ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে পাকিস্তানের বন্ধু দেশে গিয়ে লিখুন’

নৃপেন রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০৬, ২৬ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে পাকিস্তানের বন্ধু দেশে গিয়ে লিখুন’

নিজস্ব প্রতিবেদক : গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে পাকিস্তানের বন্ধু দেশগুলোতে গিয়ে বেশি করে একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে লেখার এবং বলার আহ্বান জানিয়েছেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির।

বুধবার বিকেলে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুবার্ষিকী ও স্মারক বক্ততা অনুষ্ঠানের সূচনা বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।

শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘পাকিস্তানের তরুণ দুজন লেখক আমাদের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ এসেছেন। এদের ব্যাপারে আমরা আগে খুব একটা জানতাম না। ইসলামাবাদে আমাদের হাইকমিশনার প্রথম এটা দৃষ্টিতে আনেন।’

পাকিস্তানি লেখক আনাম জাকারিয়া সম্পর্কে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘এবছর আমাদের সরকার ২৫ মার্চ যখন গণহত্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নিল তখন আনাম জাকারিয়া ২৫ মার্চ পাকিস্তানের একটি কাগজে আমাদের গণহত্যা নিয়ে লিখে নজরে এসেছেন। তিনি লিখেছেন, এটা হচ্ছে সেই গণহত্যা যেটা পাকিস্তান ভুলে যেতে চায়; বাংলাদেশ যা কখনো ভুলতে চায় না।’

পাকিস্তানি অপর লেখক হারুণ খালিফ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তার মূল কাজ হচ্ছে মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে। পাকিস্তান একটি মৌলবাদী, জঙ্গি ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। সেখানে অন্য ধর্ম বিশেষ করে হিন্দুদের শেষ করে ফেলা হয়েছে, এখন যে কয়জন খ্রিস্টান আছে, তাদেরকে ব্লাসফেমি আইনে নানাভাবে নিগৃহীত করা হচ্ছে। তিনি এই সাম্প্রদায়িক বিষয়গুলোকে তুলে এনেছেন। এ কারণে আমরা এদেরকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। এরা প্রধানত এসেছেন গণহত্যার তথ্য প্রমাণ সংগ্রহের জন্য। যারা ভুক্তভোগী, যারা সন্তান হারিয়েছেন, স্বজন হারিয়েছেন বা যারা পিতা মাতা হারিয়েছেন তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা সময় স্বল্পতার কারণে সব জায়গায় যেতে পারিনি। আমরা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটে গিয়েছি। চুপনগর হচ্ছে বাংলাদেশে গণহত্যার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি। এ সময় চুপনগরের একটি ঘটনার বিবরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা চুপনগরের গেলাম। সেখানকার একজন ভিকটিম হচ্ছেন সুন্দরী বালা। সুন্দরী বালা হচ্ছেন সেই ২০ মে’র ভিকটিম।

চুপনগরে একটা বিশাল মাঠ। মাঠটি ভদ্রা নদীর তীরে। সেই মাঠে দশ হাজারের উপর মানুষকে পাকিস্তানিরা হত্যা করেছে ৫ঘণ্টায়। কিন্তু সেখানে একজন মাত্র মানুষ জীবিত ছিলেন। ওখানকার একজন স্থানীয় কৃষক বলেছেন, তার বাবাকেও সেখানে হত্যা করা হয়েছে। তিনি তার বাবার লাশ খুঁজে পাওয়ার পর হাজার হাজার লাশের মধ্যে একজনও বেঁচে আছেন কি না, তা খুঁজছিলেন? তিনি সারা মাঠ খুঁজে দেখলেন কিন্তু জীবীত কাউকে পেলেন না। হঠাৎ তার নজরে পড়ল ছোট্ট কি যেন একটা নড়ছে। তিনি দেখলেন একটা শিশু। ছয় সাত মাস বয়স হবে। কন্যা শিশু। সে তার মৃত মায়ের স্তন পান করার চেষ্টা করছিল। তার মা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। তিনি তার মাকে চিনতে পারলেন। তার মায়ের হাতে শাঁখা এবং মাথায় সিঁদুর। এটা দেখে তিনি বুঝলেন মা হিন্দু সম্প্রদায়ের। পুরো পরিবারটি নিহত হয়েছে। শুধু একটি ছয় সাত মাসের বাচ্চা বেঁচে ছিল। এই হচ্ছে সুন্দরী বালা। এরশাদ মোড়ল তাকে উদ্ধার করেছেন। তিনি একজন গ্রামের হত দরিদ্র কৃষক। তিনি এই মেয়েটিকে বুকে তুলে নিয়েছিলেন। তিনি তার বাড়িতে এনেছেন এবং লালন করছিলেন। কিন্তু পরে তার মনে হল, সে যেহেতু হিন্দু পরিবারে জন্ম নিয়েছে। তাই হিন্দু ধর্মীয় পরিচয়ে তাকে মানুষ করা দরকার। তার একজন হিন্দু বন্ধু ছিলেন। সেও গরীব কৃষক। তার কাছে রেখে সুন্দরীকে তিনি লালন করেছেন।

