ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

আষাঢ়ে গল্প : রবীন্দ্রনাথ যে কারণে বাংলায় ফেল করেছিল

জন রাসেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৬, ৯ আগস্ট ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আষাঢ়ে গল্প : রবীন্দ্রনাথ যে কারণে বাংলায় ফেল করেছিল

জন রাসেল

রবির মন আজ ভীষণ খারাপ। আজ এইচএসসি’র রেজাল্ট দিয়েছে। সকাল থেকেই টেনশন হচ্ছিল। অনলাইনে এডুকেশান বোর্ডের ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখল সব সাবজেক্টেই তার এ প্লাস মিস হয়ে গেছে। তার মোট জিপিএ-১.৫০। এটা কোনো কথা হলো!
সারাদিন রুটির দোকানে কাজ করে কাজী যেখানে পেল ৪.৫০, সেখানে রবির এই রেজাল্ট অকল্পনীয়। এখন সে মুখ দেখাবে কী করে? রবির ধারণা কাজী পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্ন পেয়েছিল। ও যে নান রুটির দোকানে কাজ করে সেখানে ওয়াইফাই কাজ করে। সেই ওয়াইফাই থেকেই এই ফর্দাফাই। না হলে তার এত ভালো করার কথা না।

রবির বাংলা পরীক্ষাটা অবশ্য একটু খারাপ হয়েছিল। সেখানে একটা প্রশ্ন এসেছিল, রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতাটির প্রথম দশ লাইন ব্যাখ্যা কর?
রবি অনেক ভেবেও এই কবিতার একটি লাইনও মনে করতে পারছিল না। অগত্যা সামনের সিটে বসা কাজীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল ফিসফিস করে। কাজী তখন মনোযোগ দিয়ে হৈমন্তীর চরিত্র ব্যাখ্যা করছিল বিদ্রোহী ভাষায়। এমন সময় রবির ফিসফিস, এই কাজী, শুনতে পাচ্ছিস? সত্যি বলছি, পরীক্ষার পর তোকে কেএফসিতে মুরগি ভাজি খাওয়াব। একটু পেছন ফিরে তাকা না।

কেএফসি’র কথা শুনেই নাকি কে জানে, কাজী তাকিয়েছিল। কিন্তু সাহায্য করতে পারেনি। উল্টো বলে দিয়েছিল, কর্তা, মোরে ক্ষমা করো, সময় খুব অল্প বাকি। আমি পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের ব্রড কোয়েশ্চেনের আনসার করিতেছি। কুবের বাবা হইতে যাইতেছে, সেন্সেটিভ মোমেন্ট! তুমি বাবু এ সময় আর যন্ত্রণা কোরো না।

না। এরপর রবি আর যন্ত্রণা করেনি। মনে মনে শুধু বলেছিল :
‘শুনে রাখ হে কাজী-
তুই যে এত পাজি
তাহা আমি ঠাওর করিনি আগে
রাগে আজ আমার বিষম জাগে।’

রবি রাগে গজগজ করতে লাগল। কাজীর ব্যাটা বলে কী! ‘সোনার তরী’ নাকি তার পড়া নাই। সেসব নাকি বাজে। সে ‘যৌবনের গান’ থেকে আনসার করবে। ফাউল পোলাপান কোথাকার! সামান্য রুটির দোকানে কাজ করে কি তেজ! পরীক্ষাটা শেষ হোক, তারপর বাইরে বের হয়ে দেখাবে মজা।

রবি অসহায় দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাল। দুই বেঞ্চ সামনেই শরৎ বসা। সে ক্লাসের ফার্স্টবয়। এদের ডাকলেও রা করবে না। এরা ভীষণ সিরিয়াস ছাত্র। বাম দিকের কোণায় পরীক্ষা দিচ্ছিল রোকেয়া। রবি তারই শরণাপন্ন হলো। প্রথমে ভাব জমাতে বলল, পরীক্ষা কেমন দিচ্ছ গো? তোমাকে দেখতে কিন্তু বেশ লাগছে আজ।
রোকেয়া পাত্তা দিল না। রবির গা জ্বলে গেল। এই মেয়ে নিজেকে ভাবে কি? রবির দুই বেঞ্চ পেছনে ছিল জসীমউদ্দীন। জসীম মোটামুটি মেধা রাখে। টেনে টুনে উত্রে যায় আর কি! জসীমউদ্দীন খাতায় ‘কবর’ কবিতার বৃদ্ধ দাদুর করুণ কাহিনি লিখছে আর একটু পর পর রুমাল দিয়ে চোখ মুছছে। রবি তাকেই আস্তে করে ডাক দিল।

