প্রেমিকা থাকার জন্যে আমার ঈর্ষা হয়।

 

শিহাব : কোনো রূপসীর প্রস্তাবে কি আপনি সাড়া দেবেন? পরকীয়া কি পাপ নয়?

সিকদার : তুমি পাদ্রীর মতো কথা বলছো। সমস্ত সৃষ্টি রহস্যের মূলে আছে নারী। রূপসীর চুল্লিতে পুড়তে হয় ক্রমাগত। যৌনতাই সব নয়। লাবণ্যের আনন্দে আন্দোলিত হওয়া; সুঠাম নারীর ঘ্রাণে কালাতীত হওয়ার নামই অমরত্ব। রবীন্দ্রনাথকেই দেখো। বৃদ্ধ বয়সেও ওকাম্পোর বিদ্যুৎস্পর্শে কীভাবে জেগে উঠলেন। নারী দরোজার কি শেষ আছে? দরোজার পরে দরোজা, কার কাছে যাবে তুমি? একজন নীরব তো অন্যজন মুখর; একজন বেদনার তো অন্যজন খলখল চঞ্চলতার। আনন্দের প্রতিশ্রুতি নিয়ে হাত ধরো, দেখবে বিষাদের ভার নিয়ে ফিরে এসেছো। পরকীয়া বলেই দুর্গম ও পরিপূরক। বোধ হয় বুঝতে পারোনি। আর পাপ? তা নিয়ে ভাববার বয়স সত্তরের পরে।

 

শিহাব : আপনি কী এখন কারো... মানে, এই ধরুন ...

সিকদার : থাক্, থাক্। তোমাকে আর বলতে হবে না। গুরুজন, ভয়ে প্রশ্ন করতে লজ্জা পাচ্ছ। কিন্তু এককালে বলতাম। রক্ষণশীলতার সঙ্গে সঙ্গে একালের মেয়েদের জাগতিক বিষয়-বুদ্ধি প্রখর হয়েছে। নারী চিরকালই বীরকে পূজো দিয়ে এসেছে। সেই অর্ঘ্য মনের ও দেহের। প্রথম যুগে বীর ছিল শারীরিক শক্তির, যেমন যোদ্ধারা, বিজয়ী সেনাপতি; তারপরে এলো প্রতিভাবানদের যুগ। কবি, চিত্রকর, গায়ক এদের কাছে সমর্পণকেই ভাবত শ্রেষ্ঠ সমর্পণ। তারপর এল পূঁজিবাদের নষ্টাচার। নারীর দরকার অলংকার, সুগন্ধি, আসবাব, ঐশ্বর্য, বৈভব, ভ্রমণ। এটা সমর্পণ নাকি কেবলই সম্ভোগ, তাও আজকের অধিকাংশ নারী জানতে চায় না। অর্থ আর বিত্তমুখী আর জন্তুদের সংগমের কাছে নারী আজ অসহায়। নারী আজ ক্রয়যোগ্য। অর্থ দিয়ে শ্রেষ্ঠ রূপসীকেও ক্রীতদাসীর স্তরে নামিয়ে আনা যায়। বণিকের উজ্জ্বলতার কাছে সবাই ম্লান। ... যাকগে মেয়েদের নিয়ে এর চেয়ে বেশি তোমার সঙ্গে আলোচনা করা যায় না।

 

শিহাব : কবিদের রাজনীতি কবিদের গোষ্ঠীবদ্ধ হওয়া- বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কালের এই প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আপনার বক্তব্য শুনতে চাই।

সিকদার : রাজনীতি বলতে তুমি সম্ভবত সাহিত্যের রাজনীতির কথা বলছ। দেখ, এটা কিছু প্রচলিত অর্থের রাজনীতি নয়। কিন্তু সাহিত্যেরও একধরনের রাজনীতি আছে। ইউরোপে সেটা অন্য ধরনের; রাজনীতি বলা ঠিক না; একজন কবি মিলে একটি বিশেষ ধরনের সাহিত্য আন্দোলন হলো। তারা ম্যানিফেষ্টো বের করেছেন, পূর্বসূরিদের সাহিত্যকর্মকে বা ধারাকে অস্বীকার করেছেন। যেমন করেছেন সিম্বলিস্টরা ডাডাবাদীরা, স্যুররিয়ালিস্টরা কিংবা ফিউপরিস্টরা। ঢাকঢোল পিটিয়ে হইচই তোলা। সবকিছুর মূলে একটাই গোপন ইচ্ছা; পাঠকদের মনোযোগী করে তোলা। নিজেকে জাহির করা। বাংলা সাহিত্য কল্লোলের আন্দোলন পরিচয়ের আড্ডা, কবিতা ভবনের সংঘ, কিংবা বিষ্ণুদের সাহিত্যপত্রের প্রকাশনা- এসবও সাধু অর্থে রাজনীতি। রবীন্দ্রনাথও প্রমথ চৌধুরী, সত্যেন দত্তদের নিয়ে নিজের রাজত্বকে বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের দেশে, যেটা হয়, খুব নোংরা রাজনীতি। অন্যকে হটানোর দুরভিসন্ধি থেকে পর্দার আড়ালে এক জোট হওয়া।