সুন্দরীকে আনাম জিজ্ঞেস করেছিলেন একাত্তরের কথা। সুন্দরী বলেছেন, একাত্তরের কথা তো আমি শুনেছি। আমি তো কিছু দেখিনি। সব আমি হারিয়েছি। কিন্তু আমার যে লড়াই এই ৪৬ বছর, আমাকে ভিক্ষা করে খেতে হয়েছে, কখনও দিন মজুরি করে খেতে হয়েছে। আমার পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলেছে। সুন্দরী তার এই ৪৬ বছরের জীবন সংগ্রামের কথা বলেছে। আর বলেছে, আমাদের সরকার তাকে ১১ কাঠা জমি দিয়েছে ঘর তৈরির জন্য। আর শিল্পকলা একাডেমীতে একটা চাকরি দিয়েছে। এখন তিনি অন্তত কিছুটা ভদ্র জীবন যাপন করতে পারছেন। তাকে ভিক্ষা করতে হয় না।

আনাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এই ৪৬ বছর পর তোমার বাবাকে যারা মেরেছে, সেই তাদের দেশ থেকে দুজন মানুষ তোমাকে দেখতে এসেছে। তোমার কেমন লাগছে এটা?
এর জবাবে সুন্দরী বলেছেন, আমি আমার বাবা-মাকে ফেরত পাব না। ৪৬ বছর আমার যে কষ্ট গেছে, সেটা গেছে। কিন্তু তোমরা যে ৪৬ বছর পর আমার ও আমাদের দুঃখ যন্ত্রণা, আমাদের কষ্ট জানতে এসেছে, এই জন্য আমি খুশি। তোমরা অন্তত ফিরে গিয়ে তোমাদের দেশের মানুষকে বলতে পারবে, আমাদের উপর কি রকম অত্যাচার করেছিল? কীভাবে আমাদের মেরেছে? কীভাবে আমাদের পথে বসিয়েছে।

আনাম জাকারিয়া তাকে কিছু উপহার দিয়েছেন। সুন্দরী তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছেন।’

শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আমি আনামকে বলেছিলাম, আনাম এই স্বীকৃতিই চায় বাংলাদেশের মানুষ। তোমাদের সরকার গণহত্যা অস্বীকার করছে। তোমাদের মতো মানুষরা হয়ত কয়েকজন মানুষ, যারা বলছেন, এটা স্বীকার করতে হবে, ক্ষমা চাইতে হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এখন সময় এসেছে, এটার সরকারিভাবে ক্ষমা চাইবার। এটাই হচ্ছে আমাদের উদ্দেশ্য তোমাদেরকে এখানে নিয়ে আসার। তোমরা ফিরে গিয়ে গণহত্যা নিয়ে আরো লিখবে।’

শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আমাদের গণহত্যার বিষয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য এখন আমরা চেষ্টা করছি। আমরা মনে করছি যে, আমাদের পাকিস্তানি বন্ধুরা যত বেশী গণহত্যার কথা তাদের দেশে লিখবেন এবং বলবেন, ওই জনমত পাকিস্তানকে সংগঠিত এবং আন্তর্জাতিকভাবে জনমত সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।’

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা বিচারপতি শামসুল হুদার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতা করেন পাকিস্তানের মানবাধিকার নেতা কবি আহমদ সালিম। এ ছাড়া আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন পাকিস্তানের মৌলবাদবিরোধী লেখক হারুণ খালিদ, আনাম জাকারিয়া, নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল মোঃ আবদুর রশীদ (অবঃ), শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তান ডাঃ নুজহাত চৌধুরী ও শমী কায়সার।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ জুলাই ২০১৭/নৃপেন/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়