ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০৯ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৬ ১৪৩১

কোরিয়াগামী ইপিএস কর্মীদের ভাগ্য অনিশ্চিত

মোহাম্মদ হানিফ, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৪৬, ১৫ আগস্ট ২০২১   আপডেট: ১৮:২৫, ১৫ আগস্ট ২০২১
কোরিয়াগামী ইপিএস কর্মীদের ভাগ্য অনিশ্চিত

ছবি: হানিফ

১৮ হাজার বাংলাদেশির বসবাস দক্ষিণ কোরিয়ায়। সংখ্যার হিসেবে এটি কম হলেও শিক্ষার মান ও উচ্চ বেতনের কারণে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছেন এমপ্লয়মেন্ট পারমিট সিস্টেম (ইপিএস) কর্মীরা।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই ভিসা জটিলতা আর পরপর দুইবার নিষেধাজ্ঞার কবলে আটকে পড়ে আছে দুই হাজারেরও বেশি কর্মী। বন্ধ রয়েছে কমিটেড এবং নতুন ইপিএস কর্মীদের প্রবেশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন পরিস্থিতি সমাধান না হলে আগের চেয়ে আরও খারাপ হতে পারে। যাতে শ্রমবাজার হারানোর আশঙ্কাও থেকে যায়। এছাড়াও, দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।

কোরিয়ার শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো ইপিএস কর্মী একই কোম্পানিতে চার বছর দশ মাস কাজ করলে তারা কমিটেড হিসেবে দেশে গিয়ে আবার কোরিয়াতে আসতে পারেবে।  সেই কমিটেডের নিয়ম অনুযায়ী ৩ মাসের জন্য দেশে গিয়েছিলেন যায়েদ হোসাইন। ১৪ মাস পার হয়ে গেলোও এখনো কোরিয়ায় আসতে পারেননি।

যায়েদ হোসেন বলেন, একই কোম্পানিতে বেসিক বেতনে কষ্টের কাজ করেছি শুধু কমিটেড ওয়ার্কার হিসেবে দেশের ভাবমূর্তি রক্ষা আর কোরিয়াতে আবার ফিরবো বলে।  সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিগত দেড় বছর আমাদেরকে অপেক্ষা করার পরামর্শই দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এখনো কোনো আশার বাণী পেলাম না।  এই অবস্থায় এক দেড় বছর আটকেপড়া কর্মীরা অনেকটাই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। যায়েদের মতো একই সারিতে ৮৬২ জন ইপিএস কমিটেড কর্মী আবার কোরিয়ায় প্রবেশের প্রহর গুণছেন।  আর ভিসা ইস্যু হওয়া এক হাজারেরও বেশি কর্মী দেড় বছর ধরে আটকে আছে। তবে এর পেছনে কূটনৈতিক দূর্বল প্রচেষ্টাকে দায়ী করছেন অনেক ইপিএস কর্মীরা।

অপেক্ষার পর অপেক্ষা! কিন্তু কোরিয়ান মালিকরা তাদের নিজেদের স্বার্থে অপেক্ষার জায়গাটা খালি রাখেন না। যেমনি অবশেষে অপেক্ষার ফল বিষাদময় হয়ে দাঁড়িয়েছে ইপিএস কর্মী নাজমুল ইসলামের। দেশ থেকে আর না নিয়ে আসার অপরাগতা প্রকাশ করেন কোরিয়ান মালিকপক্ষ। পাজুতে একটি ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন তিনি।

নাজমুল ইসলাম বলেন, কমিটেড কর্মী হয়ে কোরিয়ায় ফেরার প্রত্যাশায় ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে দেশে  আসছিলাম। দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার এই আশায় দেশেও কোন কিছু শুরু করার সুযোগ পাচ্ছি না। এমন অনিশ্চিত ভাগ্য নিয়ে দুচিন্তায় দিন কাটাতে হচ্ছে।  হঠাৎ গত দুই মাস আগে মালিক ফোন করে বলে দিলো তুমি না আসতে পারলে কিছু করার নাই, আমি অন্যদেশ থেকে লোক নিয়ে নিচ্ছি। 

