ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বৃষ্টি রাজধানীতে এখন আতঙ্কের কারণ

কামরুল আহসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২৯, ৫ জুন ২০২১  
বৃষ্টি রাজধানীতে এখন আতঙ্কের কারণ

ঘুম ভাঙল প্রচণ্ড বজ্রপাতের শব্দে। তাকিয়ে দেখি মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। দ্রুত বারান্দায় গেলাম। গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ! চারদিক ভেসে গেছে। গোপীবাগের যে এলাকায় আমরা থাকি, তিনতলায় আমাদের বারান্দার কোণাটি ঠিক চার রাস্তার মোড়ে। বারান্দার কোণায় দাঁড়ালে পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ পর্যন্ত অনেক দূর দেখা যায়। যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি- যাকে বলে রীতিমতো বন্যা! 

গোপীবাগ একেবারে ঢাকার মধ্যখানেই বলা যায়। মতিঝিল হাঁটাপথেই পাঁচ-সাত মিনিট দূরত্ব। এই এলাকায় যারা থাকেন তাদের অনেকেরই মতিঝিল অফিস। একটু পরই শুরু হলো অফিসগামী মানুষের যাতায়াত। ঝড় হোক, বন্যা হোক- অফিসে তো যেতেই হবে। অবশ্য বৃষ্টি থেমে গেল ন’টার মধ্যেই। কিন্তু পানি তো সরার নাম নেই। দু’চারটা রিকশা যা গলির মধ্যে ঢুকছে, দ্বিগুণ-ত্রিগুণ ভাড়া দিয়ে মানুষ উঠে বসছে। রিকশার অর্ধেক চাকা পানির নিচে। খানাখন্দ তো আছেই। জীবন হাতে নিয়েই অনেকে ছুটে চলেছেন কর্মস্থলে। যাদের ব্যক্তিগত গাড়ি আছে, গাড়ি বের করার সাহসও করেননি অনেকে। বেশির ভাগ মানুষই ছুটে চলেছেন পায়ে হেঁটে। হাতে জুতা, প্যান্ট গুটানো। পর্দানশীল নারীকেও হাঁটুর কাছে কাপড় তুলে ফেলতে হচ্ছে- এর চেয়ে ভোগান্তি একটি শহরের বাসিন্দাদের জন্য আর কী হতে পারে! অলি-গলিতে অনেককে দেখা যাচ্ছে বাঁশের কঞ্চি হাতে দৌড়াদৌড়ি করছেন। ড্রেন পরিষ্কার করছেন। একটু বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহরের এটি নিয়মিত চিত্র।

সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা ঢাকার আশেপাশের শহরতলীগুলোতে। জুরাইন এলাকায় প্রায় সারা বছরই পানি আটকে থাকে। অথচ রাস্তার পাশেই বিশাল বিশাল সুরম্য বহুতল ভবন। ওসব বাড়ির মালিকরা চাইলে একাই নিজের বাড়ির সামনের রাস্তাটা অন্তত সংস্কার করতে পারেন। কিন্তু তারা বসে থাকেন সরকারের আশায়। 

এ থেকে মুক্তির উপায় কী? দীর্ঘমেয়াদী কোনো মুক্তির উপায় কি সত্যিই আছে? জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলেই কেবল এ নিয়ে কিছু কথাবার্তা হয়। নগর-পরিকল্পনাবিদগণ টেলিভিশনে এসে বলেন, খালগুলো সংস্কার করতে হবে। কিন্তু, খালগুলো দখল হলো কেন? ঢাকার আশেপাশের খালগুলো অনেক আগে দখল হয়েছে এবং সেগুলোর বেশিরভাগেরই আর খালের চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট নেই। সেগুলো উদ্ধারের প্রশ্নও আসে না। অনেক খাল ভরাট করে রাস্তা পর্যন্ত বানিয়ে ফেলা হয়েছে। ভরসা এখন সুয়ারেজ লাইন পরিষ্কার রাখা। ময়লা-আবর্জনায় ড্রেনগুলো বন্ধ হয়ে থাকার কারণে সেও প্রায় অসম্ভব। যে খালগুলো ধুকে ধুকে এখনো টিকে আছে সেগুলোর ওপর দোকানপাট, বাজার। বাজারের তরকারির খোসা, পরিত্যক্ত পলিথিন অনিবার্যভাবেই নিক্ষিপ্ত হয় খালে। কদিন পরপর পৌরসভার ময়লা নিষ্কাশনের গাড়ি এসে সেগুলো পরিষ্কার করে, কিছু দোকানপাট ভেঙে দেয়। কদিন যেতেই সব আবার আগের মতো। এলাকার রাজনৈতিক নেতারা সেখান থেকে বখরা পান। একবারও ভাবেন না যে বর্ষা এলেই তারাও দুর্গতির মধ্যে পড়বেন। এ যেন নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ করার মতোই ব্যাপার।

শুধু জলাবদ্ধতা তো নয়, ময়লা-আবর্জনা নানা রোগেরও প্রধান কারণ। করোনার পর এখন ব্ল্যাক-ফাঙ্গাস আসছে, শোনা যাচ্ছে এ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় আমাদের চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। মশা-মাছির উৎপাত থেকেও আমরা বাঁচতে পারি যদি আশপাশ পরিষ্কার রাখি। তার মানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আমাদের জীবনের সুস্থতার সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। পরিষ্কার-পরিচ্ছনতা আমাদের যে শুধু সুস্থ রাখে তাই না, আমাদের সুন্দরও রাখে। সব ধর্মেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও আমরা কেন যে এতো অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন জাতি- ভেবে অবাক হতে হয়।

ড্রেনের ভেতর একজনকে সিগারেটের প্যাকেট ফেলতে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এখান এটা ফেললেন কেন? তিনি বলেছিলেন, এমনিতেই তো এটা ভরে আছে। আমি ফেললে আর কী হবে?

