ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

‘দেয়ালে-জানালায় হাত দিয়েই বুঝি কত সুন্দর ঘর!’

আবু কাওছার আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৪৫, ২৭ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১৫:৪৬, ২৭ মার্চ ২০২১
‘দেয়ালে-জানালায় হাত দিয়েই বুঝি কত সুন্দর ঘর!’

মো. তোরাব আলী। বয়স ৫২ বছর। পাঁচ বছর বয়সে টাইফয়েডে তার দুই চোখ অন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের অসচ্ছলতার কারণে তার বাবা মা উন্নত চিকিৎসা করাতে পারেনি। মাত্র দুই শতাংশ জমিতে তারা দুই ভাই বসবাস করতেন। দুই চোখ অন্ধ থাকায় কোনো কাজ তিনি করতে পারেন না। তিনি অন্যের সহযোগিতা নিয়ে চলেন। 

তোরাব আলীও সংসারে দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। তার পরিবারের তেমন মাথা গোজার ঠাঁই ছিল না। পরিবারের সদস্যদের ঠাঁই করতে তিনি সবসময় ভাবতেন। কিভাবে পরিবারের সদস্যদের বসবাসের ব্যবস্থা করবেন। চলতি বছরে মুজিবশতবর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় ঘাটাইল উপজেলার কদমতলী গ্রামে তাকে জমিসহ ঘর দেওয়া হয়েছে। ঘর পেয়ে তিনি আনন্দে আত্মহারা। শুধু তোরাব আলী নয়, তার মতো টাঙ্গাইল জেলায় ২১৮৫ গৃহহীনের মধ্যে ঘর বরাদ্দ এসেছে। ইতোমধ্যে ৬১৩ জনের মধ্যে ঘর বিতরণ করা হয়েছে।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী তোরাব আলী বলেন, ‘আমার তেমন কোনো ঠিকানা ছিল না। আমার এ অবস্থা দেখে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে একটি ঘর দেওয়া হয়েছে। ঘরের দেয়ালে, দরজা ও জানালায় হাত দিয়ে বুঝি প্রধানমন্ত্রী আমাকে কত সুন্দর ঘর দিয়েছেন! আমার চোখ দিয়ে এত সুন্দর ঘর দেখতে পারলে আমার আরও বেশি ভালো লাগতো। প্রধানন্ত্রীর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায় কামনা করছি।’

বুধবার (২৪ মার্চ) আশ্রয়ন প্রকল্প-২ পরিদর্শনকালে এ সব তথ্য জানা যায়। আশ্রয়ন প্রকল্প পরিদর্শন করেন প্রকল্প পরিচালক অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুব হোসেন, টাঙ্গাইল-৩ আসনের সংসদ সদস্য আতাউর রহমান খান, টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ড. মো. আতাউল গনি, ঘাটাইলের উপজেলা নির্বাহী অফিসার অঞ্জন কুমার সরকার, টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের সভাপতি জাফর আহমেদ।

জেলা প্রশাসক ড. মো. আতাউল গনি জানান, মুজিবশতবর্ষ উপলক্ষে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। তার মধ্যে সাড়া জাগানো উদ্যোগে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর মাধ্যমে গৃহহীনদের ঘর দেওয়া। সেই প্রকেল্পর আওতায় টাঙ্গাইল জেলায় ২১৮৫টি ঘর বরাদ্দ এসেছে। সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে উপকারভোগী নির্বাচন করা হয়েছে। একেকটি ঘর গ্রহহীন মানুষের স্বপ্ন। গ্রহহীনরা পাকা দালান পাবে, এটি তারা কখনো কল্পনাও করেনি। ঘর পেয়ে তারা আনন্দে আত্মহারা।

সরকারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য সরকারি খাস জমি প্রভাবশালীদের দখল থেকে উদ্ধার করে আশ্রয়ন প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে। ঘর হস্তান্তরের বিষয়ে গৃহহীন নারী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও তৃতীয় লিঙ্গের যারা গৃহহীন রয়েছে, তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ তাদের বরাদ্দ থেকে সহযোগিতা করে নলকূপ, রাস্তা-ঘাটসহ গৃহহীনদের জীবনযাপনের উপকরণ বিতরণ করেছে।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলায় ২৪টি, মধুপুরে ২২টি, গোপালপুরে ৬৮টি, ভূঞাপুরে ৮২টি, ঘাটাইলে ১১২টি, কালিহাতীতে ৩৫টি, টাঙ্গাইল সদরে ১৫০টি, নাগরপুরে ১৬টি, দেলদুয়ারে ২০টি, মির্জাপুরে ৫০টি, বাসাইলে ৯টি ও সখীপুরে ১৯টি ঘরের সনদসহ কাগজপত্র হস্তান্তর করা হয়।

কদমতলী গ্রামের অপর উপকারভোগী হামিদা বেগম বলেন, ‘৩০ বছর আগে আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। স্বামী চলে যাওয়ায় মামার বাড়িতে বসবাস করতাম। মামা-মামি মারা যাওয়ার পর মামাতো ভাইয়েরা অনেক কথা বলেছে আমাকে। আমাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। আমার কষ্ট দেখে আমাদের গ্রামের মেম্বার-চেয়ারম্যানরা আমাকে একটি জমিসহ ঘর দিয়েছে। ঘর পেয়ে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমার একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হলে আরও উপকার হতো।’

উপকারভোগী জোৎনা বেগত বলেন, ‘আমার স্বামী দিনমজুরের কাজ করে। টাকা পয়সা না থাকায় ২০ বছর অন্যের বাড়িতে বসবাস করছি। আমাদেরও যেমন ঠিকানা ছিল না, ঠিক তেমনি আমার অনার্সপড়ুয়া ছেলে ও ১০ বছরের মেয়ের কোনো আশ্রয়স্থল ছিল না। ঘর পেয়ে আমাদের সবার ঠিকানা হয়েছে। আমার ছেলের একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হলে ভালো হয়।’

রমেছা বেগম বলেন, ‘এত দিন অন্যের বাড়িতে খুব কষ্ট করে বসবাস করেছি। বসবাস নিয়ে খুব দুঃচিন্তায় ছিলাম। এখন তাও শান্তিতে ঘুমাতে পারি। নিশ্চিন্তে বসবাসও করতে পারি। আমাকে ঘর দেওয়ায় শেখের বেটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।’

স্থানীয় সংসদ সদস্য আতাউর রহমান খান বলেন, ‘একটা আশ্রয়ের ব্যবস্থা থাকলে মানুষ তার জীবন ও জীবিকার জন্য কিছু করতে পারেন। আর যার আশ্রয় নেই, সে কী করে কাজ করবে। এসব কথা চিন্তা করে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, বয়স্কভাতা, স্বামী পরিত্যাক্ত ভাতাসহ সব সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। সব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী মানবতার ছাপ রেখে যাচ্ছেন।’

প্রকল্প পরিচালক মাহবুব হোসেন বলেন, ‘যাদের কেউ নেই, থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা ছিল জন্য মাথা গোজার ঠাঁই করে দেওয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু ঘর দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেননি। তারা কেমন আছেন, তাদের আয়ের উৎস হয়েছে কিনা তাদের সার্বিক খোঁজ-খবর নিয়ে উপকারভোগীদের জন্য ভালো কিছু করতে আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় টাঙ্গাইলের আশ্রয়ন প্রকল্প পরিদর্শন করতে এসেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রথম পর্যায়ে দেশব্যাপী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭০ হাজার ঘর হস্তান্তর করেছেন। সব মিলে বাংলাদেশে এক লাখ ১৩ হাজার ৫৯৩ জন গৃহহীনকে ঘর দেওয়া হবে। বেশিরভাগই দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো এপ্রিল অথবা মে’র প্রথম দিকে উদ্বোধন করা হবে।’

টাঙ্গাইল/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়