ঢাকা     শনিবার   ০৪ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২১ ১৪৩১

বাবা আমার বীর যোদ্ধা

উম্মে কুলসুম রিপা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৮, ২০ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
বাবা আমার বীর যোদ্ধা

বাবা মানে বটবৃক্ষ। বৃক্ষ যেমন ছায়া দেয়, ফলমূল দেয়, জ্বালানি দেয়, বাঁচার জন্য দেয় অক্সিজেন; তেমনই বাবাও দেয় ছায়া, আশ্রয়, ভালোবাসা। বাবা প্রয়োজনের নিরব যোগানদাতা, এক বীর যোদ্ধা। আমার বাবা অসাধারণ এক লালন-পালনকর্তা। বাবাই আমার জীবনের প্রথম আশ্রয়দাতা। আমার রাগী, ভাবগম্ভীর বাবার আছে উদার হৃদয়। বাবার কাছ থেকেই শিখেছি পরোপকারের মহৎ কর্ম। জন্মানোর পর বাবা ভালোবেসে আনন্দে বিমোহিত হয়ে বাবার রিপন নামের সাথে মিলিয়ে আমার নামকরণ করেছিলেন রিপা। বাবার হাত ধরেই জীবনের প্রথম পদচারণ করেছিলাম বিদ্যালয়ে। আমার ভাবগম্ভীর বাবাকে দেখেছি, কীভাবে পরিবার, সন্তানের সুখের জন্য দিনরাত অবিরাম পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু বাবাকে কখনো হাজার কষ্ট পেলেও কাঁদতে দেখিনি!

তবে আমার ব্যবসায়ী বাবাকে দেখেছি, জীবনযুদ্ধে হার না মানতে। পৃথিবীর সকল বাবাই সেরা, তবে আমার বাবা সেরার সেরা। আমি পথ হাঁটি-চলি আমার সুপরিচিত বাবার পরিচয়ে। এলাকার পাড়া-মহল্লায় আমার বাবার বহু খ্যাতি। কারণ, আমার বাবা সৎ, সত্যবান, বিচক্ষণ, চরিত্রবান, জীবনে সফল যোদ্ধা। আমি গর্ববোধ করি আমার খ্যাতিমান বাবাকে নিয়ে। মায়ের পর বাবাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। প্রতিবছর পালিত হয় বিশ্ব বাবা দিবস। তবে আমার কাছে বাবাকে ভালোবাসতে, ভালোবাসি বলতে কোনো দিবস, দিনকালের প্রয়োজন হয় না।

কিন্তু ভালোবাসার প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে যেহেতু একটা দিন/দিবস রয়েছে,সেহেতু তার ইতিহাস, তাৎপর্য জানাটাও কম জরুরি নয়। ১৯০৮ সালের ৫ জুলাই আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়ার ফেয়ারমন্টের এক গির্জায় এই দিনটি প্রথম পালিত হয়। এর আগের বছরই একটি কয়লা খনিতে বিস্ফোরণে নিহত হয়েছিল ৩৬২ জন শ্রমিক। তাদেরকে সম্মান জানাতে সন্তানরা মিলে এ প্রার্থনা সভার আয়োজন করে। এটি ছিল বাবাকে সম্মান জানাতে ইতিহাসের প্রথম আয়োজন।

সনোরা স্মার্ট ডড নামে ওয়াশিংটনের এক ভদ্র মহিলার মাথায় পিতৃ দিবসের আইডিয়া আসে। যদিও তিনি ভার্জিনিয়ায় বাবা দিবস পালনের কথা একেবারেই জানতেন না। ডড তার বাবাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে ১৯ জুন, ১৯১০ সাল থেকে বাবা দিবস পালন করা শুরু করেন। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে জুন মাসের তৃতীয় রোববার পিতৃ দিবস পালিত হয়। তবে আমি শুধু জুন মাসের তৃতীয় রোববার আমার বীর যোদ্ধা বাবাকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা জানাচ্ছি না। আমার বীর যোদ্ধা বাবার জন্য ভালোবাসা, শ্রদ্ধা প্রতিটা সেকেন্ড।

