![]() |
‘একটি গোপন কথা
পদ্ম জেনেছিল
পদ্ম তাই লজ্জায়
লুকিয়েছে মুখ
মীনদের মাঝে কোলাহল
পদ্মের হয়েছে আজ
কেমন অসুখ?’
-হুমায়ূন আহমেদ, কে কথা কয়
-
হুমায়ূনের সাহিত্য কর্মের মধ্যে ‘কে কথা কয়’ (২০০৬) আমার মতে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা। এমন দাবী করার আগে অবশ্যই মনে রাখতে হবে হুমায়ূনের সবচেয়ে বড় দোষ বা অপবাদ ছিল তিনি জনপ্রিয়তম লেখক। আমাদের সময়ে হুমায়ূন একাই সৃষ্টির পরিমাণে ও মানে দশজনের সমান। তিনি জনপ্রিয় হওয়ায় গ্রহণযোগ্য ছিলেন। অন্যদিকে জনপ্রিয়তার কারণেই তাকে তথাকথিত মূল ধারার সাহিত্য সমালোচকরা এড়িয়ে গেছেন, তিনিও তাদেরকে কাছে ভিড়তে দেননি। বরাবরই তিনি নিজের লেখা নিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতেন না। জনপ্রিয় হওয়ার অপরাধেই তাকে ক্ল্যাসিক বা সিরিয়াস সাহিত্যিক হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি। এই কারণেই সবচেয়ে বেশি আলগা মন্তব্য দেখা যায় হুমায়ূনের লেখার প্রতি।
কেউ কেউ মুখস্থ বিদ্যার মতোই বলে, ‘তার শুরুর দিকে দুয়েকটা লেখা (নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার) ভালো, শেষের দিকে চর্বিত চর্বন।’ এই ধরণের মন্তব্যগুলোতে অবশ্যই রেফারেন্স থাকে। কেউই আর লাইন ধরে, বই ধরে অসঙ্গতি বা দূর্বলতা তুলে ধরেন না। ফলে মতামতগুলো অনানুষ্ঠানিক বলেই গ্রহণ করতে পারি না। যাইহোক বলছিলাম, ‘কে কথা কয়’ উপন্যাস নিয়ে। এর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু। অটিজম নিয়ে লেখা সত্যিই ভীষণ কঠিন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, এ বিষয়ে প্রচুর পড়ালেখা করতে হয়।
বাংলাদেশের সাহিত্যে অটিজম নিয়ে যদি একটি উপন্যাসের কথাও বলা হয় তবে নিঃসন্দেহে ‘কে কথা কয়’ অন্যতম। কমল নামের এক অটেস্টিক শিশুর মাধ্যমে হুমায়ূন দারুণভাবে অটিজমের রহস্যময় জগত তুলে ধরেছেন। কমলকে সঙ্গ দেয়ার দায়িত্ব পড়ে মতিন উদ্দিন নামের একজনের উপর। মতিন উদ্দিন ভীষণ পড়–য়া, কবিতা লেখেন, কমলের সঙ্গে তার বোঝাপড়াও ভালো। মতিন উদ্দিন এক উজবেক কবি নদ্দিউ নতিমকে নিয়ে পত্র পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেন। এই নদ্দিউ নতিম আসলে কাল্পনিক চরিত্র। শেষের কবিতার নিবারণকে যেমন অমিত নিয়ে আসে নিজের সৃষ্টিকে তুলে ধরতে নদ্দিউ নতিম তেমনি মতিনের কাব্য প্রতিভাই তুলে ধরে। বিষয়বস্তু এবং বক্তব্যের চেয়েও এ আলোচনায় আমরা গুরুত্ব দিতে চাই নদ্দিউ নতিমের লেখা কবিতা নিয়ে।
উল্লেখ করা দরকার এই সব কবিতাই হুমায়ন আহমেদের মৌলিক কবিতা। কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার কাব্য প্রতিভা তুলে ধরেছেন নদ্দিউ নতিমের বরাত দিয়ে। একটি উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম এখানে নদ্দিউ নতিমের আরেকটা কবিতার উদ্ধৃতি দিই Ñ
‘ক্লান্ত দুপুর, মধ্য রজনীতে
প্রথম সকাল প্রথম সন্ধ্যারাতে
কে কথা কয়
ফিসফিসিয়ে আমার কথার সাথে?