 

শিহাব : প্রকৃত প্রতিভাবান লেখক, সৃষ্টিশীল লেখককে কি এভাবে সরিয়ে বা উধাও করে দেয়া যায়?

সিকদার : অবশ্যই যায় না। কিন্তু সাময়িক পর্যুদস্ত ও ম্লান করে রাখা যায়। কথাটা খারাপ শোনাবে, আমার রুচিতে বাধছে; আর যে ব্যক্তি নিজে উপস্থিত থেকে জবাব দিতে পারবেন না, তার সম্বন্ধে লেখাও নৈতিকভাবে অনুচিত। তবু সত্য প্রকাশের খাতিরে বলি, শহীদ কাদরী নিজে আমাদের বলতেন, যে তিনি এ রকমটা করতেন। বলতেন, কেউ হাজার লিখেও কিছু করতে পারবে না। (অবশ্য অবস্থাটা এখন বদলেছে তোমরা নূতনরা পরের মুখে অধিকাংশই আর ঝাল খেতে প্রস্তুত নও) যদি না, সাহিত্যের ‘মেইন স্ট্রিম’ তাকে নিজের লোক বলে স্বীকৃতি দেয়। তারই স্কুলের একজন কবি আমার বন্ধু, এখানে নাম থাক; নাইবা বললাম; বলেছেন তাকে এই ‘মেইন স্ট্রিমে’ ঢোকাতে শহীদ কাদরীকে মাসের পর মাস চেষ্টা করতে হয়েছে। যারা সেখানকার লোক, তরুণ এই কবিকে পাত্তা দেবে কেন? তা ছাড়া এমন কোনো আশ্চর্য প্রতিভাবানও তিনি নন। কিন্তু শহীদ কাদরী তার নিজের লেখার ভিত্তি মজবুত করার জন্যেই এটা করেছিলেন। বড় কবি, অনুকারী চায় তাতে তার গৌরব ও কৌলীন্য বাড়ে। ফলে, অচিরেই আমার সেই তরুণ কবি বন্ধুর প্রমোশন হয়। শহীদ কাদরী এমনি আরো অনেক কাজ করেছেন, যা তার মতো প্রতিভাবান কবির করা আমি মনে করি উচিত ছিল না।

 

বিচিত্রা একবার, ও সেবারই সম্ভবত শেষ, একটি কবিতা সংখ্যা করেছিল। কাদরী ছিলেন অলিখিত প্রধান পরামর্শদাতা। কাদরী, রফিক আজাদ এরা মিলে চট্টগ্রাম থেকে বিপ্রদাশ বড়–য়াকে আনিয়ে (তখন বিপ্রদাশ চট্টগ্রাম থাকতেন। বেকার ছিলেন) তাকে কাদরীর নিজের বাসায় রেখে ব্রিফিং করে একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখান। কবিতার ওপর। সেটা পড়ে সহকারী সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী খুবই বিব্রত হয়ে পড়েন। পাণ্ডুলিপি আকারে ছিল বলে ভাগ্য ভালো। নইলে শাহাদত চৌধুরী বিতর্কিত ও সমালোচনার মুখে পড়ে যেতেন। সেখানে বলা বাহুল্য আমার নাম ছিল না এবং আরো অনেক উল্লেখযোগ্য কবিরই নাম ছিল না। উপায়ান্তর না দেখে শাহাদত চৌধুরী আরো একটা পরিপূরক প্রবন্ধ লেখালেন অন্য একজনকে দিয়ে। এমনি করে চাকরি ও ভালো সম্মানীর লোভ দেখিয়ে বেকার বিপ্রদাশ বড়–য়াকে দিয়ে ওরাই ‘কবিতার বাক্-প্রতিমা’ নামে এক একজন কবির ওপর দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখিয়েছিল। প্রথমে বাংলা একাডেমির পত্রিকা উত্তরাধিকারে ছাপা হয়। (তখন রফিক আজাদই কার্যত উত্তরাধিকার পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন) পরে বই আকারে বের হয়। সমরে যেমন সেনাপতি শহীদ কাদরী তেমনি চেলা-চামু- পরিবেষ্টিত থাকতেন। তার লাম্বাগো অসুখ হয়েছিল- তার শ্বশুরালয়ে শুরু থেকেই দিনের পর দিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এ দেশের লেখালেখির জগতে কোন অস্ত্র প্রয়োগ করবেন, কাদের ওপর করবেন, লেখালেখি করে কাদের মূল্য কমাতে হবে, কোন কৌশল দরকার ইত্যাদি অবস্থান ও প্রয়োগ পদ্ধতি নির্ধারণ করতেন। আমি তখন চট্টগ্রামে, চাকরি উপলক্ষে আছি, এক ছুটিতে এসে কাদরীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে এই যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি ও পদ্ধতি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর এখানে গোষ্ঠীবদ্ধ যে অন্য কারণে। যাদের প্রতিভা নেই। কবি হওয়ার যোগ্যতাও নেই পরিশ্রম করার সাহস ও প্রতিজ্ঞা নেই- কিন্তু এক অজ্ঞাত কারণে কবি হওয়ার ইচ্ছাও পোষণ করেন তারা গোষ্ঠীবদ্ধ হওয়ার সুবাদে সংঘে পদ, প্রচার ও কিছুকাল আত্মজাহিরের সুযোগ পান।

