ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘শিল্প চর্চায় ভিন্নতাটুকু ফুটে ওঠে সৃষ্টিশীল পরিসরে’

বাসু দাশ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪৭, ২৭ আগস্ট ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘শিল্প চর্চায় ভিন্নতাটুকু ফুটে ওঠে সৃষ্টিশীল পরিসরে’

ছবি আঁকায় মশগুল শিল্পী মং মং শো

সবুজ পাহাড়ের সঙ্গে মেঘমালার মিতালী, পাহাড়ের বুকে আদিবাসীদের মাচাং ঘরে বসবাস, জুম চাষ, অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর ১১টি জাতিবৈচিত্রে সমৃদ্ধ বান্দরবান। এই বান্দরবানে বেড়ে ওঠা এক তরুণ মং মং শো। বর্তমানে এই আঁকিয়ে শিল্পের টানেই সুদূর চীনে বসবাস করছেন।

 

তার শিল্পের গভীরতা ও ক্যানভাসে রংয়ের ব্যবহারে রয়েছে হাজারো বছরের প্রাচীন চীনের ধারাবাহিকতা, অন্যদিকে আধুনিক শিল্প ভাবনার মিশ্রণ। অনলাইনে সেই মং মং শোর সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন রাইজিংবিডির বান্দরবান প্রতিনিধি এস বাসু দাশ।

 

বাসু দাশ : আপনার বেড়ে ওঠা, শিক্ষা জীবন এবং পরিবার নিয়ে কিছু বলুন-

মং মং শো : আমার জন্ম কক্সবাজারের মহেশখালী। জীবিকার প্রয়োজনে বাবা মার সঙ্গে বান্দরবানে আসা। পড়াশোনা বান্দরবান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি কলেজ। তারপর ইউনিভার্সিটিতে পড়ার কারণে বান্দরবানে আর তেমন থাকতে পারলাম না। বাবা আঁকা আঁকি করতেন, তাই হয়তো ছোটকাল থেকে ছবি আঁকতে পছন্দ করতাম। আঁকিয়ে হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। আর স্বপ্নটা আরো গভীর হয়েছে বিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষক আমিনুর রহমান এবং আমার স্কুল বন্ধুদের উৎসাহে। আর বাবা-মা তো আছেনই।

 

বাসু দাশ : বর্তমানে কী করছেন?

মং মং শো : চীনের কুন্মিংয়ে ইয়ুন্নান আর্টস ইউনিভার্সিটিতে চারুকলায় উচ্চ শিক্ষায় অধ্যায়নরত আছি। আর যতটুকু সম্ভব ফ্রি ল্যান্স আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করার চেষ্টা করছি। সর্বোপরি ছবি এঁকে যাচ্ছি।

 

বাসু দাশ : ছোটবেলার স্মরণীয় কোনো ঘটনা বলুন।

মং মং শো : আমি তখন অনেক ছোট, বয়স কত হবে ঠিক মনে নেই। হয়তো ক্লাস টুতে পড়ি। একদিন এক বসাতেই বাবার একটি ছবি আঁকার জন্য ৬বি পেন্সিল শেষ করে ফেলে ছিলাম। ঐ দিনে বাবার হাতের পিটুনি খেতে হয়েছিল।

 

 

বাসু দাশ : চীনে শিক্ষা অর্জন আর শিল্পচর্চা করতে যাওয়াটা কীভাবে হলো?

মং মং শো : আমরা যখন নিজের পছন্দের কোনো কিছু করি তখন মনে হয় না যে অনেক কষ্টের। আমার বেলায় ও তেমনি হয়েছে। চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি ভর্তি হলাম মাত্র। আমরা কয়েকজন মিলে একটা ট্রেন্ড চালু করেছিলাম। ভোরে জলরং করতে বের হতাম। তারপর ক্লাস। ক্লাস শেষে মেসে ফিরে ক্লাস ওয়ার্ক। রাতে রেল স্টেশনে ফিগার ড্রইং। সময় পেলে শাটল ট্রেনে ঘুমিয়ে নেওয়া কিছুক্ষণ। আর সময় না পেলে ক্যাম্পাসে গিয়ে আবার জলরং। এভাবে অনেক দিন কেটেছে আমাদের।

 