তাকে চিনি
সত্যি চিনি না-কি?
তাকে চেনার কতটুকু বাকি?
নাকি সে স্বপ্নসম ফাঁকি?’
‘কে কথা কয়’ গল্পের প্রেক্ষাপট, চরিত্র নির্মাণ, বিষয় ও ভঙ্গি আলাদা করে আলোচনার দাবী রাখে। প্রিয় পাঠক, এখানে শুধু আপনাকে নজর দিতে মিনতি করি হুমায়ূন আহমেদ নামের প্রবল জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকের কবি সত্তার দিকে। এই কথাসাহিত্যিক যে চাইলেই কবি হতে পারতেন নদ্দিউ নতিমের বয়ানে লেখা কবিতাগুলো তার প্রমাণ হতে পারে। আধুনিক বাংলা কবিতার যে কোনো সংকলনে আলাদা করে হুমায়ূন আহমেদের কবিতা ছাপা হতে পারে। ‘কে কথা কয়’ উপন্যাসের আরেকটি কবিতা পড়া যাক Ñ
জলে কার ছায়া পড়ে
কার ছায়া জল?
সেই ছায়া ঘুরে ফিরে
কার কথা বল?
কে ছিল সেই শিশু
কি তাহার নাম?
কনে সে ছায়ারে তার
করিছি প্রণাম?
কথা সত্য, তিনি আলাদা করে কবিতা লেখেননি। গল্প, উপন্যাস, নাটক, রম্য রচনা, ভ্রমণ কাহিনি, কল্পবিজ্ঞান, ভৌতিক গল্প, শিশুতোষ মিসির আলি এবং হিমু উপাখ্যানÑ এক জীবনে সাহিত্যের কতো শাখাতেই হাত দিলেন হুমায়ূন। সাহিত্যের বাইরে নাটক নির্মাণ, চলচ্চিত্র নির্মাণ ইত্যাদিতেও মনোনিবেশ করেছিলেন গভীরভাবেই। যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই সাফল্যের সোনার হরিণ তার করতলগত আমলকি হয়েছে। অথচ বিস্ময়কর যে তিনি কবিতা লেখেননি। পাঠক হিসাবে মনে প্রশ্ন জাগে, এত এত পাঠক, ভক্ত আর প্রকাশক তার Ñ কারো কি মনে হয়নি কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ একজন ছদ্মবেশি কবি। খুবই সম্ভব ছিল তার হাত দিয়ে কবিতা লেখা। আমাদের বাংলা সাহিত্যের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে সুনীল, সৈয়দ হক সবাই কথা সাহিত্যের পাশাপাশি কবিতা লিখেছেন। কোনো এক রহস্যময় কারণে হুমায়ূন সে পথে যাননি। অথচ আমরা তার স্মৃতি কথা থেকেই জানি তার জীবনের প্রথম লেখাটি কবিতা। ছোটবোন সেফুর নামে ইত্তেফাকের নারীদের সাময়িকী ছাপা হয়েছিল তার কবিতা। সেটিই ছাপার অক্ষরে লেখা তার প্রথম ও শেষ কবিতা। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি আর সরাসরি কবিতা লেখেননি। তার সেই কবিতা ‘শঙ্খনীল কারাগার’ উপন্যাসে ব্যবহৃত হয়েছিল।
দিতে পারো একশ ফানুস এনে
আজন্ম সলজ্জ সাধ একদিন আকাশে কিছু ফানুস ওড়াই৷
মাত্র দুই লাইনের এই কবিতাতেও হুমায়ূন আহমেদ যে কবি তা স্পষ্টতই বোঝা যায়।
এ প্রসঙ্গে হুমায়ূনের গদ্য থেকেই একটু উদাহরণ দিতে চাই। উদ্ধৃতি হুবুহু দিচ্ছি, তবে লাইনগুলো একটু বিন্যস্ত করে দিচ্ছি -
‘এই ক্ষুদ্র জীবনে আমি বারবার দুঃখ পেয়েছি।
বারবার হৃদয় হা-হা করে উঠেছে।
চারপাশের মানুষদের নিষ্ঠুরতা,
হৃদয়হীনতায় আহত হয়ে
কতবার মনে হয়েছে Ñ
এই পৃথিবী বড়ই বিষাদময়!
