স্মরণ: আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ও সিকান্দার আবু জাফর
শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম
কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ও কবি সিকান্দার আবু জাফর দুজনই তাদের সৃষ্টির জন্য অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন।
বিখ্যাত কবিতা ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’র- কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ২০তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। বাংলা কবিতার এই কিংবদন্তি কবি ২০০১ সালের ১৯ মার্চ ৬৭ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
তিনি বণার্ঢ্য এক জীবনের অধিকারী ছিলেন। সচিব, প্রশাসক এমনকি মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। কর্মজীবনে সুনামের সঙ্গে তিনি প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তারপরও তার কবি পরিচয় বাংলা সাহিত্যে উজ্জ্বলতম হয়ে আছে। তাই অন্যসব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত।
ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান এই কবির জন্ম ১৯৩৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার বাহেরচর শুদ্রাখাদি গ্রামে। পুরো নাম আবু জাফর মুহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ খান। বাবা আব্দুল জব্বার খান ছিলেন বিচারক। হাইকোর্টের জজ হিসেবে তিনি অবসর নেন। পরবর্তীতে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার হন। মা সালেহা খাতুন ছিলেন গৃহিনী।
ভাষা আন্দোলনসহ বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ছিলেন সরব। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রসমাজের আন্দোলন যখন চরম আকার ধারণ করে তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। '৫২-র সেই মিছিল, পুলিশের গুলিবর্ষণ, শহীদ হওয়া ছাত্রদের লাশ তার মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। সেই ক্ষত থেকেই জন্ম নিয়েছিল তাঁর বিখ্যাত আবেগময় কবিতা ‘মাগো ওরা বলে' কবিতাটি।
'মাগো, ওরা বলে,/সবার কথা কেড়ে নেবে/তোমার কোলে শুয়ে/গল্প শুনতে দেবে না।/বলো, মা তাই কি হয়?/তাইতো আমার দেরি হচ্ছে/তোমার জন্যে কথার ঝুড়ি নিয়ে/তবেই না বাড়ি ফিরবো/লক্ষ্মী মা রাগ ক'রো না,/মাত্র তো আর কটা দিন!'।
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো : সাতনরী হার (১৯৫৫), কখনো রং কখনো সুর (১৯৭০), কমলের চোখ (১৯৭৪), আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি (১৯৮১), সহিষ্ণু প্রতীক্ষা (১৯৮২), প্রেমের কবিতা (১৯৮২), বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা (১৯৮৩), আমার সময় (১৯৮৭), নির্বাচিত কবিতা (১৯৯১), আমার সকল কথা (১৯৯৩), মসৃণ কৃষ্ণ গোলাপ প্রভৃতি৷
কবি সিকান্দার আবু জাফরের ১০২তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৯১৯ সালের ১৯ মার্চ তিনি সাতক্ষীরা জেলার তেঁতুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তার কবি ও গীতিকার সত্তা অভিন্নপ্রায়। তার জীবনের সেরা কীর্তি ‘সমকাল’ পত্রিকা সম্পাদনা। এই পত্রিকার পাতায় পাতায় তাঁর রুচি ও সাহসের পরিচয় মুদ্রিত আছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ‘বাঙলা ছাড়ো’, ‘জনতার সংগ্রাম’ কিংবা ‘আমার অভিযোগ’-এর মতো রচনা নানাভাবে প্রেরণা জুগিয়েছে।
পূর্ণ নাম সৈয়দ আল্ হাশেমী আবু জাফর মুহম্মদ বখত সিকান্দার। আদি নিবাস ছিল পাকিস্তানের পেশোয়ারে। সেখান থেকে তার পিতামহ মাওলানা সৈয়দ আলম শাহ হাশেমী ওই গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন।
তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ: উপন্যাস পূরবী (১৯৪১), নতুন সকাল (১৯৪৬); ছোটগল্প মাটি আর অশ্রু (১৯৪২); কবিতা প্রসন্ন শহর (১৯৬৫), তিমিরান্তিক (১৯৬৫), বৈরী বৃষ্টিতে (১৯৬৫), বৃশ্চিক-লগ্ন (১৯৭১), বাংলা ছাড়ো (১৯৭১); নাটক সিরাজ-উদ-দৌলা (১৯৬৫), মহাকবি আলাউল (১৯৬৬); সঙ্গীত মালব কৌশিক (১৯৬৬)।
আবু জাফর অনুবাদক হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। তার কয়েকটি অনূদিত গ্রন্থ: যাদুর কলস (১৯৫৯), সেন্ট লুইয়ের সেতু (১৯৬১), রুবাইয়াৎ : ওমর খৈয়াম (১৯৬৬) ইত্যাদি। তিনি নাটকে বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৬) এবং একুশে পদক (১৯৮৪, মরণোত্তর) লাভ করেন।
১৯৭৫ সালের ৫ আগস্ট ঢাকায় তার মৃত্যু হয় এবং বনানী কবরস্থানে তিনি সমাহিত হন।