খুব ক্লান্ত লাগলে ফেরার সময় শাটল ট্রেনে ঘুমাতাম। খুব ভাল লাগতো যখন রাতের আঁকা ছবিগুলো ক্লাসের দেয়ালে ঝোলানো হতো। স্যারদের বিভিন্ন রকমের কমেন্ট, ওখান থেকেই আসল শেখা। যার ফলে প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। স্যারদের ভালবাসা এবং স্কলারশিপ। এই স্কলারশিপের কথা বলতে গেলে অবশ্যই অলক রয় স্যারের কথা তুলতে হয়। এখানে পড়তে আসার জন্য প্রায় সব ধরণের সহযোগিতা আমি স্যারের কাজ থেকেই পেয়েছি।

 

 

বাসু দাশ : চীনে শিল্প জীবনটা কীভাবে উপভোগ করছেন?

মং মং শো : চীনা সভ্যতা বিশ্বের প্রাচীনতম একটি সভ্যতা। আধুনিক এবং প্রাচীনতম সভ্যতা এই দুইয়ে মিলে অদ্ভুত সুন্দর এক শিল্প নগরীর দেশ চীন। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সভ্যতা যেমন এগিয়ে যাচ্ছে, তার পাশাপাশি সভ্যতার প্রাচীনতম নিদর্শনগুলোও সঠিকভাবে রক্ষা করে যাচ্ছে। আধুনিক নগরীর পাশাপাশি নদীর দুপাশে পাহাড়ের গাঁ বেয়ে প্রাচীনতম কৃষি প্রক্রিয়ার নান্দনিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। ইতিহাস এবং শিল্প রক্ষার ক্ষেত্রে এই দেশটি খুবই স্পর্শকাতর। তার প্রভাব দেখা যায় হাজার বছরের চীনা শিল্পরীতি এবং ক্যালিগ্রাফিতে। দৈনন্দিন জীবনের ব্যাবহার্য জিনিসপত্রে তার বিস্তর প্রভাব মেলে। ঐতিহ্য রক্ষার ক্ষেত্রে চীন দেশের উৎসব-পার্বণে সাজসজ্জা ও প্রথার অপরিবর্তনীয় কিছু উদাহারণ মেলে, যাতে হাজার বছরের পুরনো ইতিহাসের ছোঁয়া পাওয়া যায়।

 

বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি প্রতিটি মুহূর্তেই এখানে জ্ঞান আহরণ করে যাচ্ছি। চীনের ৫৬টি জাতিসত্বা সম্পর্কে এইটুকু সময়ের মধ্যে দেখা ও জানা খুবই কঠিন। তারপরও জানার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ ছাড়াও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং চীন দেশীয় খেলাধুলায় ভিন্ন আমেজ উপভোগ করি। প্রাত্যহিক জীবনে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, শিল্প রসিকতা, ভ্রমণ এবং চীন দেশীয় খাবারের ভিন্নতা ভীষণভাবে উপভোগ করে যাচ্ছি।

 

চীনের মানুষ লাজুক ও ভদ্র স্বভাবের। পারিবারিক সংগঠন এবং রীতিনীতিতে অনেকটা আমাদের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। তাই দূর দেশে থেকেও বাংলাদেশের অভাবটা অনেকটাই ভুলে থাকা যায়। আমি পড়াশুনা করছি অপূর্ব সুন্দরের লীলাভূমি চীনের ইয়ুন্নান প্রদেশ কুন্মিংয়ে। যে শহরকে বলা হয় চির বসন্তের শহর। আর চীনের ৫৬টি আদিবাসীর মধ্যে ২৬টি আদিবাসীর বসবাসই এই প্রদেশে। তাদের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর জীবনাচরণ আমার কাজকে প্রভাবিত করে।

 

বাসু দাশ : চট্টগ্রামের ক্যাম্পাস জীবনকে মিস করেন কতটুকু?