আমি এই পৃথিবী ছেড়ে
অন্য কোনো পৃথিবীতে যেতে চাই,
যে পৃথিবীতে মানুষ নেই।
চারপাশে পত্রপুষ্প শোভিত বৃক্ষরাজি।
আকাশে চির পূর্ণিমার চাঁদ।
যে চাঁদের ছায়া পড়েছে মূয়রাক্ষী নামের এক নদীতে।
সেই নদীর স্বচ্ছ জলে সারাক্ষাণ খেলা করে জোছনার ফুল।
দূরের বন থেকে ভেসে আসে অপার্থিব সংগীত।’
পাঠক, ‘আমার ছেলেবেলা’ নামের স্মৃতিচারণ গ্রন্থের এই অংশটুকুর মতোই অনেক জায়গায়ই হুমায়ূন দারুণ কাব্যময়। আমি আজও বিস্মিত হবো না হঠাৎ যদি কোথাও থেকে হুমায়ূন আহমেদের অপ্রকাশিত একগুচ্ছ কবিতা আবিষ্কার হয়ে যায়। যেমন- জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর বিস্ময়কর আর বিশাল এক গদ্য ভাণ্ডার আবিষ্কৃত হলো। আমার মনে গোপন আশা, হুমায়ূন আহমেদের কোনো গোপন কুঠুরি থেকে তেমনি বেরিয়ে আসবে বিশাল কাব্য ভাণ্ডার। প্রায়শই মনে হতো, কবিতার দিকে হুমায়ূন আহমেদ অনেক বেশি আকৃষ্ট। তার লেখা গানের মধ্যেও আমরা কবিতা পাই। তার বহু বইতে দেশি বিদেশি অসংখ্য ভালো কবিতার উদ্ধৃতি পাই। বইয়ের নামকরণেও তিনি কবিতার হাত ধরেছেন বারবার। তার পঠন তালিকার একটা বড় অংশও কবিতা।
কবিতা বান্ধব এক পরিবেশে বড় হয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। তার লেখালেখির সবচেয়ে বড় প্রেরণা তাঁর বাবা। আত্মজীবনী মূলক লেখাগুলো বারবার তার বাবার কাব্যপ্রীতির কথা আমরা পাই।‘আমার ছেলেবেলা’তে পাই -
জন্মদিন এসে গেল। গান, কবিতা আবৃত্তির পালা শেষ হবার পর আমার হাতে উপহারের প্যাকেট তুলে দেয়া হলো। প্যাকেট খুলে দেখি একটা বাঁধানো ফ্রেমে দীর্ঘ একটি কবিতা। বাবা ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে একটি কবিতা লিখে ফ্রেমে বাঁধিয়ে নিয়ে এসেছেন। কবিতার প্রথম দু’টি চরণ -
সাতটি বছর গেল পরপর আজিকে পরেছো আটে,
তব জন্মদিন নয়ত মলিন ভয়াল বিশ্ব হাটে ...
