ঢাকা     সোমবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৭ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

রমজানের আমল এবং পাপমুক্ত হওয়ার পথ 

মুফতি আতাউর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১১, ৫ মার্চ ২০২৫  
রমজানের আমল এবং পাপমুক্ত হওয়ার পথ 

পবিত্র রমজান হলো আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহের মাস। এই মাসে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি তাঁর দয়া ও অনুগ্রহ অবারিত করেন। রমজান মাসে আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের কথা সবাই জানে, তবে অনেকেই হয়ত ভুলে যান যে, এই মাসের মূল্যবান সময় যারা কাজে লাগাতে পারে না তাদের জন্যও রয়েছে কঠোর হুঁশিয়ারি। 

হাদিসে বলা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) সেসব মানুষের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ করেছেন যারা রমজান মাসে তাদের গুনাহ ক্ষমা করাতে পারেনি। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বদদোয়ার পর জিবরাইল (আ.) আমিন বলেছেন। সুতরাং এই বদদোয়া প্রতিফলিত হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। তাই মুমিনের উচিত রমজানে জীবনের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হওয়ার চষ্টো করা। আল্লাহর কাছে বেশি বেশি তাওবা ও ইস্তিগফার করা। 

আরো পড়ুন:

রাসুলুল্লাহ (সা.) পাপমুক্ত হওয়ার পথও বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রেখে সাওয়াবের নিয়তের রমজানে রাত্রী জাগরণ করে (তারাবি ও তাহাজ্জুদ) আল্লাহ তার পূর্ববর্তী সব পাপ মার্জনা করে দেন।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস :  ২২০২)

হাদিসে ব্যবহৃত ঈমান (বিশ্বাস) ও ইহতিসাব (সাওয়াবের আশা) শব্দদ্বয়ের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সব অঙ্গীকারকে সত্যজ্ঞান করা এবং প্রতিটি কাজে আল্লাহর কাছে প্রতিদান প্রত্যাশা করা; একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য তাঁর সন্তুষ্টি লাভের আশা করা, সবকাজের আগে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির বিষয়টি বিবেচনা করা। 

ঈমান ও ইহতিসাবের বিশ্বাস মানুষের আমলের মূল্য বৃদ্ধি করে। বিশ্বাসের দৃঢ়তার সুফল হলো তা মানুষকে আরশে আজিম পৌঁছে দেয়। আর কারো ভেতর এই গুণের অভাব থাকলে তার যাবতীয় আমল ও প্রচেষ্টা অর্থহীন হয়ে যায়। বর্তমানে মুসলমানদের ভেতর যেন আমলের প্রতি অনাগ্রহ দেখা যায়, তেমনি যারা আমল করেন তাদের কেউ কেউ ঈমান ও ইহতিসাব সম্পর্কে ধারণা রাখে না। তাদের আমলগুলো হয় উদ্দেশ্যহীন ও আশাহীন। এটা অনেকটা স্রোতের সঙ্গে সঙ্গে ভেসে যাওয়ার মতো। আমরা ওজু করি কিন্তু নিয়ত করি না। অথচ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পবিত্রতা অর্জনের নিয়ত করলে সাওয়াব ও প্রতিদান বেড়ে যায়। একইভাবে আমরা নামাজ আদায় করি কিন্তু তাতে বিশ্বাস ও প্রতিদানের আশা থাকে না, মনে হয় যেন সমাজের অন্য ১০ জনের দেখাদেখি সব করি। 

রমজান মাসে আমলের পরিবেশ তৈরি হয়। মানুষ অন্য সময়ের তুলনায় অধিক পরিমাণ ইবাদত করতে আগ্রহী হয়। যারা সারা বছর মসজিদে যায় না তারা মসজিদে যাওয়ার চেষ্টা করে, দিন-রাতের কোনো এক সময় কোরআন তিলাওয়াত করে, দান-সদকার পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। এখন দেখার বিষয় হলো আমার এই আমলগুলো নিস্ফল হয়ে যাচ্ছে কি না? বহু রোজাদার কেবল সামাজিক লজ্জার ভয়ে রোজা রাখে। এমন রোজা ও আমলে কোনো প্রাণ থাকে না, এর কোনো বিনিময়ও আশা করা যায় না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সমস্ত আমলের প্রতিদান নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১)

