ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ছোটগল্প || অনুগামী আলো

আশান উজ জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২৮, ২২ এপ্রিল ২০২৩   আপডেট: ১৩:০৫, ২৪ এপ্রিল ২০২৩
ছোটগল্প || অনুগামী আলো

কিছুদিন আগে আমি আব্বাকে নিয়ে একটা স্মৃতিচারণ পোস্ট করেছি ফেসবুকে। সেখানে বলেছি, ছোটবেলায় আমাকে পেছনে বসিয়ে আব্বা যে সাইকেল চালাত, আর গল্প করত, করত গান- সেটাই আমার সবচেয়ে পছন্দের শৈশবস্মৃতি। বলেছি, এ ছাড়াও গুলতি ঘুড়ি ডাংগুলি গোল্লাছুট বা বিলের কাদায় মাছ ধরতে গিয়ে সাপ ধরে ফেলা, অথবা ডাক্তারের বাগান থেকে আম চুরি করা, কিংবা সর্দারের গাছ থেকে রস চুরি করে খেতে গিয়ে ভূতের ঝাড়ি খাওয়াসহ আরো আরো স্মৃতি আমার আছে, যাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার ভালো লাগে, সুখ লাগে তাদের দু’হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে, ইচ্ছে জাগে এই ঝকঝকে তকতকে কাচের জগৎ ছেড়ে কাদার জগতে তাদের কাছেই ফিরে যেতে আবার। তবে কিনা তাদের কোনো কোনোটা ফুলের মতো কোমল, সুখ দেয় শুধু, কোনোটা আবার কাঁটার মতো, ব্যথা দেয় যন্ত্রণা দেয়; একহাতে ফুল আর একহাতে কাঁটা নিয়ে আমাকে একই সঙ্গে জ্বালায় এবং চালায় আব্বার হাসিমেশা ওই সাইকেল চড়ার স্মৃতিটুকুই। তাই ওটাই আমার প্রিয় সবচেয়ে।

সাইকেলটা ছিল পুরোনো। সারা ভাঙাচোরা উঁচুনিচু রাস্তা ধরে যত ক্যাঁচকুঁচ আওয়াজ করত সেটা, মনে আছে, তারচেয়েও বেশি কথা বলতাম আমরা।
আব্বা হয়তো জিজ্ঞেস করলেন- স্কুলে আজকে কী পড়েছো, আব্বা?
ক্লাসে পড়া বলার মতো করে সেদিনই শেখা ছড়াটা তখন আব্বাকে বলে দিতাম আমি।
বাব্বাহ! কত কিছু শিখছো তুমি। খুশি খুশি আব্বা পরের প্রশ্নে গেলেন- পড়তে তোমার ভালো লাগে?
লাগে, আব্বা। বাংলা স্যার খুব সুন্দর করে পড়ান। তবে স্যারের চেয়ে ম্যাডাম পড়ালে আরো বেশি ভালো লাগে।
বলতেই আব্বা হেসে উঠলেন জোরে। হাসির চোটে টাল খেয়ে উঠল হ্যান্ডেল, সাইকেল চলল এঁকেবেঁকে। সোজা চলার চেষ্টা করতে করতেই হয়তো আরেকটা কথা উঠল, আর আমরা হেসে উঠলাম আবার।

বাজার যাওয়ার পথটা এমনই ছিল, যেতে যেতে মনে হতো আব্বা আমার বন্ধু হয়ে গেছে। সুযোগ পেলে আমিও তাই জিজ্ঞেস করতাম যা মনে আসে তা।
একদিন বললাম, আচ্ছা, আব্বা, আপনিও কি আমার মতো স্কুলে যেতেন?
আব্বা বললেন, আমার মাথা তো তোমার মতো ভালো ছিল না, মাঠে যেতাম কাজ করতে, সেখান থেকে আর স্কুলে যাওয়ার কথা মনে থাকত না।
আমি বললাম, আপনি যেমন আমাকে মনে করে স্কুলে পাঠান, আপনার তেমন আব্বা ছিল না?
ছিল তো, আমার চেয়েও ভালো আব্বা ছিল সে। তবে কিনা সে ছিল কাজপাগল মানুষ; পড়া শিখতে পাঠানোর চেয়ে তার সঙ্গে নিয়ে কাজ শেখানোই বেশি পছন্দ করত, কাজ না পারলে মারতও। আমার তাই মাঠেঘাটে কাজেকাজেই কেটে যেত সারাদিন।

