ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

ছিটমহল : ‘ওরা কেউই আসছে না’

মোয়াজ্জেম হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:১৮, ১১ জুলাই ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছিটমহল : ‘ওরা কেউই আসছে না’

মোয়াজ্জেম হোসেন, লালমনিরহাট : ‘বাপ-দাদার কবর ফেলে কীভাবে বাংলাদেশে যাই। শত কষ্ট হলেও এখন তাদের স্মৃতি আগলে রেখে ভারতেই থাকতে চাই। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন সবাই ভারতে থাকে। গত ৬৮ বছর ভারতেই কেটে গেছে আমাদের। এখন আর বাংলাদেশে গিয়ে কি নতুন করে ঘরসংসার করা সম্ভব? ছেলেমেয়ের বিয়েও ভারতে হয়েছে। দেখুন, আমরা না হয় বাংলাদেশে গেলাম। কিন্তু ভারতের মাটিতে থাকা আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের কী হবে?’

 

এদিকের বন্ধুদের ছেড়ে ওদিকে গেলে মানসিক যন্ত্রণা আরো বাড়বে। এসব কারণেই পরিবারের সব সদস্য মিলে বাংলাদেশে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যদিও না যাওয়ার কষ্ট আছে। কিন্তু এ ছাড়া যে অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে সুযোগ নেই। তাই পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে জরিপকারীদের কাছে হালনাগাদ তথ্য দেওয়ার সময় ‘ভারতের নাগরিকত্ব’ পেতে আবেদনপত্র পূরণ করে স্বাক্ষর দিয়েছি। এখন অপেক্ষায় আছি, কবে পাব ভারতীয় নাগরিকত্ব।’

 

বাংলাদেশ-ভারত সরকারের উদ্যোগে ছিটমহলে যৌথভাবে চলমান জনগণনার হালনাগাদ কার্যক্রম বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল পরিদর্শনে গেলে তাদের এভাবেই জানান ভারতের কোচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমার অভ্যন্তরে থাকা ৮২ নম্বর কিসামত বাত্রিগাছ ছিটমহলের বাংলাদেশি বাসিন্দা মতিয়ার রহমানসহ (৭৭) অন্য বাসিন্দারা।

 

ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশি ৫১টি ছিটমহলের জনগণনার কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে দেশে ফিরে বুড়িমারী স্থলবন্দর জিরোপয়েন্টে শনিবার স্থানীয় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন রংপুর বিভাগীয় অতিরিক্ত কমিশনার (রাজস্ব) মিনু শীলসহ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা।

 

৮ থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত তিন দিন ধরে আট সদস্যের এ প্রতিনিধিদল ভারতের কোচবিহার জেলার অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশি বিভিন্ন ছিটমহলে জনগণনার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে। কোচবিহারে রংপুর বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) মিনু শীলের নেতৃত্বাধীন আট সদস্যের প্রতিনিধিদলের সফরকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবু হেনা মোহাম্মদ রহমাতুল মুনীমের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আরো একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল ছিটমহলের জনগণনার কার্যক্রম পরিদর্শন করে। এ প্রতিনিধিদলটি শুক্রবার সকালে গিয়ে বিকেলেই দেশে ফিরে আসে। স্থানীয় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তারা একই কথা জানিয়েছেন।

 

ভারতের কোচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমার অভ্যন্তরে থাকা ৮২ নম্বর কিসামত বাত্রিগাছ ছিটমহলের জনগণনাকারী বাংলাদেশি স্কুলশিক্ষক আবদুর রহিম প্রামাণিক লিবন সেলফোনে বলেন, ‘২০১১ সালের হেড কাউন্টিংয়ের তথ্যমতে, ৮২ নম্বর বাত্রিগাছ ছিটমহলে ১২৫টি পরিবার পাওয়া গেছে। এসব পরিবারের সদস্যসংখ্যা ৬০৪ জন। এদের জনগণনার হালনাগাদ কার্যক্রম আক্ষরিক অর্থে শেষ হয়েছে। তবে এ ছিটমহলের কেউ বাংলাদেশি নাগরিকত্ব নিতে চায়নি। তারা সবাই ভারতীয় নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদনপত্র পূরণ করেছে।’

 

