ঢাকা     সোমবার   ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৬ ১৪৩১

অসমাপ্ত সম্পর্ক

বিপুল জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৫৮, ২০ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
অসমাপ্ত সম্পর্ক

লাঞ্চ আওয়ারে সেলসের হারুন সাহেবকে খুক খুক করে কাশতে দেখে অ্যাডমিনের জহির সাহেব বললেন, ‘হাঁচি কাশি নিয়ে কষ্ট পাওয়ার কোনো মানে হয় না। ক্যালি বাইক্রম থার্টি, সকালে খালিপেটে আর সন্ধ্যায় খালিপেটে। পাঁচ ফোটা। তিনদিনে সেরে যাবে। তবু দুসপ্তাহ চালিয়ে যেতে হবে। ব্যস। সারাবছরের জন্যে নিশ্চিন্ত।’

জহির সাহেব মানুষটা এমনই। কাঁচাবাজার থেকে জুয়েলারি, কারওয়ান বাজার থেকে কন্টিনেন্টাল হোটেল– যেকোনো ব্যাপারে কার্যকরী পরামর্শ তার কাছে আছে। এইসব পরামর্শ যে তার কাছে চাইতে হয়, সবসময় সে কথা ঠিক নয়। মাঝে মাঝে না চাইলেও তার পরামর্শ পাওয়া যায়। জনশ্রুতি আছে, না চাইতে যে পরামর্শ দেয়া হয়, তা কাজ করে না। জহির সাহেবের পরামর্শের বেলায় এ জনশ্রুতি প্রযোজ্য নয়।

অপারেশন্সের সালাম সাহেব বললেন, ‘কী ব্যাপার জহির সাহেব? এ ব্যাপারেও আপনার ডিগ্রি নেওয়া আছে নাকি?

‘আছে, তবে আমার না। আমার বাবার। বাবা ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের টিচার। হাতে সময় থাকতো। একটা ডিপ্লোমা ডিগ্রি নিয়েছিলেন। গরিব অসুস্থ গ্রামবাসী আর পরিবারের লোকের উপর প্রাকটিস করতেন।’

খেতে খেতে বলতে থাকেন, জহির সাহেব, ‘এ কারণে অসুস্থতার দোহাই দিয়ে স্কুল কামায় করার কোনো উপায় ছিল না। পেটব্যথা, মাথাব্যথা? খাও একোনাইট ফোরটি, জ্বর? তো খাও রাস টক্স থার্টি। কিছুক্ষণ পর বলতেন, কী রে? ব্যথা সারলো? সারেনি বললে আবার এমন তিতকুটে একটা কিছু দেবেন যে, মনে হবে এর থেকে স্কুলে যাওয়ায় ভালো ছিল। বলতেই হতো, পেটব্যথা সেরে গেছে। আর সেরে গেছে শুনলেই বলতেন, তাহলে গুছিয়ে নাও। স্কুলে যেতে হবে।’

জহির সাহেবের গল্প বলার এমনই কায়দা না হেসে পারা যায় না। সবাই বেশ গল্পে মশগুল হয়ে গেলেও অস্বস্তিতে পড়ে যায় শামীম। সে সাতমাস ঢুকেছে চাকরিতে। পার্মানেন্ট হয়নি এখনো। টেবিলে বসা বাকিদের চেহারার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে তার অস্বস্তিবোধ করা কারো কাছে ধরা পড়েছে কি না। না। সবাই কথাবার্তায় ব্যস্ত। শামীম এমনিতে কথাবার্তায় সপ্রতিভ। কিন্তু কোনো গল্প, আড্ডা বা কথোপকথনে 'বাবা' প্রসঙ্গ উঠলেই অস্বস্তিবোধ করে।

অস্বস্তিবোধের কারণ, এসব আলোচনায় উঠে আসে বক্তার সাথে তার বাবার হাসি, আনন্দ, টুকরো টুকরো সুখস্মৃতি। কিন্তু শামীম তার বাবার সাথে তেমন কোনো স্মৃতির কথা মনে স্মরণ করতে পারে না। বাবার কথা মনে করার চেষ্টা করলে এক লহমায় যা মনে আসে তাকে কোনো বিচারেই সুখস্মৃতি বলার উপায় নেই। অস্বস্তিবোধ না করে উপায় কী? অস্বস্তিবোধ মুহূর্তেই তুলনাহীন বেদনায় রূপান্তরিত হয়, বাবার সাথে আনন্দময় স্মৃতি হবার উপায়ও আর নেই। শামীম বাবাকে হারিয়েছে আট বছর হয়ে গেল।

লাঞ্চ আওয়ার শেষে ডেস্কে ফিরে আসে শামীম। কিন্তু মনের ভিতরে বহুদিনের লালিত চোরাকাঁটা মন থেকে সরে না। ছোটবেলায় কাজল ভাইয়ের বাবাকে দেখতো প্রতিদিন কাজল ভাইকে নিয়ে যেতে ফুটবল খেলার প্রাকটিসে। তারা যখন প্রাকটিস সেরে ফিরত শামীম তখন স্কুলের পথে, প্রায়ই দেখা হতো।

