ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

পাকশীতে মজার স্মৃতিচারণে শেষ হলো ছাত্রীদের পুনর্মিলনী

শাহীন রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪৪, ২০ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পাকশীতে মজার স্মৃতিচারণে শেষ হলো ছাত্রীদের পুনর্মিলনী

পাবনা প্রতিনিধি : ‘আমরা মিলেছি মনে ও মননে, মিলন মেলায়’ স্লোগানে প্রাক্তন ছাত্রীদের স্মৃতিচারণ ও নানা আয়োজনে শেষ হলো পাবনার পাকশী রেলওয়ে সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি উৎসব।

দুইদিনব্যাপী অনষ্ঠিত এই মিলন মেলায় স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রাক্তন ছাত্রীদের অনেকেই আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। তাদের কথায় কারো চোখে জল গড়িয়ে পড়ে, আবার কখনও হাসি ফুটে ওঠে।

শতবর্ষ পূর্তি উৎসব ও পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের দ্বিতীয়দিনে শনিবার স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থী নবীণ-প্রবীণের মিলনমেলা ঘটে। তার আগে শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে দুইদিনব্যাপী নানা আয়োজনের উদ্বোধন করা হয়।   

বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ এর সভাপতি, পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যাবস্থাপক (ডিআরএম) নাজমুল ইসলামের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে রাজশাহীর প্রধান প্রকৌশলী আফজাল হোসেন।

প্রধান অতিথি ছাড়াও অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- বিশেষ অতিথি ঈশ্বরদী উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ রশীদুল্লাহ, পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি ও শতবর্ষ উদযাপন কমিটির আহবায়ক হাবিবুল ইসলাম হবিবুল, জেলা পরিষদের সদস্য সাইফুল আলম বাবু মন্ডল, পাকশী বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ আরিফুল ইসলাম টুটুল, পাকশী বিভাগীয় বৈদ্যুতিক কর্মকর্তা খায়রুল ইসলাম, পাকশী রেলওয়ে সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষিকা জাহানারা বেগম এবং বর্তমান প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন।

এসএসসি পরীক্ষার বিভিন্ন ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্মৃতিচারণে অংশ নেন, কাজী সুরাইয়া (১৯৭২), হোসনে আরা আর্দ রোজি (১৯৬৩), ডা: জাকিয়া বানু (১৯৬৮), জিন্নাত আরা পাপড়ি (১৯৮৫), নুর লায়লা খানম রিমু (১৯৮১), মিলা মাহফুজা (১৯৭২), ডা: রোকিবা (১৯৭৭), শাহনাজ বেগম ডাইজী (১৯৮৯), ফরিদা রহমান (১৯৭১), মৌসুমি ইসলাম শান্তা (১৯৯৬), পান্নু আকতার (১৯৭৮), তোফাজ্জেল হোসেন তোফা হাসান (১৯৬৮), ইসমত আরা (১৯৮৩), সালমা রশীদ শিপ্রা (১৯৮৪), মালেকা পারভীন (১৯৭৯) সহ অনেকেই।



তার আগে বর্ষপূর্তি ও পুনর্মিলনী উদযাপন কমিটির আয়োজনে প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের ‘আমরা মিলেছি মনে ও মননে, মিলন মেলায়’ একটি হ্যান্ড ব্যাগে শতবর্ষপূর্তি মনোগ্রাম ক্যাপ, মগ, কলম, প্যাড দেওয়া হয়। আয়োজক কমিটি সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার ও বিকেলের নাস্তার টোকন তাদের সকলের হাতে তুলে দেয়।

এ সময় ব্যান্ড পার্টির তালে তালে দেশ-বিদেশ থেকে আসা শিক্ষার্থীরা শতবছর পূর্তির মনোগ্রাম সম্বলিত লাল, নীল, সবুজ, হলুদ ক্যাপ মাথায় পড়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। পরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এসময় সকল প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা এ্যাসেম্বলীতে অংশ নিয়ে সকলেই ফিরে যান হারানো উচ্ছল তারুণ্যে ভরা সেই শৈশবের দিনগুলোতে।

প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা দেশাত্মবোধক গানের তালে মনোমুগ্ধকর ডিসপ্লে প্রদর্শন করেন। এছাড়াও ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন লটারির ড্র ও জমকালো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।      

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রাক্তন ছাত্রী ফরিদা বেগম বলেন, ‘ছোটবেলা গরমের দিনে এক আনায় লাল টকটকে আইসক্রিম ছিল অমৃতের মত। একদিন ক্লাস চলাকালেই স্যার এর সামনেই মহা আনন্দে আইসক্রিম খাচ্ছিলাম। স্যার হুংকার ছাড়লেন। পণ করলাম, মার খেলেও আইসক্রিম ফেলা যাবে না, সেদিন বেত এর মার খেয়েও হাত থেকে আইসক্রিম ফেলিনি। দাম তো আর কম নয় ‘এক আনা’।’

