ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

দৈনন্দিন জীবনে তাকওয়া যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ

প্রকাশিত: ১৩:৩৬, ১৬ মার্চ ২০২৪   আপডেট: ১৪:০৬, ১৬ মার্চ ২০২৪
দৈনন্দিন জীবনে তাকওয়া যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ

বিশ্বনবী সা. এর প্রখ্যাত সাহাবী আনাস রা. বর্ণনা করেন, একদা এক ব্যক্তি এসে নবীজি সা. কে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল সা. আমি সফরে বের হচ্ছি। আমাকে কিছু পাথেয় দিন। নবীজি সা. দোয়া করলেন: আল্লাহ তোমাকে তাকওয়ার পাথেয় দান করুন।’ (তিরমিযি: ৩৪৪৪)

মক্কা বিজয়ের পর ঐ দিনই রাসূল সা. হযরত বেলাল রা. কে বায়তুল্লাহর মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করলেন। এতে মক্কার কোরাইশ কাফেররা কিছুটা বিভ্রাটে পড়ে গেল। তাদের একজন বলল, আল্লাহকে ধন্যবাদ যে আমার পিতা পূর্বেই মারা গেছেন। তাকে এই কুদিন দেখতে হয়নি। হারেস ইবনে হিশাম বলল, মুহাম্মাদ সা. মসজিদে হারামে আজান দেওয়ার জন্য এক কালো কাক ব্যাতীত অন্য কোনো মানুষ পেলেন না? আবু সুফিয়ান রা. বলল, আমি কিছুই বলব না। কারণ আমার আশঙ্কা হয় যে, আমি কিছু বললেই আকাশের মালিক তাঁর (মুহাম্মাদ সা.) কাছে তা পৌঁছে দিবেন।

ইত্যবসরে জিবরাঈল আ. এসে রাসূল সা. কে তাদের সব কথা বলে দিলেন। নবীজি সা. সাথে সাথে তাদের ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি এসব কথা বলেছো? অগত্যা তাদের স্বীকারও করতে হলো। তখন আয়াত নাজিল হলো: অর্থাৎ-তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি যার মধ্যে ‘তাকওয়া’ সর্বাধিক। (সূরা হুজরত: ১৩) হযরত বেলাল রা. এর মধ্যে তাকওয়া ছিল পরিপূর্ণ। কাজেই তিনি গায়ের রং-এ কালো হতে পারেন কিন্তু আল্লাহর নিকট তার মর্যাদা অনেক বেশি।

‘তাকওয়া’ আরবি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ হলো: রক্ষা করা, সতর্কতা অবলম্বন করা, ভয় করা, বিরত থাকা, সংকোচ বোধ করা ইত্যাদি। নবীজি সা. এর পরে ইসলামের দ্বিতীয় রাষ্ট্রনায়ক বিশিষ্ট সাহাবী উমর ইবনুল খাত্তাব রা. আরেক সাহাবী উবাই ইবনে কা’আব রা. কে ‘তাকওয়া’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। কা’আব রা. উত্তর দিলেন, আপনি কি কাটাযুক্ত পথ দিয়ে কখনও চলাচল করেছেন? উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। সেখানে কীভাবে চলেছেন? উমর রা. বললেন, কাপড় উচুঁ করে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে চলেছি। কা’আব রা. উত্তর দিলেন এটাকেই ‘তাকওয়া’ বলে। অর্থাৎ আল্লাহর ভয় ও মুহাব্বত অন্তরে সদা জাগুরুক রেখে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশনা অনুযায়ী সতর্কতার সাথে জীবন পরিচালনার নাম হলো ‘তাকওয়া’। 

ব্যক্তিগতভাবে এই ‘তাকওয়া’ অর্জনের জন্য রোজাকে ফরজ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে: ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেভাবে তোমাদের পূর্বসূরীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল, যেন তোমরা মুত্তাকি (আল্লাহভীরু) মানুষে পরিণত হতে পারো।’ (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৩) এই তাকওয়া মানবজীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। যার মধ্যে তাকওয়া আছে তাকে বলা হয় ‘মুত্তাকী’। রোজার মূল লক্ষ্যও মানুষকে মুত্তাকী বানানো। 