বাবা খুবই আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি রে, উপহার পছন্দ হয়েছে? অনেক কষ্টে কান্না চাপা দিয়ে বললাম, হ্যাঁ।
তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে পছন্দ হয় নাই।
আমি চুপ করে রইলাম।
বাবা খানিকক্ষণ শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘এই উপহার এখন তোর কাছে সামান্য মনে হচ্ছে। এমন একদিন আসবে যখন আর সামান্য মনে হবে না।’
বাবা কবি ছিলেন না। হৃদয়ের তীব্র আবেগ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে তিনি কবিতার আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর অতি আদরের ছোটবোনের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর তিনি কাঁদতে কাঁদতে কবিতা লিখতে বসেছেন। চোখের জলে লেখা সেই দীর্ঘ কবিতা হয়ত শুদ্ধতম কবিতা হয়নি। কিন্তু যে আবেগের তাড়নায় কলম হাতে নিয়েছিলেন সেই আবেগে কোন খাদ ছিল না। বাবার কাছ থেকে প্রথম শিখলাম, মনের তীব্র ব্যথা কমানোর একটি উপায় হচ্ছে কিছু লেখা। যে লেখা ব্যক্তিগত দুঃখকে ছড়িয়ে দেয় চারদিকে।
বাবা হচ্ছেন আমার দেখা প্রথম কবি
স্বাভাবিক কারণেই আট বছরের শিশুর জন্মদিনে হাতে লেখা কবিতা উপহার হিসেবে ভাল লাগবে না। কিন্তু যথা সময়ে সে উপহার অসামান্য হয়ে উঠবেই। হুমায়ূনের বাবা কবিতার বীজ বপন করে দিয়েছিলেন সচেতনভাবেই। তিনি সন্তানদের মধ্যে কবিতা বোধ জাগানোর চেষ্টায় সদাই সচেতন ছিলেন। ‘আমার ছেলেবেলা’-তেই পাই Ñ
দিনের পর দিন কাঁটতো, তাঁর সঙ্গে আমাদের কথা হত না। এই কারণে মনে মনে চাইতাম তাঁর যেন কোনো-একটা অসুখ হয়। বাবার অসুখ খুবই মজার ব্যাপার।। অসুখ হলে তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের চারপাশে বসিয়ে উঁচুগলায় কবিতা আবৃত্তি করতেন। এতে নাকি তাঁর অসুখের আরাম হত।
এই অসুখের সময়ই তিনি একবার ঘোষণা করলেন, সঞ্চয়িতা থেকে যে একটা কবিতা মুখস্থ করে তাঁকে শোনাতে পারবে সে এক আনা পয়সা পাবে। দুটো মুখস্থ করলে দু’আনা।
আমি বিপুল উৎসাহে কবিতা মুখস্থ করতে শুরু করলাম। এর মধ্যে কোন কাব্যপ্রীতি কাজ করেনি। আর্থিক ব্যাপারটাই ছিল একমাত্র প্রেরণা। যথাসময়ে একটি কবিতা মুখস্থ হয়ে গেল। নাম ‘এবার ফেরাও মোরে’। দীর্ঘ কবিতা। এই দীর্ঘ কবিতাটা মুখস্থ করার পেছনের কারণ হলো, এটা বাবার খুব প্রিয় কবিতা। তাঁদের সময় না-কি বি.এ ক্লাসে পাঠ্য ছিল।
বাবা আমার কবিতা আবৃত্তি শুনলেন।
কোনো ভুল না করে এই দীর্ঘ কবিতাটি বলতে পারায় তিনি আনন্দে অভিভূত হলেন। এক আনার বদলে চার আনা পেয়ে গেলাম। সাহিত্যবিষয়ক কর্মকাণ্ড থেকে ওটাই ছিল আমার প্রথম রোজগার।
কবিতা রোগ নিরাময়ের হাতিয়ার এই ধারণাটা একজন লেখক ছোটবেলায় বাবার কাছেই পেয়ে গেলেন। সাহিত্যবিষয়ক কর্মকাণ্ড করে হুমায়ূন সারা জীবনে অনেক রোজগার করেছেন। কিন্তু কবিতার এই আয় সত্যিই প্রেরণাদায়ক।