প্রাক্তন ছাত্রী নুরুন্নাহার বেলি বলেন, ‘ক্লাসে আমরা ডানপিটে ছিলাম। হেডমিস্ট্রেস কথায় কথায় আমাদের কয়েকজনকে লেডিস গুন্ডা বলতেন। একবার প্রচন্ড গরমে রেলওয়ে থেকে প্রতি ক্লাসে একটি করে ফ্যানের বরাদ্দ হলো। দূর্ভাগ্যক্রমে সেগুলো ছাত্রীদের মাথার ওপর না লাগিয়ে লাগানো হলো শিক্ষকের মাথার ওপর। মনে করলাম এর একটা প্রতিবাদ হওয়া প্রয়োজন। চুলের ফিতায় ক’জনের স্যান্ডেলগুলো বেঁধে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দিলাম। ফ্যানের সাথে সাথে সমান তালে ঘুরতে লাগলো স্যান্ডেলের মালা। সেদিন সকলে নীরবে বেতের মার হজম করেছিলাম। আজ মনে হয়, সেদিন কাজটা হয়তো খারাপ করেছিলাম। আপার কাছে দোষ স্বীকার করে মাফ চাওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু ক্লাস সেভেনে পড়া মেয়ের কি বিবেক থাকে?’



প্রাক্তন ছাত্রী হুসনে আর্দ রোজি বলেন, ‘১৯৫৩ সালে আমি প্রথম শ্রেণির ছাত্রী ছিলাম। শৈশব-কৈশোরের স্বপ্ন ভূমি এই বিদ্যাপীঠে আজ নবীণ-প্রবীণদের মহামিলনে যে আনন্দধারা বইছে তা ভাষায় প্রকাশের নয়, তা শুধু অনুভবের, উপলব্ধির। স্কুল জীবনে তহমিনা, বানু ও রেখা আপার ভয়ে ক্লাসে পড়া বলতে গিয়ে মুখস্থ করা পড়াও ভুলে যেতাম।’

প্রাক্তন ছাত্রী সুলতানা ইয়াসমিন আরা পানু বলেন, ‘১৯৭৪ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর মামার বাড়িতে বড় হই। ১৯৭৮ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ১৯৮৫ সালে এখানে শিক্ষক হয়ে এলাম, তখন শিক্ষকদের সামনে চেয়ারে বসতে বিব্রত লাগতো।’     

মিলা মাহফুজ বলেন, ‘বাবার রেলওয়েতে চাকরির সুবাদে সৈয়দপুর থেকে পাকশীতে আসি। একতলা বাসার বদলে তিনতলা বাসা। শৈশবে বাসায় বসে বসে রেললাইন,  বৈচি ঝোপ পেরিয়ে উচুঁ স্টেশন দেখা যেত। আজ তা শুধুই স্মৃতি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকশী গার্লস স্কুলে এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল না। পাইলট নামে তখন পাকশী-ঈশ্বরদী ট্রেন চলতো। ট্রেনে চড়ে ঈশ্বরদী গিয়ে পরীক্ষা দিতে বেশ মজা লাগতো।’      

শুক্রবার বিকেলে বেলুন উড়িয়ে ১০০টি আতশবাজি ফুটিয়ে দুইদিনের এই উৎসব অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেছিলেন পাবনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামসুর রহমান শরীফ ডিলু।

উল্লেখ্য, পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার ব্যাবসায় প্রসার ও যোগাযোগ রক্ষার্থে সাঁড়া নামক গ্রামে একটি নদীর বন্দর স্থাপিত হয়। মোঘল ও নবাবী আমলে এই নদীবন্দর ছিল লস্করপুর এর অধীনে। পরগনা প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর বৃটিশ আমলে ১৯১৫ সালে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ প্রতিষ্ঠা হয়। সেতু নির্মাণের ফলে অবহেলিত সাধারণ গ্রাম পাকশী হিসাবে গুরুত্ব পায়। তখনি রেলওয়ে জেলার প্রধান দপ্তর প্রতিষ্ঠা হয়। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দপ্তরে কর্মকর্তার চেয়ে কর্মচারীর সংখ্যা বেশি ছিল বলে তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য ১৯১৮ সালে পাকশীতে একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ১৯২৪ সালে ছেলেদের জন্য ‘চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ’ প্রতিষ্ঠিত হলে এই প্রতিষ্ঠানটি রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় নামে জনপ্রিয়তা লাভ করে। বর্তমানে ৮৫০ জন ছাত্রী ও ১৬ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন।




রাইজিংবিডি/পাবনা/২০ জানুয়ারি ২০১৯/শাহীন রহমান/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়