 

শিহাব : সিকদার ভাই আপনি জীবনের অনেকাংশ একাই কাটিয়েছিলেন; কিন্তু এখন দেখছি আপনিও পরিষদে সংঘে জড়িয়ে যাচ্ছেন। এটা কেন?

সিকদার : এটার কারণ সকলের মতো আমার মধ্যেও স্ববিরোধিতা আছে। দ্বিতীয় কারণ, আমার চরিত্রের দুর্বলতা। আমি কঠোর হতে পারিনে, বুঝতে পারি ব্যাপারটার পরিণতি খারাপ, শেষ পর্যন্ত অপ্রিয়তায় পৌঁছাবে তবু কেউ যদি অত্যন্ত বিনীতভাবে প্রার্থনা নিয়ে আসে; আমি যদিও লোকটার মতলব ও অসৎ উদ্দেশ্য বুঝতে পারি পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে; তবু কী করে যেন সম্মত হয়ে যাই। যদি কড়ায়-গণ্ডায় তার মাশুল দিই, মনস্তাপে ভুগি এ নিয়ে, কষ্ট পাই- তবু একই ভুল বারবার করি। একা থাকার স্বভাব নিয়ে আমি জন্মেছি, দলের অনাচার ও কোলাহলে আমি বর্তমানে সত্যি বলছি, অসুস্থ। দল করলেই নিজে কিছু অন্যায় এবং অন্যের অন্যায় প্রশ্রয় দিতেই হবে। যা বিশ্বাস করি না তা তোমাকে উচ্চারণ করতে হবে, নিতান্ত অর্বাচীনের ভাঁড়ামি ও চিৎকারে সাড়া দিতে হবে।

 

শিহাব : সেটা বোঝা যায়, আপনি কোনো কিছুতেই বেশি দিন যুক্ত থাকতে পারেন না। এতে অনেকেই আপনাকে ভুল বোঝে। সুবিধাবাদী মনে করে।

সিকদার : তা করুক গে। তিক্ততার চেয়ে ছিন্ন হয়ে আসা অনেক ভালো। হৃদয়ের প্রশান্তি ও একাকিত্বের মতো আনন্দ আর কিছুতেই নেই।

 

সিকদার আমিনুল হক, ইনসেটে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী কবি শিহাব শাহরিয়ার

 

শিহাব : আপনি তো জাতীয় কবিতা পরিষদ, পদাবলী এসব একসময় করেছিলেন?

সিকদার : হ্যাঁ, যুক্ত ছিলাম। খুব সক্রিয় নয়। জাতীয় কবিতা পরিষদে যুক্ত থাকার প্রথম প্রস্তাব এসেছিল কবি শামসুর রাহমানের কাছ থেকে। তখন তিনি দৈনিক বাংলার সম্পাদক। কিন্তু সেই সংঘে এমন একজন ছিলেন, উঁচু মহলে যাকে আমি গলাবদ্ধ প্রিন্সকোট পরে বঙ্গভবনের অনুষ্ঠানে ও পরে স্বৈরাচারী এরশাদের সঙ্গে দেখা করতে টেলিভিশনে দেখেছি। আমার যুক্ত হওয়ার অনিচ্ছার কথা বিনীতভাবে রাহমান ভাইকে জানিয়েছিলাম, কিন্তু দেখো, এর এক বছর পরেই ইকবাল হাসানের (এখন কানাডায় আছেন) পীড়াপীড়িতে প্রচার সম্পাদক হিসেবে এক বছর সেখানে ছিলাম। কিন্তু না থাকার মতো, স্বস্তি পাইনি; ওরাও পরের বছর থেকে আমাকে সামান্য সদস্য ও সর্বশেষে একদমই বাদ দিয়ে দেন।

 

শিহাব : কিন্তু ‘পদাবলী’ ছাড়লেন কেন?