আমার আব্বার চেয়ে সে তাহলে ভালো আব্বা হয় কী করে! আমার আব্বা আমাকে ব্যাট কিনে দেয়, টিভি দেখতে দেয়, আর গল্প শোনায়, আর সবচেয়ে বড় কথা- কখনোই মারে না; আমার আব্বাই সবচেয়ে ভালো। বলতে বলতে পেছন থেকে আব্বার গা জড়িয়ে ধরলাম। আব্বা আর কিছু বললেন না। টুংটাং চলতে লাগল সাইকেল। আমিই আবার প্রশ্ন করলাম- আপনি যে আমারে বাজারে নিয়ে যান, আপনার আব্বা নিয়ে যেত?

যেত তো; তবে আমার আব্বার কোনো সাইকেল টাইকেল ছিল না, আমাকে কাঁধে বসিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যেত। কাঁধে উঠেই আমি হাততালি দিয়ে বলতাম- ইয়েএএ, আমি আব্বার চেয়েও বড়, আব্বার চেয়েও বড়। শুনে আব্বা হাসত। বলত, দেখো বাপ, তালে তালে তুমি কিন্তু এরচেয়ে বেশি বড় হয়ে যেও না, তালি কিন্তুক আকাশে মাথা ঠেকে যাবে! বেচারা আকাশ- আব্বা-মা নেই, যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, তাই ঝুলে ঝুলে থাকে- তোমার মাথার ধাক্কা যদি খায় তো করবে কী?

শুনে আমি সতর্ক হয়ে যেতাম, আকাশটাকে অক্ষত রাখার চেষ্টায় ঘাড় গুঁজে বসতাম। বসতাম সামনের দিকে ঝুকে আব্বার মাথার ওপর থুতনি ঠেকিয়ে। ফিরতি বেলার সন্ধ্যাপথে আকাশ যখন নিচে নেমে আসত আরো, ধাক্কা লাগার ভয়ে আমি নেমেই যেতাম কাঁধ থেকে।
আব্বা দেখে হাসত, হয়তো সেদিন মন ভালো তার, ভালো-মন্দ বাজার হয়েছে, এক হাতে সেই ফুলে ওঠা ব্যাগ আর হাতে আমার হাত ধরে রেখে সে ধরত গান- ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’।
গানের কথা শুনে আমারও তখন গান শুনতে ইচ্ছে হলো।
আব্বা বললেন, আমি তো আমার আব্বার মতো গান গাইতে পারি না।

এ কথা যদি মেনে নিই তবে তো এটাও মানতে হয় যে, আমার আব্বা তার আব্বার চেয়ে ছোট, আমি তাই বায়না জুড়লাম। সাইকেল চালানো দম-লাগা গলায় আব্বা তখন গেয়ে উঠলেন- ‘মরমিয়া তুমি চলে গেলে দরদি আমার কোথা পাবো, কারে আমি এ ব্যথা জানাবো’
গাওয়া শেষ হলে আমাকেও গাইতে বললেন আব্বা। আমি গাইলাম- ‘কাল নয়নেল আসা নিয়ে মন ভলাবোওও ওও; কালে আমি এ ব্যথা জানাবো’।
আব্বা বললেন, বাব্বাহ, তুমি তো আমার চেয়েও সুন্দর গেয়েছো!
তা কি হয়? আপনি তো বড় মানুষ, আমি আপনার সঙ্গে পারি?
অবশ্যই পারো। বড় হলে তুমি তো আমার চেয়েও বড় হবে। তখন আমিই পারব না তোমার সঙ্গে। পারব কী, তোমার নাগালই তো পাবো না আমি আর তখন..
কথাটা আব্বা প্রায়ই বলতেন। শুনে আমি চিন্তায় পড়ে যেতাম- সেটা কীভাবে সম্ভব? আমি বড় হয়ে গেলে কি আব্বা-মাও আরো বড় হয়ে যাবে না?
তা হবে, তবে বেশি বড় হলে মানুষ বুড়ো হয়ে যায় তো, তুমি যখন বড় হবে, আমি তখন বুড়ো। আর যত যা-ই হোক, বুড়োরা কখনোই বড়দের সঙ্গে পারে না।
শুনে আমার মন খারাপ হতো। আমি বলতাম, তাহলে আমি কখনোই বড় হবো না।
কেন বড় হবে না? তোমাকে যেন বড় করতে পারি সেজন্যই তো এত কিছু করি আমরা।
শুনি আর ভাবি, কিন্তু উত্তর দিতে পারি না। তবে সেদিন সেই বাজার যাওয়ার পথে হঠাৎ আমার খুলে গেল মাথা। বললাম, আমি বড় হলে যে আপনি আর মা বুড়ো হয়ে যাবেন! বুড়ো হলে তো দাদা-দাদির মতো ঘুমিয়ে থাকবেন ঘরের পেছনে, আমার সঙ্গে বাজারে আসতে পারবেন না। তারচেয়ে ভালো আমি এমনই থাকবো, আপনারাও তাহলে আর বুড়ো হতে পারবেন না।