শুনেই ফিরে তাকাল জসীম। তারপর উচ্ছ্বাসে বলল, আরে রবি যে! বলো কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
জইস্যা তুই আমাকে বাঁচা প্লিজ! ‘সোনার তরী’ কবিতার কোনো লাইন কি তোর মনে আছে?
থাকবে না কেন? সোনার তরীর মতো কবিতা বাংলা সাহিত্যে আর আছে? এই কবিতা যিনি লিখেছেন তিনি এই ভুবনের সেরা কবি। এ কবিতা গাছে ধরে না।
প্রশংসা শুনে রবি মনে মনে খুব খুশি হলো। যাক্ জসীমউদ্দীন অন্তত কবিতাটির মর্ম বুঝেছে। ওর মনটা ভালো। মাটির মায়ামাখা। রবি দ্রুত বলল, তাহলে বল দেখি দুটা লাইন।
জসীমউদ্দীন তরতর করে লাইনগুলো বলে দিয়েছিল তখন :
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাশি।’

পুরোটা লিখে রবি পরীক্ষার হল থেকে বের হয়েছিল সেদিন। ও! জসীমকে সে কেএফসিতে মুরগি ভাজিও খাইয়েছিল। অথচ আজ রেজাল্ট তার এ কি হলো! রবি কিনা বাংলায় ফেল! এখন ইচ্ছা করছে জইস্যাকে ধরে এমন ধোলাই দেয় যে, তার কান্নায় পুরো ধোলাই খালটাই ডুবে যায়। পাজির হতচ্ছাড়া! এমন ভুল কবিতা বলার কি দরকার ছিল। বলবি না, কাজীর মতো মুখের ওপর বললেই হতো। তাহলেই তো সে আজ আর বাংলায় ফেল করতো না।  

রবি দুপুরের পর থেকে কিছু মুখে দিতে পারে নি। অথচ বন্ধুরা মিষ্টি বিতরণ করছে। বিভূতি এসেছিল একটু আগে মিষ্টি নিয়ে। রবি ওর রেজাল্ট শুনে হা হয়ে গিয়েছে। যদিও সেই হা করা মুখ দিয়ে মিষ্টি ঢোকেনি। তারা ইনবক্স করেছে, এক সাবজেক্টের জন্য গোল্ডেন ছুটে গেছে তার আকাশের ওই খসে পড়া তারার মতোই। বিকেলে পাড়ার মাতব্বরের ছেলে মধু এসে কী মধুর মধুর কথাই না বলে গেল। সঙ্গে মরণচাঁদের রসমালাই নিয়ে এসেছিল। কিন্তু সেই রস রবির টক লেগেছে। এসব দেখে রবির মন আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সবাই তার চেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছে।

রবি এবার বড় ভাই বঙ্কিমকে ফোন দিল। বঙ্কিম তখন আজিজের আড্ডা শেষ করে তিন নাম্বারে ঝুলে বাসায় ফিরছিল। সে ঝুলন্ত অবস্থাতেই ফোনটা কানে ঠেকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, আরে রবি কী খবর তোর?
আর বোলো না।
কেন কী হয়েছে?
আমার রেজাল্ট দিয়েছে আজ।
সে তো ভালো খবর!
ভালো না ছাই!
এবার বুঝেছি। বঙ্কিম রবিকে সান্ত্বনা দেয়, শোন, মন খারাপ করিস না। সবাই তো আর বিদ্যাসাগর হতে পারে না। এই আমাকে দ্যাখ, আমারও তো পড়াশোনা ভালো লাগে না। কাল শাহবাগে চলে আয়, চুটিয়ে আড্ডা দেয়া যাবে। ওসব লেখাপড়া দিয়ে কী হবে অ্যা? তাছাড়া আমিও কী এক চান্সে পাস করেছিলাম নাকি?

বঙ্কিমের কথা শুনে রবির মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে গেল। সে কানে ফোনটা রেখেই মাথাটা কাৎ করে ওই বঙ্কিম হয়েই বলল, ওকে, কাল আসব শাহবাগে। বঙ্কিম হ্যাঁ হ্যাঁ ওকে ওকে করতে করতেই লাইনটা ওপাশ থেকে কুট করে কেটে গেল।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ আগস্ট ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়