রোজা ও সিয়াম সাধনার মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর নির্দেশ মান্য করা। তার সন্তুষ্টির জন্য যেসব বিষয় তিনি ত্যাগ করতে তা ত্যাগ করা। রোজাদার যখন বিশ্বাস করবে আল্লাহ যা বলেছেন সত্য বলেছেন, তিনি আমাকে প্রতিদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, আমি অবশ্যই তার সেই প্রতিদান পাবো, তখন সে আত্মিক প্রশান্তি খুঁজে পাবে। আল্লাহর দরবারেও এর মূল্য বেড়ে যাবে।

কোনো ইবাদত কবুল হওয়ার প্রমাণ হলো, তা আদায়ের সময় অন্তরে বিনয় ও আত্মনিবেদনের আগ্রহ তৈরি হওয়া। বিপরীতে যদি ইবাদতকারীর ভেতর অহমিকা, আত্মমুগ্ধতা ও আত্মপ্রদর্শনের ভাব জাগ্রত হয়, তবে ধরে নিতে হবে আমল কবুল হয়নি। তাতে ত্রুটি আছে। আমলের এই ত্রুটি দূর হবে ঈমানের দৃঢ়তা ও ইখলাসের পূর্ণতার মাধ্যমে। এক ব্যক্তি বলছিলেন, ইফতারের অপার্থিব প্রশান্তি লাভের জন্য আমি রোজা রাখি। অথচ আল্লাহর প্রতি তার বিশ্বাস নেই। এই ব্যক্তির রোজা পরকালে কোনো কাজে আসবে না। সুতরাং রমজান মাসের কল্যাণ, দয়া, অনুগ্রহ ও ক্ষমা লাভের জন্য দিনে কয়েকবার নিয়ত বিশুদ্ধ করে নেওয়া এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির বিষয়টি সবসময় স্মরণে রাখা আবশ্যক। 

রোজার প্রধান উদ্দেশ্য আল্লাহভীতির মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণ অর্জন। কেননা রোজা মানুষের রিপু ও প্রবৃত্তি দুর্বল করে। ফলে মানুষের ভেতর দ্বিন পালনের আগ্রহ তৈরি হয়, ইবাদতে তৃপ্তি এনে দেয়। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল পূর্ববর্তীদের ওপর; যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩)

তাকওয়া সাধারণ অর্থ আল্লাহভীতি। বুজুর্গ আলেমরা এর অর্থ করেন ‘বিবেচনা' দ্বারা। অর্থাৎ এই বিষয়ে সতর্ক হওয়া যে আল্লাহ কোন কাজে সন্তুষ্ট হবেন এবং কোন কাজে অসন্তুষ্ট হবেন, আল্লাহ কোন কাজ বৈধ করেছেন এবং কোন কাজ অবৈধ করেছেন। রমজানে দীর্ঘ এক মাস যখন মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির বিষয়গুলো বিবেচনা করে চলবে, পাপ-পঙ্কিলতা ত্যাগ করবে, হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করবে, তখন তা তার অভ্যাসে পরিণত হবে। কেউ যদি এই পথ অনুসরণ না করে তবে সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্য অর্জিত হবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ঘোষণা হলো ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০৩)

সুতরাং আমাদের উচিত, রমজানের রোজাসহ অন্যান্য ইবাদতগুলো ঈমান ও ইহতিসাবের সঙ্গে করা। যেন তা পরকালে আমাদের পাথেয় হিসেবে গণ্য হয়। আল্লাহ সবাইকে তাওফিক দিন। আমিন।

লেখক: মুহাদ্দিস, সাঈদিয়া উম্মেহানী মহিলা মাদরাসা, ভাটারা, ঢাকা।
 

শাহেদ//

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়