এই মানসিকতা থেকেই সবাই যেখানে সেখানে ময়লা ফেলে। ভাবে অন্যরা ফেলেছে, আমিও ফেলি। পরিষ্কার জায়গায় কেউ ময়লা ফেলে না। নোংরা জায়গাতেই ফেলে। 
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বলতে আমরা বোধহয় শুধু এটুকুই বুঝি- নিয়মিত গোসল, কেবল নিজের শরীর পরিষ্কার রাখা, নিজের ঘর পরিষ্কার রাখা। কিন্তু আমরা যে একটি বৃহৎ সমাজের অংশ, এবং সমাজের শরীরটিও আমাদের পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে সেদিকে খুব বেশি গুরুত্ব দেই না। সমাজ পরিষ্কার না রাখলে আমার নিজের শরীরও পরিষ্কার থাকবে না। ভালো সাবান ডলে, দামি পারফিউম মেখে ঘর থেকে বেরিয়ে যদি ময়লা পানি মাড়িয়ে যেতে হয় সেই পরিচ্ছন্নতার কী মূল্য! 

বিশ বছর আগেও দেখা যেত প্রতিটি এলাকায় বাড়ির মালিকদের একটা কমিটি থাকতো। নিজস্ব এলাকার নিরাপত্তা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে তারা সচেতন ভূমিকা রাখতেন। কেন যেন এই সচেতন ভূমিকাটা এখন খুব বেশি দেখা যায় না। হয়তো বাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে। গত বিশ বছরে স্থানীয় অধিবাসীদের চেয়ে সংখ্যায় বহুগুণ বেড়েছে বাইরে থেকে আসা লোকজন। তারা হয়তো একটা সুন্দর বাড়ি করে, কিন্তু নিজস্ব এলাকার বিষয়ে তাদের তেমন সচেতনতা নেই। অন্যদের সঙ্গেও তেমন যোগাযোগ নেই। এই যে বিচ্ছিন্নতা, এই বিচ্ছিন্নতা নগরজীবনের একটা বাস্তবতা। এবং এই বাস্তবতা নানা দিক দিয়েই অনেক সমস্যার সৃষ্টি করছে। 

শুধু পানি নিষ্কাশন নয়, একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে নগরের মানুষেরা নিঃসঙ্গতায় ও একাকীত্বে আক্রান্ত। তাদের মধ্যেই সাংসারিক অশান্তি বেশি। নগরের ছেলেমেয়েরাই বেশি নেশায় আসক্ত। পর্ণে আসক্ত। নগরের ছোট শিশুরা এখন আসক্ত মোবাইলে, ভিডিও গেমসে। এই করোনাকালে তা যেন আরো বেড়েছে। নগরে বাস করলেও এ যেন এক নারকীয় জীবন। আবার নগরে না থেকেও উপায় নেই। আমাদের বেশির ভাগ কর্মক্ষেত্র নগরনির্ভর। এখন এই নগরকে সুন্দর বাসযোগ্য করতে হলে আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। 

জলাবদ্ধতা ঢাকা শহরের একটা বড় সমস্যা। এই সমস্যাটা সবার আগে চোখে পড়ে কারণ বিষয়টা দৃশ্যমান। একাকীত্ব ব্যক্তিগত সমস্যা মনে হতে পারে, কিন্তু জলবদ্ধতা যে সবার সমস্যা এটা আমরা বুঝতে পারি কারণ প্রত্যেককেই এর মুখোমুখি হতে হয়। আমাদের প্রত্যেকের সচেতন ভূমিকা ছাড়া আসলে এ থেকে সহসা মুক্তির উপায়ও নেই। সত্যি বলতে ব্যক্তিগত সচেতনতায় এ থেকে আশু মুক্তির উপায়ও নেই। কারণ সচেতন মানুষের তুলনায় আমাদের সমাজে অসচেতন মানুষের সংখ্যাই বেশি। এর জন্য দরকার সামাজিক আন্দোলন। টেলিভিশন, খবরের কাগজ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম- ফেসবুক। 

তবে তারচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত উদ্যোগ। প্রথমত আমরা এখানে-সেখানে যা খুশি তাই ফেলব না। দ্বিতীয়ত কেউ যদি ফেলেও আমরা নিজেরাই তা পরিষ্কার করব। অন্তত নিজের বাড়ির সামনের রাস্তাটিও যদি আমরা পরিষ্কার রাখি তাতেও বড় একটি কাজ হয়। 
বৃষ্টি প্রকৃতির দান। সে তো আর আমাদের সুবিধা-অসুবিধা বুঝে আসবে না। যখন নামার অঝোর ধারায় ঝরবে। এ বছর বৃষ্টিপাত এখনো তেমন হয়নি। মাত্র তো জ্যৈষ্ঠমাস। সামনে আষাঢ়-শ্রাবণ বাকি। এখন বর্ষাকাল ভাদ্র-আশ্বিন পর্যন্ত বিস্তৃত। এ জন্য আমাদের তৈরি থাকতে হবে। 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়