তিনি আরো বলেন, ‘এখনো যেহেতু ১৬ জুলাই আসতে আরো কয়েকদিন বাকি আছে, সেহেতু আমারও কাগজপত্র জমা দিতে কিছুটা অপেক্ষা করছি।’

 

৮২ নম্বর বাত্রিগাছ ছিটমহলের বাসিন্দা মতিয়ার রহমানের বড় মেয়ে সেলফোনে বলেন, ‘আমি মিথ্যা তথ্য দিয়ে শীতলকুচি গোসাইরহাট উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করার পর এখন  শীতলকুচি কলেজ থেকে বিএ ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি। সামনেই ফলাফল। আমার নানার বাড়ি ও দাদার বাড়ি সবই এখানে। আমার পাঁচ ভাই এখানেই বিয়ে করেছে। আমরা দুই বোন। আমার পড়ালেখা প্রায় শেষের পথে। ছোট বোন সেরিনাও উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছে। এত বছর পর ছিটমহল বিনিময় হলো। কিন্তু এর মধ্যে ভারতেই আমাদের সেতুবন্ধ গড়ে উঠেছে। এদের ছেড়ে কীভাবে আমরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে দেশে ফিরে যাই? তাই আমরা কেউই যাচ্ছি না। শুধু আমাদের ছিটমহলে  নয়। প্রতিটি ছিটমহলে আমরা ছিটবিনিময় কমিটির পক্ষ থেকে প্রচার চালিয়েছি। যেন কেউ বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে দেশে ফিরে না যায়। আমরা ভারতের সঙ্গেই একীভূত হয়ে থাকতে চাই। সে জন্যই ভারতীয় নাগরিকত্ব চেয়ে আমরা আবেদনপত্র ফরম পূরণ করেছি।’

 

তিনি আরো বলেন, ‘এতটা বছরে সবারই ভারতে আত্মীয়স্বজন হয়েছে। এখন আমরা দেশে ফিরলেও ওদের কীভাবে ফেলে রেখে যাব। ঘুরেফিরে আত্মীয়তা রক্ষা করতে হলে ফের পাসপোর্টে দিয়ে আসতে হবে। এতে স্বজন হারানোর বেদনা আরো বেশি মানসিক কষ্ট বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই সাধ থাকলেও আর দেশে ফিরে যাওয়া হবে না। এসব কারণেই কেউই যেতে চাইছে না। আমি ব্যক্তিগতভাবেও অনেকের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেছি। কিন্তু কেউই রাজি হয়নি। তবে কেউই যাচ্ছে না বলে আমরা বাংলাদেশকে ভুলে যাচ্ছি না। আমাদের অন্তরে গাঁথা থাকবে বাংলাদেশ নামক একটি দেশ আছে আমাদের। সেটা কখনো ভুলে যাবার নয়।’

 

এমন দাবি নিয়েই কথা বলছিলেন ৮২ নম্বর বাত্রিগাছ ছিটমহলে জন্ম নিয়ে বেড়ে ওঠা তরুণী শাহনাজ বেগম। এ সময় তার মা জাহিমা বিবি বলেন, ‘আমার বাবা জসির উদ্দিন বসুনীয়া শীতলকুচি থানার ছোট মধুসুন এলাকায় ছিলেন। তিনি সেখানেই মারা গেছেন। আমার ভাই ও বোন সবাই ভারতে থাকে। তাদের রেখে কীভাবে আমরা বাংলাদেশে যাই। এমন অবস্থা তো সব পরিবারে। সুতরাং কেউই যেতে চাইছে না। কিন্তু বাংলাদেশকে সব সময় আমাদের মনে থাকবে।  আপনারা ওপারে ভালো থাকবেন।’

 

রংপুর বিভাগীয় অতিরিক্ত কমিশনার (রাজস্ব) মিনু শীল ছাড়াও ওই প্রতিনিধিদলের সদস্যরা হলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ শাহ সাদ আন্দালিব, রংপুর জোনাল সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা আবদুল মান্নান, রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি কার্যালয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ জামান আশরাফ, লালমনিরহাটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আবদুল মোত্তালেব, পঞ্চগড়ের অতিরিক্তি জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মাহমুদুল আলম, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো যুগ্ম পরিচালক নাসির উদ্দিন আহম্মেদ ও কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এস এম আবু হোরায়রা।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ জুলাই ২০১৫/মোয়াজ্জেম/রাসেল পারভেজ/এএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়