মং মং শো : এক কথায় অ..নে..ক। ক্যাম্পাস মানেইতো বন্ধুদের আড্ডা, আঁকাআঁকি, সেই শাটল, হায়দার গ্যালারী, প্রদর্শনী, পাঠচক্র, দেয়ালিকা, গ্রুপ করে আউট ডোরে যাওয়া, রাতের ট্রেন স্টেশন আর অনেকগুলো প্রোগ্রাম।

 

আমি ছিলাম চট্টগ্রাম চারুকলার ৪৫তম ব্যাচে, এই ব্যাচের উদ্যোগে প্রতি মাসে একটি করে প্রদর্শনী, বিভিন্ন শিল্পীকে নিয়ে দেয়ালচিত্র, পাঠচক্র ইত্যাদি করতে হতো। আমি চীনে আসার পর ভীষণ চিন্তিত ছিলাম এগুলো কী হবে? তবে এইটাও সত্য যে, কারো জন্য কোনো কিছু থেমে থাকে না। আর আমি ফেসবুকের মাধ্যমে তাদের পোস্ট দেখি, আনন্দিত হই, আবার কষ্টও পাই। এটাকেইতো মিস বলে মনে হয়। হ্যাঁ, যে আয়োজনগুলো ক্যাম্পাসে করতাম, সেগুলো এখন এখানে করার চেষ্টা করি।

 

বাসু দাশ : চীনে কোনো প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহণ করেছেন?

মং মং শো :  হ্যাঁ করেছি। তবে সবগুলো প্রতিযোগীতায় নয়। অনেকগুলো গ্রুপ প্রদর্শনী, আর্ট ক্যাম্প। গত বছর ফ্রান্স ও চীন উদ্যোগে আয়োজিত প্রদর্শনীতে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলাম। ২০১২ সালে ফল ভাস্কর্য প্রদর্শনীতে পুরস্কৃত হয়েছিলাম। চীনের ইয়ুন্নান প্রদেশে প্রবাসী ছাত্র-ছাত্রীদের চাইনীজ প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়েছি। এই রকম অনেক। আর আর্ট ক্যাম্প করেছি বিভিন্ন আর্ট গ্যালারি ও ভার্সিটির পক্ষ থেকে।

 

বাসু দাশ : দেশে কোন চিত্রশিল্পীর কাজ আপনাকে মুগ্ধ করে?

মং মং শো :  ছোটবেলা থেকেই যে নামটির সঙ্গে আমরা পরিচিত, সবার প্রথমেই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের কথা বলতেই হয়। তার আঁকা জল রং, ড্রইং আমার ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা। সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে আসে সমকালীন সময়ের প্রথম সারির শিল্পীদের নাম, শিল্পী এস এম সুলতান, কামরুল হাসান, সফি উদ্দিন আহমেদ এবং আরো অনেকেই। শিল্প শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা এবং বিভিন্ন প্রদর্শনীর মাধ্যমে শিল্পী রফিকুন নবী, কাইয়ুম চৌধুরী, মুস্তফা মনোয়ার, শাহাবুদ্দিন এই নামগুলো পরিচিত হয়ে ওঠে। দেশের এত শিল্পীদের মধ্যে একজনকে আলাদা করে বলা আমার জন্য অনেক কঠিন। ভিন্ন শিল্পীর ভিন্ন ভিন্ন কাজ, ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাধারা। তাই সবার প্রতি ভালোলাগাও এক রকম না।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্প শিক্ষা শুরুর পর যাদের কাজ বুঝতে শিখছি, জানছি তাঁদের মধ্যে শিল্পী মনসুরুল করিম, অলক রয়, ঢালী আল মামুন, আলুপ্তগীন তুষারের কথা বলা যায়। বলা যায় আলুপ্তগীন স্যার আমাদের হাতে ধরে শিখিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অলক রয় স্যার আমার প্রিয় শিক্ষক ও শিল্পী। একদিন আমাকে বান্দরবানে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন কীভাবে আঁকলে আমার ছবি আরো ভালো হতো।

 

বাসু দাশ : নিজের মাতৃভূমি নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?

মং মং শো :  অনেক কিছুইতো করার ইচ্ছে আছে। একজন শিল্পী হিসেবে কতটুকুইবা করা যাবে? হয়তো আমার কাজের মাধ্যমে মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারব। স্বপ্ন দেখাতে পারব সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার। তবে বাংলাদেশের শিল্পী হয়ে বিভিন্ন দেশে প্রদর্শনীতে অংশগ্রণের মাধ্যমে দেশের নাম উজ্জ্বল করতে চাই।

 

 

 

রাইজিংবিডি/বান্দরবান/২৭ আগস্ট ২০১৫/বাসু দাশ/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়