হাসতে হাসতে সেদিন নাকি আব্বার খিল ধরে গেল পেটে। শুনে আমি বললাম- আব্বা, মানুষের পেট কি দরজা, যে খিল ধরবে? শুনে আরো জোরে হাসলেন আব্বা, আমার প্রশ্নের উত্তরই দিল না।
সারাদিন আব্বা কাজে থাকতেন, ব্যস্ত মানুষ। কোনো কোনো দিন দিনের বেলা আমাদের দেখাই হতো না। ফলে যত গল্প গান কথা আমাদের ওই সাইকেলে চড়েই করতে হতো। হাটবারের বিকেলগুলো তাই আমার কাছে ছিল ছুটিবারের মতোই, হাওয়াই মিঠাই- শুরু না হতেই যার শেষ হয়ে যাওয়ার স্বভাব।

যেতাম আমরা বাজারে। কই ট্যাংরা খলসে জিয়েল কাঁকলে কিনতাম, মেটে আলু আর নোনা ইলিশ আর কলা বেগুন শাক কিনতাম, ক্রিমবন লাটিম সুতো আর বরশি কিনতাম, এটা এবং সেটা কিনতাম। সেগুলো আমার পছন্দের ছিল খুব। কিন্তু তাদের চেয়েও আমার ওই যাওয়াটাই ছিল প্রিয় বেশি, আর তারপর আসাটা।
আসার সময় সন্ধ্যা, দোয়াত উপুড় করা কালি অন্ধকারের মতো বসে গেছে মাঠে মাঠে গাছে গাছে। আব্বার আবার চোখে সমস্যা, অন্ধকারে দেখতে অসুবিধা- জানতাম বলেই একদিন বললাম, চলেন আমরা দুজন হেঁটে যাই।
আব্বা হেসে বললেন, হাঁটলে তো এখন দুজন হবে না হবে তিনজন..
কীভাবে? আঙুল গুনে আমি বললাম, আমরা তো দু’জনই।
আব্বা বললেন, বা রে, সঙ্গে সাইকেলটাও কি হাঁটবে না!
এমন কথা শুনে আমি খুব অবাক হতাম, এমন করে আব্বা কেমন করে ভাবে? বললাম, তাহলে তিনজনই হাঁটি চলেন।
না, সাইকেল যখন সুস্থ থাকে, তখন তাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে হয় না।
ফলে সুস্থ সাইকেলটা চালিয়ে নিয়েই আসতেন অসুস্থ আব্বা। তখন আমাদের গতি হতো ধীর।

ধীরে চললে সাইকেল টাল খায়। মনে হতো এই বুঝি সেটা দিলো ধাক্কা মোড়লদের পাঁচিলে কিংবা গিয়ে পড়ল কোঠাবাড়ির পুকুরে। ভয়ে আমি তাই ক্যারিয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে পড়তাম সটান। পেছন থেকে শক্ত করে গলা জড়িয়ে ধরতাম আব্বার। আর বলতাম, আব্বা, একটা মটরসাইকেল কিনতে হবে, রাত হলেও সমস্যা নেই, হেডলাইটের আলোয় সব দেখা যাবে স্পষ্ট।
তা ঠিক বলেছো। কিন্তু, আমাদের যে অত টাকা নেই বাপ!
আচ্ছা, তাহলে সাইকেলেই একটা হেডলাইট লাগাতে হবে মটরসাইকেলের মতো।