আজ পর্যন্ত জীবনের যত পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছি, বাবা হয়েছিল পরীক্ষার হলে প্রবেশ করানো সঙ্গী। পরীক্ষা শুরুর আগের দিন রাতে বাবা খুব দায়িত্ব সহকারে আমার প্রবেশপত্র ঠিক আছে কি না দেখা, লেখার উপকরণ গুছিয়ে নেওয়া, ফাইলে সব ঠিকমতো আছে কি না চেক করা ছিল বাবার অভ্যাস। পরীক্ষা কেমন হলো? ভালো রেজাল্ট আসবে কি? এসব প্রশ্ন করাও বাবার অভ্যাস ছিল। আমার সব পাবলিক পরীক্ষার সময় বাবা আমাকে খুব সময় দিত। আর বাবার দেওয়া সময়গুলো ছিল আমার কাছে প্রচুর আনন্দের। কারণ, বাবা কাজে ব্যস্ত থাকায় তেমন সময় দিতে পারত না। যে বার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম, তার মধ্যে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের দিন বাবা আমাকে পরীক্ষার হল থেকে নেওয়ার পথে আমার সাথে খুব গল্প করেছিল। চারদিকে সবাই প্রিয় মানুষদের নিয়ে ঘুরাঘুরি করছিল। আর আমি ওই দিন বাবার সাথে ঘোরাফেরা করেছিলাম। ওই দিনটা আমার কাছে ছিল জীবনের সেরা আনন্দের মুহূর্ত। বাবা আর কখনো বাইরে আমাকে নিয়ে এত সময় ঘোরাঘুরি করেনি।

এত আনন্দের মাঝে বেদনাও আছে। তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তাম। রোজার মাসে ছিল আমার অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা। তার মাঝে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ছয়-সাত মাস অসুস্থতার সাথে করেছিল লড়াই। অবশেষে স্রষ্টা সুস্থ করে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বাবাকে। কিন্তু সেই বেদনাদায়ক স্মৃতি আজও আমায় পীড়া দেয়। মাঝরাতে নিঘুম বেলায় আচমকা ভয় পাইয়ে দেয়। নিত্যদিন নিজের অজান্তেই ভয় পাই। স্রষ্টাকে বলি, সুস্থ নেক হায়াত দাও আমার বাবাকে।

ছোটবেলার মতো করে এখন আর বাবার সাথে কথা বলা, গল্প করা হয় না। বাবার সাথে কথা বলতে এখন কেমন জানি দ্বিধা কাজ করে। যদিও বাবার কাছে আমি এখনো ছোট। কিন্তু নিজের কাছে মনে হয়, বড় হয়ে গেছি। বাবাও আর আগের মতো করে কথা বলে না আমি দূরত্ব বজায় রাখছি বলে। মন চায়, আবার শৈশবের মতো বাবার সাথে কাটানো সময়গুলো ফিরে পেতে। ইচ্ছে করে কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে বাবার সাথে শৈশবের মতো গল্প করতে, আড্ডা দিতে। বাচ্চা মেয়ের মতো বাবাকে বলতে চাই, জানো বাবা আজ আমার ক্যাম্পাসে কী হয়েছিল? ছোটবেলার মতো করে নানা বাহানা ধরতে বড্ড ইচ্ছে করে। বড় হয়ে যাওয়াতে বাবার সাথে দূরত্ব বেড়ে যাওয়ার পর এখন প্রতি মুহূর্তে অনুভবে ভাবনার দেশে কত কথা বলি বাবার সাথে। বড় ইচ্ছে করে একটা সময়ে চা-কফির আড্ডায় আড্ডায় বাবাকে বলতে আমার অনুভূতির কথোপকথন। আজও প্রত্যাশায় আছি, আগের মতো করে বাবার সাথে গল্প করার। বাবার পরিচয়ে যেমন লোকে আমায় চেনে, তেমনই আমার সফলতা ও পরিচয়ে যেন লোকে বাবাকে চেনে, এমন একটা দিনের প্রতিক্ষায় আছি। সেই দিনটার অপেক্ষায় আছি, যেদিন মানুষ বলবে, দেখ সেই মেয়ের বাবা যাচ্ছে এই পথে, যে মেয়েটি আজ বাবার স্বপ্ন পূরণ করেছে। মেয়েটি বাবার মতো আদর্শবান, সফল হয়েছে জীবনযুদ্ধে।

ভালো থাকুক আমার সুপার হিরো বাবা, ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল সুপার হিরো বাবা। স্রষ্টা সুস্থ-সবল রাখুক আমার বীর যোদ্ধা বাবা এবং সকল বাবাকে।     



কুমিল্লা/রিপা/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়