‘কে কথা কয়’র এক দশক আগে হুমায়ূন লিখেছিলেন, কবি (১৯৯৬)। একই শিরোনামে বাংলাসাহিত্যের আরেক দিকপাল তারশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন। সেটির তুলনায় হুমায়ূনের কবি আকারে প্রকারে বৃহৎ। তারাশঙ্করের চোর নিতাই কবি হয়ে ওঠে। আর হুমায়ূনের কবি উপন্যাসে একজন নয়, তিন জন কবির কথা বলা হয়েছে। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র আতাহার, তার বিত্তবান বন্ধু সাজ্জাদ এবং বোহেমিয়ান বন্ধু মজিদ Ñ তিনজনই কবি। কবিতাই তাদের ধ্যান-জ্ঞান। তুলনায় মজিদ ও সাজ্জাদের চেয়ে আতাহারের পড়ালেখা এবং পাগলামি দুটোই কম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মজিদ আটকা পড়ে ভালোবাসায়। জাহেদা নামের এক গ্রাম্য কিশোরীর প্রেমে পড়ে সে। বন্ধুদের চিঠি লিখে বিয়ের সংবাদ দেয় কিন্তু আসতে মানা করে। সে জানে একটি প্রিয় জিনিস পেতে হলে আরেকটি প্রিয় জিনিস ছাড়তে হবে। তাই সে কবিতাকে ছেড়ে দেয় জাহেদার জন্য। অন্যদিকে সাজ্জাদ জীবনকে নিয়ে নানা এক্সপেরিমেন্ট করে। সে এমনকি ভয়াবহ নেশায় আক্রান্ত হয়। শেষ পর্যন্ত তাকে মানসিক চিকিৎসা নিতে হয়। শৈশবে তাদেরকে ফেলে অন্য পুরুষের সঙ্গে মার চলে যাওয়া সে মেনে নিতে পারে না। এমনকি খুব শৈশবেই সে খুনের চেষ্টাও করে। সাজ্জাদের ছোটবোন নিতু আজাহারকে ভালোবাসে। আজাহার ও নিতু আপাতভাবে মনে মনে পরস্পরকে ভীষণ অপছন্দ করে। সব কিছুর পর তিন কবির মধ্যে আতাহারই কবিতার পথে হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমেরিকার অভিবাসী হওয়ার সুযোগও সে গ্রহণ করে না। এমনকি ভয়াবহ অসুস্থ আতাহার মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েও করোটিতে কবিতা অনুভব করে।
‘কবি’ উপন্যাসের শুরুতে হুমায়ূন প্রারম্ভিকে লিখছেন, ‘কবি’ উপন্যাসে কিছু কবিতা ব্যবহার করতে হয়েছে। অতি বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি কবিতাগুলো আমার লেখা। পাঠক পাঠিকারা আমার দুর্বল গদ্যের সঙ্গে পরিচিত। সেই গদ্য তাঁরা ক্ষমা সুন্দর চোখে গ্রহণ করেছেন। কবিতাগুলোও করবেন Ñ এই অসম্ভব আশা নিয়ে বসে আছি। ক্ষমা পেয়ে পেয়ে আমার অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। প্রিয় পাঠক, আসুন পড়ে দেখি, বিনয়ী কবির লেখা কবিতা -
১.
একটা ঝকঝকে রঙিন কাচপোকা
হাঁটতে হাঁটতে এক ঝলক রোদের মধ্যে পড়ে গেল।
ঝিকমিকিয়ে উঠল তার নকশাকাটা লাল নীল সবুজ শরীর।
বিরক্ত হয়ে বলল, রোদ কেন?
আমি চাই অন্ধকার । চির অন্ধকার
আমার ষোলটা পায়ে একটা ভারি শরীর বয়ে নিয়ে যাচ্ছ-
অন্ধকার দেখবে বল।
আমি চাই অন্ধকার । চির অন্ধকার
একটা সময়ে এসে রোদ নিভে গেল
বাদুড়ে ডানায় ভর করে নামল আঁধার।
কি গাঢ়, পিচ্ছিল থকথকে অন্ধকার !