সিকদার : আমার বন্ধুদের খুব ইচ্ছা ছিল না, আমি ‘পদাবলী’র একজন ছিলাম। কিন্তু কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, কেন জানি না, আমাকে খুব পছন্দ করতেন। তারই প্রস্তাব অনুযায়ী প্রথম অনুষ্ঠানেই আমি কবিতা পড়ি- তা নিয়ে আমার দু’একজন বন্ধুর কী যে মনোবেদনা।...যাই হোক, কিছুকাল কোণঠাসা হয়ে থাকতে পারলেও, সর্বশেষ এক ঘটনায় এতটাই নিজেকে অপমানিত ও ছোট মনে হলো যে এরপরে ‘পদাবলী’র সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করে ফজল শাহাবুদ্দীনের ‘কবিকণ্ঠে’ যোগ দিই। আমি যোগ দিই, আল মাহমুদের এটা মোটেই মনঃপূত ছিল না। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘুমন্ত: দেখা হলে অনেক সময় সাধারণ সৌজন্য বিনিময় পর্যন্ত হয় না। কিন্তু ফজল শাহাবুদ্দীন আমাকে ‘কবিকণ্ঠে’ নিতে উৎসাহী ছিলেন।

 

শিহাব : ‘পদাবলী’ ছাড়ার বিশেষ ঘটনাটি বলবেন কি?

সিকদার : সময় হচ্ছে শিহাব এমন একটা ব্যাপার, যা দূরত্বে গিয়ে আর কষ্ট কিংবা ক্ষোভের থাকে না। আমার নেই। কারো প্রতি যেন ঘৃণা, ক্রোধ নিয়ে না মরি। ক্ষতের দিকে তাকিয়ে পুরোনো কথা মনে হয়; কিন্তু তার বেশি নয়। ব্যাপারটা হয়েছিল কি একবার পদাবলীর এক অনুষ্ঠান হয়েছিল বেইলী রোডের কোন এক মঞ্চে। দর্শনীর বিনিময়ে কবিতাপাঠ, পদাবলীরই প্রথম কৃতি ঢাকার মঞ্চে। তবে আমাকে অধিকাংশ অনুষ্ঠানেই বাদ দেয়া হতো। আত্মবিশ্বাস ছিল বলে অস্থির হইনি; বরাবরই অবিচল থেকেছি। সেটাই আমার স্বভাব। যে অনুষ্ঠানটির কথা বলছি, তাতে আমার নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল। বারো-চৌদ্দজন স্বরচিত কবিতা পড়বেন। হলে পৌঁছে দেখি মঞ্চে কবিদের বসার দু’রকম জায়গা হয়েছে। এক পাশে উঁচু সিংহাসনের মতো ছয়টি বেতের কোনাকুনি সাজানো। অন্য পাশে একটি শতরঞ্জি ঢাকা চৌকি। ছয়জন কবি বসে থাকবেন চেয়ারে, আর বাকিরা গা- ঘেঁষাঘেঁষি করে চৌকিতে। পর্দা উঠবে, অন্ধকার মঞ্চ; ক্রমে আলো উজ্জ্বল হবে ছয়জন কবির মুখে এবং সর্বশেষে সব আলো জ্বলে উঠলে দেখা যাবে বাকিদের। এই মঞ্চ পরিকল্পনা ছিল সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের। অত্যন্ত অপমানজনক, একবার ভাবলাম, কাউকে কিছু না বলে চলে আসি। পরে ঠিক করলাম ব্যাপারটাকে নাটকীয় করলে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে। কিন্তু সংকল্পে পৌঁছে গেছি, এই শেষ। ‘পদাবলী’ আমার জায়গা নয়।

 

শিহাব : ভারি মজার তো। আপনার মতো ভালো মানুষকেও এরকম অপদস্থ হতে হয়েছে

সিকদার : জীবিতকালে অত প্রশান্তি করো না। জান না মৃতেরই তা প্রাপ্য।

 

শিহাব : এ রকম আরো হয়েছে?