কাজল ভাই যখন মোটর সাইকেলে তার বাবার পেছেনে বসে যেতেন, দৃশ্যটা বাস্তবের বলে মনে হতো না। অন্যান্য বন্ধুদের শামীম জিজ্ঞেস করে দেখতে চেয়েছিল, তাদের বাবারা কখনও তাদেরকে এমন মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে খেলতে নিয়ে যায় কি না আর তারা কখনও বাবাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বসেছে কি না। কিন্তু ভরসা পায়নি মিশুকের আব্বাকে দেখে।

অতি অল্পবয়সে মিশুকের মা মারা যান। মায়ের অভাব পূরণ করতেই তিনি ছেলেকে বেশি বেশি সময় দিতে থাকেন। তিনি ছিলেন দাঁতের ডাক্তার। ছেলেকে সময় দিতে তিনি চেম্বার করতেন একবেলা। সকালে, যখন তার ছেলে স্কুলে থাকে। এসব শামীম জানতে পারে ক্রমে, ক্রমে। মিশুকের বাবা মিশুকের জন্যে একটি ক্যারামবোর্ড কেনেন। সাধারণত তারা বাপ বেটায় খেলতেন কিন্তু শুক্রবার ছুটির দিনে চারহাতে খেলার জন্যে শামীম আর রাকিবের দাওয়াত থাকতো।

মিশুকের বাড়িতে গিয়ে মিশুকের বাবাকে দেখে আর জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি অন্য বন্ধুদেরকে যে, ‘তাদের বাবা কেমন’ হয়ত দেখা যাবে শামীমের বাবা একাই এমন। শামীমকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় ছোটবেলায় তোমার জন্যে সবচেয়ে ভীতিকর বিষয় ছিল কোনটি? তবে শামীম উত্তর দেবে, সবার বাবা তাদের সাথে ভালোভাবে কথা আর তার বাবা-ই এমন রাগী আর কর্কশ ব্যবহার করে এই ধারণা সপ্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই ছোটবেলার সবচেয়ে ভীতিকর বিষয়।

দিন যায়। শামীম পড়াশোনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে আরো পড়াশোনার জন্যে। এতোদিনে জেনেছে তার বাবার থেকেও ভয়ংকর বাবা আছে। তারা তাদের সন্তানকে অন্যের দোকানে কাজে লাগায়। কঠিন কঠি সব কাজ। আবার ভালো বাবাও আছে। তারা তাদের সন্তানকে নিয়ে বেড়াতে যায়, মন খুলে কথা বলে। সেসব পরিবারে বাবা আর সন্তানদের মধ্যে হিমশীতল বরফের কোনো দেয়াল নেই।

ক্যাডেট কলেজের ছেলে সাব্বির। অ্যাপ্লাইড ফিজিস্কে পড়ে। ইংরেজি গল্পের বই পড়ে। বাবার সাথে তার বন্ধুত্বের সম্পর্ক। বাবাকে সে তুমি বলে সম্বোধন করে। একদিন কথায় কথায় জানালো বাবার কম্পিটার স্লো হয়ে গিয়েছিল, বাবার সাথে বাজি ধরে কম্পিউটারের স্পিড দ্রুত করে দিয়ে বাজিতে জিতেছিল। শামীম সেদিন সাব্বিরের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল, বাবা কী তবে বন্ধুও হয়! অবাক ব্যাপার।

স্ট্যাটিসটিকসের সাগরের বাবা আসতেন ফি বৃহস্পতিবার। তিনি এলে সাগর বাবার সাথে বেড়াতে যেত। একেক দিন একেক জায়গায়। জাদুঘর, ধানমন্ডি লেক, বাহাদুর শাহ পার্ক, আহসান মঞ্জিল, লাল বাগ কেল্লা, এমনকি শিশু পার্ক, চিড়িয়াখানাতেও। এতো বড় ছেলে, তবু শিশু পার্কে! আশ্চর্য।  

ঘোরাফেরা শেষে রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়া দাওয়া। ইচ্ছে মতো খেয়ে আরো কিছু খাবার সাথে নিয়ে ফিরতো সাগর। রুমমেট, আশেপাশের রুমের সহপাঠীদের ডেকে খাওয়াতো সে খাবার। অন্যরা দেদারছে খাচ্ছে যখন তখন শামীম শুনছে সাগর আর ওর বাবা আজ কী কী করলো তা।

শামীম যদি নিজের বাবার দিকে দেখে তাহলে সে এইসব সুখ স্মৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো ঘটনার কথা মনে করতে পারে না। পড়াশোনার দেখভাল করা, কী পরবে, কী করবে সবই ছিল মায়ের সিদ্ধান্ত। বাবা মনে হয় জানতেনও না ওরা কোনো ক্লাসে পড়তো। কোনো রকম খোঁজ খবরের আওতামুক্ত বাবার সাথে যদি কখনও মোলাকাত হয়েও যেত, তিনি সেই যোগাযোগ রক্ষা করতেন মারধর দিয়ে।