আব্বা হাসতেন। বলত, হেড লাইট আর লাগবে কেন? পেছনে দাঁড়ায়ে তুমি যে আমার ব্যাকলাইট হয়ে আছো! দেখে দেখে তুমিই বলো যে কোন দিকে চালাবো কোন দিকে না; শুনে শুনে আমি সেভাবে চালাই।
আমি তাই ব্যাকলাইট হয়েই দাঁড়িয়ে থাকতাম আব্বার পেছনে। আর বলে দিতাম- আব্বা, একটা সাইকেল আসছে, একটা মানুষ, কিংবা গরুর গাড়ি একটা। বলে দিতাম- আব্বা, ওদিক দিয়ে গেলে বটগাছ, বটগাছে আমার ভয় করে, চলেন এপাশ দিয়ে যাই। বড় আর সোজা রাস্তা বাদ দিয়ে আব্বা তখন গ্রামের ভেতরকার এর-ওর কল-ধোয়া পুকুর-ছোঁয়া সরু আর পেঁচালো রাস্তা ধরতেন।

ওই রাস্তা ধরতে ধরতে একদিন আব্বা জিজ্ঞেস করলেন, বটগাছে তোমার ভয় কেন?
বটগাছে ভূত থাকে, লোকে বলে।
শুনে কেমন একটু হাসলেন আব্বা। ভূত থাক বা না থাক, বটগাছ তো বটগাছই। এখন দেখে ভয় পাচ্ছো, যেদিন থাকবে না সেদিন দেখবা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
এখন যে আমার ফাঁকা ফাঁকা লাগে খুব, লাগে একা একা ভীষণ, সেটা উল্লেখ করেই ফেসবুক পোস্টটায় লিখেছিলাম- বটগাছটাকে আবার যদি ফেরত পেতাম আমি, আবার যদি তার ব্যাকলাইট হতে পারতাম, যদি পারতাম পেছন থেকে তাকে জোরছে জড়িয়ে ধরতে!

এক ঝড় বাদলার রাতে নাকি এতই জোরে আমি জড়িয়ে ধরেছিলাম আব্বার গলা যে, দম নিতে পারছিলেন না তিনি। সাইকেল থামিয়ে আব্বা তখন বললেন, ভয় পাচ্ছো কেন, আমি তো আছি।
আমি নাকি বলেছিলাম আপনার জন্যই তো ভয় লাগছে, যদি একসিডেন্ট হয় আপনি যে ব্যথা পাবেন।
আব্বা আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। কপালে চুমু খেয়ে বলেছিলেন, ব্যথা পেলে পাবো, তুমি হাত বুলিয়ে দিলেই তো আবার সেরে যাবে সব।
সেসবও লিখেছিলাম।
আব্বার কোনো ফেসবুক আইডি নেই। কেউ হয়তো তার আইডি থেকে লেখাটা তাকে দেখিয়েছে, অথবা পড়ে শুনিয়েছে। আব্বা তাই আমাকে সত্যিই সাইকেলে চড়িয়েছেন আজ আবার।