সিকদার : অনেক, অনেক। আমার জীবনের অনেকটাই উপেক্ষার আর অন্ধকারের। সাধে কি একটি কবিতার বইয়ের নাম রেখেছি বহুদিন উপেক্ষায়, বহুদিন অন্ধকারে। জানো, ‘রোববার’ একবার বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরের বারো বছরের সাতিহ্য, চিত্রকলা, স্থাপত্য ইত্যাদির ওপর একটা বিশেষ সংখ্যা করেছিল। সেখানে বাংলাদেশের কবিতার ওপর প্রবন্ধ লিখেছিল (কিংবা তাকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন সম্পাদক) এক তরুণ। বিশ্বাস করবে, বগুড়া, বরিশাল এ-রকম ছোট জায়গার কবিদের নাম সেখানে থাকলেও কবিদের দীর্ঘ তালিকায় আমার সামান্য নামটা পর্যন্ত ছিল না। ঢাকার অনেক অল্পখ্যাত কবিদের ছবি, পরিচিতি প্রতি পৃষ্ঠায় বক্স করে ছাপিয়েছে সম্পাদক। এবং সে সম্পাদক আবার আমার বন্ধুও। ঢাকায় প্রথম কবি বন্ধু। তবে, তোমাকে বলি, উপেক্ষা হচ্ছে কবির জন্য আশীর্বাদ। যত উপেক্ষা তত ধারালো, যত অবহেলা, ততই নিজের দিকে তাকানোর সুযোগ, যত নিভৃতি, ততই উজ্জ্বল হওয়ার সম্ভাবনা। কবিতা বলো, শিল্প বলো- একটা দীর্ঘ ভ্রমণ। একদিন দুদিনের ঝড়-বৃষ্টির ব্যাপার নয়, তুমি শেষ পর্যন্ত চূড়ায় উঠতে পারলে কি না, সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন তোমার প্রাপ্তি। উৎপীড়ন, উপেক্ষা, অবহেলা এগুলি থেকে প্রেরণা পাওয়ার শক্তিকেই বলব, প্রতিভার শক্তি। জনপ্রিয়তায় যিনি অভ্যস্ত, তিনি থাকছেন নেশায়, নেশার মধ্যে তুমি কিছুই দেখতে পাওনা। আত্মতৃপ্তি ছাড়া।

 

শিহাব : আপনার সমসাময়িক কবিদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

সিকদার : তুমি আবার আমাকে বৈরিতার মধ্যে ফেলতে চাচ্ছ, যা একবার হয়েছিল, বিচিত্রায় একটা সাক্ষাৎকার দেয়ার পর। ...তবে, আমার কথাই শেষ নয়, চূড়ান্ত বলে ভেব না। উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস নয়, সম্ভবত কার্ল শাপিরো- স্মৃতি আজকাল বড্ড প্রতারণা করে; এলিয়টের গদ্য লেখাকে বলেছিলেন ইংরেজি ভাষায় সবচেয়ে বাজে গদ্য লেখার নমুনা। কিন্তু দেখো, এলিয়ট আছেন ভাষার লাবণ্যের জন্যে না হলেও পা-িত্য, যুক্তি ও তথ্যের জন্যে। তার বিশ্লেষণের ক্ষমতাকে ছোট করে দেখা যাবে না।

 