কাচপোকার ষোলটা ক্লান্ত পা বার বার
সেই পিচ্ছিল আঠালো অন্ধকারে ডেবে যাচ্ছিল।
তার খুব কষ্ট হচ্ছিল হাঁটতে
তবু সে হাঁটছে-
তাকে যেতে হবে আরও গভীর অন্ধকারে।
যে অন্ধকার-আলোর জন্মদাত্রী।
২.
শোন মিলি।
দুঃখ তার বিষমাখা তীরে তোকে
বিঁধে বারংবার।
তবুও নিশ্চিত জানি, একদিন হবে তোর
সোনার সংসার ।।
উঠোনে পড়বে এসে এক ফালি রোদ
তার পাশে শিশু গুটিকয়
তাহাদের ধুলোমাখা হাতে - ধরা দিবে
পৃথিবীর সকল বিস্ময়।
৩.
এক জরাগ্রস্থ বৃদ্ধ ছিলেন নিজ মনে
আপন ভুবনে।
জরার কারণে তিনি পুরোপুরি বৃক্ষ এক।
বাতাসে বৃক্ষের পাতা কাঁপে
তাঁর কাঁপে হাতের আঙ্গুল।
বৃদ্ধের সহযাত্রী জবুথবু-
পা নে্ই, শুধু পায়ের স্মৃতি পড়ে আছে।
সেই স্মৃতি ঢাকা থাকে খয়েরি চাদরে।
জরাগ্রস্থ বৃদ্ধ ভাবে চাদরের রঙটা নীল হলে ভালো ছিল।
স্মৃতির রঙ সব সময় নীল।
হুমায়ূনের গদ্য কেবল বিনয় করেই দূর্বল বলা যায় কবিতাকে তাই বলা যায়। কিন্তু যথার্থ অর্থেই কবি উপন্যাসে ব্যবহৃত প্রায় প্রতিটি কবিতাই ভীষণ কাব্যময়। আরেকটি মজার কাজ তিনি করেছেন এই উপন্যাসে। তিনি শুধু আতাহারের হাত দিয়ে কবিতাই লেখাননি, কবিতা তৈরির প্রক্রিয়াটিও তুলে ধরেছেন। এই উপন্যাসে সাধারণ পাঠককে কবি ও কবিতার অন্দরমহলের কিছুটা খোঁজ হলেও দেবে। সেই সঙ্গে কবিতার ছন্দ, জীবনানন্দ এবং কবিতার অনুবাদ প্রসঙ্গে টুকটাক কথা উঠে এসেছে এই উপন্যাস। কবি ও কবিতাপ্রেমীরা হুমায়ূন আহমেদের ‘কবি’ উপন্যাসটি পড়ে দেখতে পারেন।
লেখাটা শেষ করতে চাই শ্রীলঙ্কার কবি জেন-এর লেখা একটি কবিতা দিয়ে। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আইওয়াতে লেখক সম্মেলনে থাকার সময় তিনি এটি লিখেছিলেন। আগ্রহী পাঠক মে ফ্লাওয়ার থেকে বিস্তারিত জেনে নেবেন।
DESH
[Poem for Humayun]
Beside your wife’s bed side awaiting the birth
Of your child you uttered the name of God
Many times
Allah0U-Akbar _
This was not your country
You were far away but is one ever apart
For those gods who are so intimate
A part of your life?
You will never be alone here
Even in the snowy deserts of winter
Or when the tress shed all the leaves in Fall.
When you pray for the safety of mother of Chils.
The gods have a way of following you
And you of talking them with you
Just as, over the oceans, you carry
A little of the Desh, the earth of your
Country and when you are lonely, touch it
As you would its field, its rivers and its trees
And feel that this is your home.
It is where you belong.
I also remember you words, friend,
`My mother told me, fill your palm
With some soil the Desh
When my daughter was born
Or else, the baby will cry for the soil’’
But those, tear won’t the irrigate
The arid earth of our lives?’’
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ নভেম্বর ২০১৬/মুম/শান্ত