আমি পেছনে বসে আছি। এঁটেল মাটির সেই হাঁটুধুলো কিংবা কোমরকাদার রাস্তায় এখন ইটের সলিং। চলায় চলায় কোথাও উঠে গেছে ইট, কোথাও ক্ষয়ে গেছে রাস্তা, রাস্তাটা তাই স্বাভাবিকের চেয়েও উঁচু-নিচু। এর মধ্যেই সাইকেল চালাচ্ছেন আব্বা। আর আমাকে জানাচ্ছেন তার জানা অজানা সব, যেন উজাড় করে তার সবকিছু আমাকে জানাতেই হবে।
এই যে জমিটা, এখানে একবার ধান কাটতে গিয়ে আমি আঙুল কেটে ফেলেছিলাম।
আমি সেখানে কোনো ধানখেত দেখি না, চোখ কচলে তাকাই, তবু দেখি না কিছু।
কিছুদূর যেতেই বললেন, আব্বা জানো, এই জায়গায় ধান উঠে গেলে আমরা ফুটবল খেলতাম। অবশ্য তোমার দাদা বলত বন্ধুরা মিলে তারা মাছ ধরত এখানে।
ধানখেত আর ফুটবল মাঠে দাদা মাছ ধরত কী করে- বিস্ময় প্রকাশ করি আমি। আব্বা বলেন, না মাঠ না, দাদার ছোটবেলায় নাকি এখানে খাল ছিল একটা, তারও দাদার সময় ছিল নদী। সেখানে তাকিয়ে দেখি নদী বা খাল বা খেলার মাঠ কিছুই দেখা যায় না; একপাশে দেখি শুকনো একটা খটখটে উঠোন আরপাশে ধান-সারের বড় আড়ত একটা আর মুদি দোকান। কিছুদূর গিয়ে আব্বা বললেন, তুমি তখন বড় হয়ে গেছো, আমি হইছি বুড়ো, এখান দিয়ে আসছিলাম রাতের বেলা, তোমার কথামতো হেডলাইটও লাগানো হয়নি, আবার চোখের জ্যোতিও কম, ধুম করে গিয়ে ধাক্কা খাইলাম একটা কারেন্টের খুঁটিত।

আমি কিছু বলতে পারি না, ব্যাকলাইটগুলো বড় হয়ে গেলে হেডলাইটের ব্যবস্থা না করেই আব্বাদের ছেড়ে চলে যায়, জানি বলেই কিছু বলি না। শুধু শুনি, আর দেখি।
দেখি যত আব্বা এগিয়ে যাচ্ছেন, যত প্যাডেল মারছেন, পায়ের মাংসপেশী তত ফুলে উঠছে তার। গলার রগও যে হয়ে উঠছে দড়ির মতো সেটা পেছন থেকে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু বুঝতে পারছি। কথার ভার আর বাধো বাধো ভাবে বুঝতে পারছি আব্বার দম নিতে কষ্ট হচ্ছে, আব্বার প্যাডেল চলছে না। সাইকেল তাই চলছে একেবারে না-চলার মতো। সাইকেলের মাথা তাই বাঁয়ে যাচ্ছে হেলে ডানে যাচ্ছে দুলে।

ভালো করে তখন খেয়াল করে দেখি, সাইকেলের চেন জঙে জর্জর প্যাডেল গেছে ক্ষয়ে আর চাকায় নেই হাওয়া। এমন হলে সে সাইকেল একা চালানোও তো কষ্টের, তবু আমার মতো দুইমণি এক বস্তা নিয়ে চালাচ্ছেন আব্বা!
ভেবে আমি শিউরে উঠি। বলি, আব্বা, রাখেন, আমার সাধ মিটে গেছে, আর চালাতে হবে না। চলেন আমরা হেঁটে যাই।
আব্বা কিছু বলেন না। সাইকেলটা যেন আরো ধীরে চলে, আরো ধীরে চলে।
আমি বলি, আব্বা সাইকেলটা এবার আমারে দেন আমি চালাই, আপনি আমার ব্যাকলাইট হন।
শুনতেই আব্বা বোকা বোকা গলায় বলেন, না, না, হাওয়া নেই চাকায়, তোমার কষ্ট হবে।
না আব্বা, কষ্ট তো আপনারও হচ্ছে- যুক্তি দিই আমি, বুদ্ধি করে বলি- আপনার কষ্ট হলে তো আমারও কষ্ট হয়।
তবু কিছু বলেন না আব্বা।
কেন বলে না? আব্বা কি শব্দ খুঁজছে, নাকি হারিয়ে ফেলা দম?
বুঝতে না পেরে আমি একই কথা বলি।
এবারও আব্বা কিছুই বলেন না।

ফলে আমি গায়ে হাত দিয়ে দেখতে চাই আব্বা কথা বলছেন না কেন। আর তখনই ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগে। চোখ কচলে দেখি আব্বা সেখানে নেই। সাইকেলটাও চলছে না, পড়ে আছে পাশেই, পাংচার হওয়া চাকাটা ঘুরছে অহেতুক, কিন্তু সে ঘোরায় পথ এগোয় না।
দেখি আর আমার বুক ধড়ফড় করে।
দেখি আর আমার আব্বার কথা মনে হয়।