শিহাব : আপনি কারো মুখ চেয়ে কথা বলেন না, এটাই কিন্তু আমাদের ধারণা।

সিকদার : তুমি আমাকে পাহাড়ের খুব কিনারে নিয়ে এসেছ, বেশ বুঝতে পারছি। তা হলে বলি আমরা সবাই একসাথে শুরু করলেও সিদ্ধি তো সবার একরকম নয়। আবদুল মান্নান সৈয়দ আমাদের সময়ের একজন স্বতন্ত্র চিহ্নিত, ক্ষমতাবান কবি। তার কল্পনাশক্তি, শব্দের অভিনব ব্যবহার চিত্রকল্পের দীপ্তি নিঃসন্দেহে আলাদা। কবিতা তার কাছে গভীর নীলিমা থেকে উড়ে আসে; সম্ভবত এ জন্যে তার কবিতার সংখ্যা অন্যদের চেয়ে অল্প। কিন্তু মান্নান কাজ করেন বিস্তৃত ক্ষেত্রে- তার সৃষ্টি ক্ষমতা অফুরন্ত, ফলে কবিতার রক্তাক্ত ও সফল পরিণতি তিনি অন্যান্য সৃষ্টির চাপে দেখবেন কি না জানি না, তবে শেষ পর্যন্ত তার পরিচয় কবি হিসেবেই আমার কাছে উজ্জ্বল ও বিশেষ অর্থময়। মোহাম্মদ রফিকের কবিতা এক বিশেষ মতবাদের লেখকদের পৃষ্ঠপোষকতায় কিছুদিন বাজারে আলোচিত ছিল। আজ তার উপস্থিতি নিস্তব্ধতায়। রফিক আজাদ নানা কারণে, নানা ভূমিকার জন্যে প্রথম থেকেই আলোচিত। প্রকরণের সামর্থ্য তাঁর রক্তের মধ্যেই, ফলে কখনো কখনো ক্ষমতাকে যান্ত্রিক বলেই ভ্রম হয়। ভাবুকতা অল্প, কিন্তু সমকালীন স্রোত ধরতে জুড়ি নেই। সংবাদপত্রের খবরের মতো তার কবিতা উত্তেজক কিন্তু ক্ষণস্থায়ী। আসাদ চৌধুরী তিরিশের প্রেমেন্দ্র মিত্র ও পঞ্চাশের তারাপদ রায়কে মিলিয়ে বাংলা কবিতায় একটা স্বতন্ত্র শিল্পাগ্নি জ্বালাতে চেয়েছিলেন কিন্তু ইদানীং শিল্প-যাপনে তিনি অন্যমনস্ক। নির্মলেন্দু গুণের গদ্য-পদ্য সমস্ত রচনাতেই নিজ সংকল্পে স্থির। কবিত্বের নানা প্রচেষ্টায় তিনি কখনো সমাজমনস্ক, কখনো প্রেমিক কখনোবা প্রসার বোধের রূপকার। তবে আপাদমস্তক এই কবি আমার ধারণায় তার স্থান পাকা করে নিয়েছেন। মহাদেব সাহার কবিতা বায়বীয়; মান্নান সৈয়দের ভাষায় ‘ছাঁচে-ঢালা নিরুত্তরণ কবিতা লিখে তিনি অগভীর পাকের প্রিয়।’ ফরহাদ মজহার, আবু কায়সার, আলতাফ হোসেন- এরা সবাই নিজস্ব ভূমিতে উজ্জ্বল ও উল্লেখযোগ্য। মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা কল্পনার আভা ও লাবণ্যের অভাব পূরণ করে দিয়েছে গভীর ইতিহাস চেতনা ও প্রকরণের মজবুত স্থাপত্য। রুবী রহমানের কবিতা নিরাভরণ; স্নিগ্ধ ও নিরুত্তেজ শক্তির দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। প্রখরতা নয়, রোমান্টিকদের আবেগ তাড়নাও তাতে নেই স্বাভাবিক, সুস্থ ও অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত। মনজুরে মওলার কবিতা প্রগলভ, কিন্তু আত্মাহীন তাতে অতিকথনের বেশি কিছু নেই। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কয়েকটি ‘মুখরোচক’ কবিতা লিখেছিলেন প্রথম যৌবনে কিন্তু তার প্রতিপত্তি বাজারে আসার আগেই তিনি চলে গেছেন ভিন্ন ব্যাপকতায়। শামসুল ইসলাম অপ্রচলিত শব্দের আবিষ্কারে মগ্ন। এ জন্যে তার কবিতা স্বতন্ত্র করে চেনা যায়। নিজস্ব গীতল-উচ্চারণে মুগ্ধ সানাউল হক খানের কবিতায় এখন দরকার অনাত্মা প্রসঙ্গ ও প্রকরণ সচেতনতা। জাহিদুল হক প্রকরণকে জয় করেছেন, এখন তার দরকার অভিজ্ঞতার দরোজা খুলে বৈচিত্র্যের দিকে যাওয়া। অসীম সাহার কবিতা মিতকথনের দিকে গেলে উজ্জ্বলতর হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কবি হিসেবে বেলাল চৌধুরী নিজেকে সর্বদাই গুটিয়ে রাখেন। তবু তার কিছু কিছু গদ্য কবিতার দু’এক পঙ্‌ক্তির ঝিলিক স্মরণ করিয়ে দেয় নাগরিক বৈদগ্ধ্য ও উড়নচণ্ডী রৌদ্রের খেয়াল-খুশির উৎসব। রবিউল হুসাইনের কবিতা আরো স্থির বিশ্বাসের দিকে, মিতকথনের পোশাকে যাওয়া দরকার। কি বলছি সেটা বড় নয়, তার বিশ্বাস্য গন্ধের নামই কবিতা।

 

শিহাব : আপনার প্রিয় কবিদের তালিকায় কে কে রয়েছে? কাউকে আদর্শ মনে করেন কি?