‘তারিখে দামেশক’-এ একটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে: নিয়মিত অভ্যাস অনুযায়ী একদা এক রাতে উমর রা. বের হলেন প্রজাদের অবস্থা জানার জন্য। চলতে চলতে উমর রা. এর কানে ভেসে এলো ফিসফিস আওয়াজ। তিনি কান খাড়া করলেন। বুঝতে পারলেন অদূরে কোনো এক ঝরনার পাড়ে বসে দুই নারী কথা বলছেন। কী করছেন তারা? ভারি কণ্ঠে  একজন তার মেয়েকে বললেন, মা! ঝরনা থেকে একটু পানি এনে দুধের সাথে মিশিয়ে দাও। অপরজন বলল, না, দুধে পানি মিশিয়ে সেটা বিক্রি করলে এটা ধোঁকা হয়ে যাবে। আমি করতে পারবো না। মা বললেন, দ্রুত পানি মেশাও। কেউ দেখবে না। এখানে খলিফা ওমর এর কোনো লস্কর নেই যে আমাদের কাজ দেখে ফেলবে। মেয়ে বলল, আমাদের এ কাজ ওমর রা. এর লস্কর দেখবে না কথা ঠিক কিন্তু খলিফা যার লস্কর সেই মহান আল্লাহ সব দেখছেন। তাঁকে তো ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়। কাজেই আমি এ কাজ করতে পারবো না। 

এ কারনে ইসলাম সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় তাকওয়াভিত্তিক পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করাকে। আল্লাহ তাআলার নিকট মুত্তাকী ব্যক্তির মর্যাদা সবচেয়ে বেশি। চাই সে গরিব, ধনী, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, রাজা বা প্রজা। এক কথায় সে ব্যক্তি আমাদের সামাজিক মূল্যায়নে যে স্তরেই থাকেন না আল্লাহর নিকট তিনি মর্যাদাবান। মুত্তাকী ব্যক্তি সদা সমাজের কল্যাণ করে থাকেন। তার দ্বারা ইচ্ছাকৃত পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি হয় না বরং একটি সোনালী সমাজ এমন মুত্তাকী ব্যক্তি ছাড়া গঠন করা সম্ভব নয়।

ইমাম আবু হানীফা রহ. এর জীবনীতে পাওয়া যায়, তিনি কাপড়ের ব্যবসা করতেন। একদা তিনি দিনের বেলাতেই দোকান বন্ধ করতে লাগলেন। পাশের দোকানিরা প্রশ্ন করল- ভাই আপনি দিনের বেলায় দোকান বন্ধ করছেন কেন? ইমাম আবু হানীফা রহ. বললেন, দেখুন আজ আকাশ মেঘলা। সূর্যের আলো যথাযথ না থাকায় আমার দোকানের কাপড়গুলো স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় কেউ কাপড় কিনে ধোঁকায় পড়ে যেতে পারে। এ আশঙ্কায় আমি দোকান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

বর্তমান সমাজের সঙ্গে বিষয়টা মিলিয়ে দেখুন তো, তাঁরা কেমন মানুষ ছিলেন আর আমাদের অধিকাংশের কি অবস্থা? তাঁরা এমনটা করতে পেরেছেন, কারণ তাদের মধ্যে তাকওয়া তথা আল্লাহর মুহাব্বাত, তাঁর শাস্তির ভয় ছিল প্রকট। ফলে তাদের পক্ষে কোনো ধরনের অন্যায় করা জীবন গেলেও সম্ভব ছিল না। আজো যদি আমরা সত্যিই তাকওয়া অর্জন করতে পারি তবে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র অবশ্যই সর্বোন্নত এবং শান্তিময় সমাজ ও রাষ্ট্রে পরিণত হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আমাদের মাহে রমজানে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জনের তৌফিক দিন, আমীন।

শাহেদ//

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়