আর আমার মনে পড়ে যায় এমনই এক বাজার-ফেরত সন্ধ্যার রাস্তায় আব্বা হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন চলন্ত সাইকেল নিয়ে। হেডলাইট বিকল ছিল তার, চালু ছিল না ব্যাকলাইটও। আব্বা খুব ব্যথা পেয়েছেন, ব্যথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার কেউ ছিল না। আব্বা দম নিতে পারছেন না, মুখে ফুঁ দিয়ে শ্বাস আনার কেউ ছিল না। লোকেরা বলেছিল লাশটা যখন পেয়েছিল তারা, আব্বার চোখ তখন ভেজা ছিল। তার মানে আব্বা কাঁদছিলেন, তার মানে আব্বা কেঁদেছিলেন, কোমল হাতে কান্নাটুকু মুছে দেওয়ারও কেউ ছিল না পাশে।
কেন ছিল না?

ভাবতেই আমার চমক ভাঙে। আমি কেঁপে উঠি, সেই কাঁপুনিতে নড়ে ওঠে খাট, আর আমি দেখি আমি শুয়ে আছি। আমি দেখি বহু বছর পর আমি আমার আব্বাকে দেখলাম, কিন্তু আসলে দেখলাম আমাকেই। আমার খুব কান্না পায়, এমন কান্না আমি প্রায়ই কাঁদি, তবে চেপে রেখে, আজ আর আমার কান্না আমি চেপে রাখতে পারি না, আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদি।
সেই আওয়াজে আমার ছেলেটার ঘুম ভাঙে। সে আমার গায়ে হাত বুলায়, বলে- ড্যাড, আর ইউ ক্রায়িং?
আমি উত্তর দিতে পারি না, ফোঁপাতে ফোঁপাতে খানিক শব্দ করি শুধু।
হোয়াই আর ইউ ক্রায়িং, ড্যাড, চিন্তিত স্বর তার- হ্যাভ ইউ ড্রিমট এ ব্যাড ড্রিম?
আমি তাকে বলি, না, দুঃস্বপ্ন না, আমি আমার আব্বাকে দেখেছি। বলি আই মিস মাই ড্যাড, বাবা।
সে তখন তার ছোট ছোট আঙুল দিয়ে আমার চোখ মুছে দেয়।
একদিন জিজ্ঞেস করেছিল কাউকে মিস করলে কী হয়? আমি বলেছিলাম ব্যথা হয়।
কোথায় ব্যথা হয়?
মনে।
মন আবার কী? কোথায় থাকে সে?
মন কোথায় থাকে তা কি আমি জানি? তবু, বাচ্চা মানুষ জানতে চেয়েছে, বুকের মাঝখানে আঙুল নির্দেশ করে বলি, এখানে, এখানেই কোথাও মনটা থাকে। থাকে ঘাপটি মেরে, আমরা বুঝতে পারি না, তবে ব্যথা হলে বুঝি, যে সেটা আছে; যেমন বাবা যেমন বটগাছ, হারালেই কেবল বুঝি যে সে ছিল। 

আমি জানলার দিকে মুখ করে শুয়ে আছি কাৎ, ছেলেটা আমার পেছনে। পিঠের দিক থেকেই আমাকে সে জড়িয়ে রেখেছে। হঠাৎ আমাকে ডিঙিয়ে সে সামনের দিকে আসে। আমার গলার নিচে হাত দিয়ে বুকে নেওয়ার মতো করে আমাকে জড়িয়ে ধরে। বুকের মাঝখানে যেখানে মন আছে বলে ওর ধারণা, সেখানে ফুঁ দেয়, হাত বুলায়, আর বলে এই যে আমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, এই যে দেখো সেরে যাচ্ছে ব্যথা।

আমার মনে পড়ে, আব্বা কোথাও ব্যথা পেলে ঠিক এভাবেই হাত বুলিয়ে দিতাম। আমি তাই আরো জোরে কাঁদি। আর ছেলেটা আরো জোরে হাত বুলায়। আর বলে, পাগল ড্যাড, কেন মিস করছো, এই যে আমি!

তারা//

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়