সিকদার : কোনো কবিকে আদর্শ করে কেউ কোনো দিন ভালো কবি, বড় কবি হয়েছে বলে জানি না। আদর্শ বলতেই বা কী বোঝায়? প্রভাব?... হ্যাঁ, তরুণ কবির ওপর বড় কবির প্রভাব প্রাথমিক অবস্থায় থাকতে পারে, সেটা খুব দোষের নয়। কিন্তু অনেক নিচুতলায়। তাও কয়েক দিনের জন্যে। আমার প্রিয় কবিদের তালিকা সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, শামসুর রাহমান, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, উৎপল কুমার বসু ও কিছুটা শঙ্খ ঘোষ। অন্য ভাষার কবিদের মধ্যে সেফেরিস, রিল্কে, ভের্লেন,  বোদলেয়ার, ব্যারো, পুশকিন, ইয়েটস, লোর্কা, কোয়াসিমদো, লাফার্গ, নেরুদা ...আর পারছি না বাপু! ... সব বড় কবিই আমার গুরু। সবাই আমার শিক্ষক।

 

শিহাব : আপনাকে যদি বলা হয়, বাংলা কবিতার দশটি শ্রেষ্ঠ বই বাছাই করুন, আপনি কোন দশটি বইকে করবেন?

সিকদার : পারব না। সেটা সম্ভব নয়।

 

শিহাব : যদি নিকৃষ্ট দশটা বলি?

সিকদার : সেটা পারব কিন্তু বললে শারীরিকভাবে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। তুমি কি আমাকে বাঁচাতে পারবে?

 

শিহাব : তরুণ কবিদের সম্পর্কে আপনার কি বক্তব্য?

সিকদার : আমিও তরুণ কবি। বৃদ্ধ ভাবছ কেন? কিংবা প্রৌঢ়? অনেক তরুণ কবিই আমার মতো আবার অনেক তরুণ কবিই আমার মতো নয়।

 

শিহাব : আপনার লেখার প্রক্রিয়া কী?

সিকদার : নিজের পড়ার টেবিল, কবিতার খাতা, একটা কালির কলম (বর্তমানে পার্কার), চিন্তা, অভিজ্ঞতাকে ডেকে আনা, ঘর্মাক্ত হওয়া, চৈতন্যের সঙ্গে জড়ের সংগ্রাম, বারবার চা খাওয়া, কোনো সুন্দরী মেয়ের মুখ, পরিশ্রম ও যা লিখতে চেয়েছিলাম সে কবিতাটি লিখতে না পারা।

 

শিহাব : আপনি একজন প্রগতিশীল এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লেখক হয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের কাগজে লিখছেন কেন?

সিকদার : আমি তোমার কথায় লজ্জিত। একটি সাপ্তাহিকের স্নেহভাজন এক সম্পাদকের প্রতি দুর্বলতার জন্যেই কাজটি করেছি। তবে আর লিখব না। ছোট ছোট আপস থেকেই একদিন বড় পাপ হয়, কথা দিচ্ছি, আর লেখা দেখবে না। তবে বিপুল অর্থশক্তির ক্ষমতা ও বড় তাদের জন্যে কিন্তু লিখিনি।

 

শিহাব : আপনি সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক ঘুরে আসলেন, সেখানে বিশ্ব কবিতা এবং প্রবাসী লেখকদের কী অবস্থায় দেখে এলেন?

সিকদার : উত্তর আমেরিকায় অষ্টম বাংলাদেশ সম্মেলনে কবি হিসেবে নিমন্ত্রিত হয়ে মার্কিন দেশে গিয়েছিলাম। সেটা বোস্টনে। সম্মেলন শেষে কয়েকদিন বোস্টনে ও পরে নিউইয়র্কে কাটাতে হয়েছে ব্যস্ততায়। নিউইয়র্কে একই দিনে দু-তিনটি সভাতেও যেতে হয়েছে। সিঙ্গাপুর ও ব্যাংকক ভ্রমণ সস্ত্রীক ও ব্যক্তিগত।

 