একবার পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল শামীম, বাবার হাতে প্রচণ্ড চড় খেয়ে ঘুম ভাঙে তার। অমন লম্বা চওড়া মানুষটার হাতের চড় খেয়ে ধড়মড় করে উঠে পড়েছিল সে। কিন্তু চড়ের ধকল সামলে ওঠা সম্ভব হয়নি। টলে পড়ে যাচ্ছিল। একবার ধরতে চেষ্টাও করেনি। বলেছিল, ‘মশারি টাঙিয়ে ঘুমো।’

বাড়িতে দম আটকে আসতো। বাড়িতে পালানোর জন্যেই খুব এটে কোশে পড়তো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারায় বাড়ি থেকে পালানোর সেই সুযোগটা আসে। বাবার কাছ থেকে দূরে, বাড়ি থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিল শামীম। আল্লাহ বাবাকে ডেকে নিয়ে শামীমের সাথে তার দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দেন। শামীমের সেদিন মনে হয়েছিল বাবার সাথে এত দূরত্ব কি সে চেয়েছিল? বারো বছরের ছোট বোন আর মাকে নিয়েই শুরু হলো শামীমের সংসার। বড় ভাই নিজের সংসার নিয়ে হয়ে গেল আলাদা।

বোনের পড়াশোনা, সংসারের খরচ এসব মেটানোর জন্য দুটোর জায়গায় ছয়টা টিউশনি নিতে হলো শামীমকে। আগে বছরে দুবার বাড়িতে গেলেই চলতো। এখন প্রতিমাসে না গেলেও দুমাসে একবার যেতেই হয়। বোনটাকে মানুষ করতে গিয়ে ক্রমে ক্রমে বুঝছে শামীম বাবা কাকে বলে।

বাজার ঘাটে গেলে পরিচিতরা ডেকে কথাবার্তা বলে, কেমন আছে, কীভাবে কী করছে খোঁজ খব নেয় সবাই। কথার শেষে অনেকেই বলে খুব আশ্চর্য কথা। বাবা নাকি শামীমের কথা বলতেন এদের কাছে। তারা প্রায় সবাই বলে, তোমার আব্বা তোমাকে নিয়ে খুন স্বপ্ন দেখতেন। শামীম এলোমেলো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবে, কই বাবা এমন কোনো কথা তো তাকে বলেননি।

গরমের ছুটিতে একবার শামীম বাড়িত্ব এলো। বোনের সামনে পরীক্ষা। জে এস সি। দিন রাত পড়ছে। শামীমও পড়া দেখিয়ে দেয়। পরীক্ষা নেই। পড়ার ঘর থেকে কোনো শব্দ না শুনতে পেয়ে শামীম এগিয়ে যায়। দেখে বোন ঘুমাচ্ছে টেবিলে মাথা রেখে, আর এক ঝাঁক মশা মনের আনন্দে হুল ফুঁটিয়ে সো সো করে রক্ত খাচ্ছে। কি যে প্রচণ্ড রাগ হলো ওর।

এক চড়ে সবকটা মশাকে মেরে ফেলতে হাত তুললো, প্রচণ্ড বেগে হাতটা বোনের গালে নামিয়ে আনার আগ মুহূর্তে অলৌকিকভাবে থেমে যেতে পারলো। বুঝতে পারলো, মশাগুলো মারতে পারবে কি জানে না কিন্তু এই চড় বোনের গাল বেয়ে মনে গিয়ে যে লাগবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। চিরস্থায়ী একটা দূরত্ব তৈরি করে দেবে। হয়ত এমনই একটি হঠাকারি চড় চিরদিনের জন্যে বাবা আর তার মধ্যে দূরত্ব তৈরি মরে দিয়েছিল।

বোনকে ডেকে তোলে শামীম। বোন ধড়ফড় করে ওঠে। বলে পড়ছি, পড়ছি। কি ভীষণ ভয়েই না থাকে বোনটা। শামীম বলে, থাক এখন আর পড়তে হবে না। আমি ভোরে ডেকে দেব। তখন পড়ো। বোনের চোখে সেদিন দেখেছিল বিস্ময়।

বিভিন্ন পরিবেশ দেখার কারণেই হোক বা বাবার চরিত্রের নিষ্ঠুর দিকটি দেখার কারণেই হোক শামীম নিজে যেটার অভাববোধ করেছে সেটাই অন্যের জন্যে ভেবেছে। এখন সে অনেক কিছু বোঝে, হয়ত তার কিছু ছোট ছোট আচরণ বাবাকেও তার লৌহ কঠিন ইমেজ থেকে বের করে আনতে পারতো। কিন্তু সে সুযোগ শামীমের আর নেই। বাবা এসকল কিছুর আওয়ার একদম বাইরে। বাবা ছেলের অপূর্ব সম্পর্কের জায়গাটাও যে চির জীবনের মতো অসমাপ্ত থেকে গেল সে কারণে শামীম নিজে খুব অস্বস্তিবোধ করে, নিজেই বোঝে নিজের অস্তিত্বের কোথাও মারাত্মক কোনো দুর্বলতা রয়ে গেছে।


ঢাকা/সনি

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়