বিশ্ব কবিতা বলতে যা বুঝিয়েছ, তার সঙ্গে যোগাযোগ স্বদেশে বসেই। গিন্সবার্গের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু নাসির আলী মামুন অসুস্থ থাকায় হলো না। তবে বোস্টনে একটা কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম, আধ ঘণ্টার মতো ছিলামও। অন্য জায়গায় পূর্ব থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকায় বেশিক্ষণ থাকা হলো না। তরুণ কবি দেখলাম না। শ্রোতা বা কবি সব মিলিয়ে সারা ঘরে বিশ থেকে বাইশ জন। ক্যারোলিন রাইট ছিলেন, কলকাতার কবিতা সিংহ। সাহেব কবিদের বেশ ক’জনের বয়স সত্তরের ওপর। দাড়ি-চুল কবি হুইটম্যানের মতো হাফপ্যান্ট, ড্রেস পরা, তাও মোজা নেই। একজনের মাথা কামানো, বয়স ষাটের বেশি হবে; হাশিশ ব্যবসায়ের ডনের মতো গাট্টাগোট্টা চেহারা। নাম মনে নেই।

 

মার্কিনে বাংলাদেশে লেখালেখি করে প্রতিষ্ঠা পেয়ে মার্কিনে গেছেন সেসব প্রবাসীদেরই লেখা শিল্পোত্তীর্ণ ও স্বীকৃতিযোগ্য মনে হয়েছে। শহীদ কাদরী (বোস্টনে), সুরাইয়া খানম (অ্যারিজোনা), জ্যোতি প্রকাশ দত্ত, আলম খোরশেদ, পুরবী বসু- বাকিদের আত্মপ্রকাশের ইচ্ছা ও পরিশ্রম অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু যাকে আমরা সাহিত্য বলি, তার অন্তঃপুরে পৌঁছানো দূরে থাক, চৌকাঠেও পৌঁছেছে কি না সন্দেহ। এখানকার মধ্যে সেখানেও দলাদলি, পরস্পর কাদা ছোড়াছুড়ি ও ফাঁপা আত্মবিশ্বাসের প্রচুর দৃষ্টান্ত দেখে এসেছি।

 

শিহাব : কবিতা না লিখলে কি করতেন?

সিকদার : সংসারের জন্য মানুষ যা করে থাকেন। ভাঁড়ামি করতাম, কিংবা গম্ভীর থাকতাম অথবা সারা দিন জীবিকার জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে রাতে পশুর মতো স্বপ্ন ছাড়াই ঘুমাতাম।

 

শিহাব : সিকদার আমিনুল হকের কবিতার পাঠক হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতা কী?

সিকদার : খুব সুখের নয়। এত ভালো কবিতা বেশি দিন লেখা যায় না।

 

শিহাব : আপনার কবিতার দুর্বোধ্যতা সম্পর্কে অনেকে প্রশ্ন তোলেন। আপনি কি আসলেই দুর্বোধ্য কবি?

সিকদার : আমারও তাই ধারণা, আবার এ জন্যেই আমার কবিতা লোকে বারবার পড়বে।

 

শিহাব : আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে ছন্দ কতটা জরুরি? অনেকে বলেন, একালে গদ্য কবিতাতেই কবিতার মুক্তি? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য।

সিকদার : মোটেই নয়। জীবনের সর্বত্রই ছন্দ। ছন্দকে ভয় করে তারাই, যারা জীবনের মধ্যে সুন্দরকে দেখে না। গদ্য কবিতা অতি-ছন্দের কবিতা। দক্ষতায় শ্রেষ্ঠদের জন্যেই গদ্য কবিতা; অথচ বাংলা কবিতায় তা গেল দুর্বলদের হাতে। চল্লিশ বছর পর্যন্ত একটানা অঙ্ক ও ছন্দে কবিতা লেখা দরকার। ...যদি তোমার মধ্যে থাকে স্থায়ী হবার ইচ্ছা।

 

শিহাব : আধুনিকতা উত্তর আধুনিকতা বিতর্ক আপনি কীভাবে দেখছেন?

সিকদার : সব বিতর্কের মতোই। এর পক্ষে যুক্তি আছে, বিপক্ষেও যুক্তি কম নেই। অপেক্ষা করতে হবে, সেটাই নিয়ম।

 

শিহাব : অনেক হলো সিকদার ভাই। অপকট উত্তরের জন্যে ধন্যবাদ। তবে একটু আক্ষেপ থাকল, প্রশ্ন করে আপনাকে রাগানো গেল না।

সিকদার : সহিষ্ণুতার জামা গায়ে দিয়েই তো বসে আছি। কবি, সাধু আর পাহাড়- স্তব্ধতার দায় বহন করে এরা অতিক্রম করে যায় ক্রোধ ও অস্থিরতা। আমি ক্লান্ত হইনি; তুমিও না। এই সাক্ষাৎকার থেকে পাঠক যদি আমার ভেতরের আলোর সামান্যও দেখতে পায়, তবে তোমার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে আমি বলব।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুন ২০১৬/এএন/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়