ইপিএস কর্মীরা মনে করে, সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্তের অভাব, জাল করোনা সাটিফিকেট এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা আটকেপড়ে আছে আমাদের মতো ইপিএস কমিটেড কর্মীরা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতে প্রায় প্রতিটি ইপিএসভিত্তিক দেশ সঠিকভাবে পরীক্ষা করে কর্মীদের কোরিয়ায় পাঠায়। কিন্তু বাংলাদেশি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে শ্রমিকদের করোনা পরীক্ষা সঠিকভাবে করানোর তাগিদ দেয়। যেন করোনা আক্রান্ত কোনো শ্রমিক দেশটিতে প্রবেশ করতে না পারে। কিন্তু তারপরও ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হয়নি।  ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত দেশটিতে প্রবেশ করা ৩৩ জন কর্মীর শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ এপ্রিল থেকে আবারও বন্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশের জন্য কোরিয়ার দরজা। কপাল পুড়ল ইপিএস কর্মীদের বাংলাদেশের জন্য কোরিয়া সম্ভাবনাময় শ্রম বাজার। কোরিয়ার কোম্পানিগুলো বাংলাদেশি কর্মীদের পছন্দ করে। নিরুপায় না হলে বাংলাদেশি শ্রমিকরাও কোম্পানি ছাড়েন না। করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশে এসে আটকা পড়েছেন কমিডেটসহ দুই হাজারেরও বেশি কর্মী।  তাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে এখনও দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। অনেক কর্মী তাদের পুরনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে চান কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না।

প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোরিয়ান মালিকরা বাংলাদেশিদের নিয়োগ দিতে আগ্রহী। কিন্তু বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে আনে দূতাবাস। কিন্তু সেটাও বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। হতাশ ইপিএস কর্মীরা জানান, সমস্যা নিয়ে সবাই আলোচনা করেন কিন্তু সমাধান কিছু হয় না।  অথচ এ একটি বাজার সক্রিয়ভাবে ধরে রাখতে পারলে বাংলাদেশ বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতে পারে।  দক্ষিণ কোরিয়ার শ্রম বাজারে নেপাল, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে কেবিজ-এর বাংলাদেশি শিক্ষক (কোরিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে সেতু হিসাবে কাজ করে যাচ্ছেন) শেখ মুরাদ হোসেন বলেন, ‘যারা কমিটেড মালিক চাইলে আজ না হয় কাল যেকোনো সময় কোরিয়ান অথরিটি অনুমতি দিলেই তারা কোরিয়াতে প্রবেশ করতে পারবে।  আর মালিক যদি অপেক্ষা না করে তাহলে ভাগ্য খারাপ ছাড়া আর কিছুই নয়।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘বিচক্ষণ কোরীয়রা জরিপ করে কোন দেশে সবচেয়ে নিরাপদ বেশি, স্বাস্থ্য সচেতন এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ তারা জরিপের ফলাফল অনুসারে সেসব দেশের লোকদের মালিকদের চাহিদা অনুযায়ী আগে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।  আশা করি বাংলাদেশের ওপর সব অশুভ আঁধার কেটে যাবে।'

বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসেল) রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একমাত্র জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান।  করোনাকালে দেশে আটকে থাকাদের ফেরত আর ভিসা নিষেধাজ্ঞা তুলতে বেশ উদ্যোগী ছিল বোয়েসেল।

কোরিয়াতে প্রবেশের জন্য প্রতিটি ইপিএস কর্মী কোভিড ভ্যাকসিন প্রয়োগ, বাংলাদেশে কোয়ারেন্টাইন এবং কোরিয়াতে প্রবেশ করার পরেও কোয়ারেন্টাইন করার মাধ্যমে কোরিয়া প্রবেশের পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বোয়েসেল ও এইচআরডিকে অনুরোধ করেছে ইপিএস কর্মীরা। 

জানা গেছে, সে উপলক্ষে বেশিরভাগ ইপিএস কর্মী কোভিড ভ্যাকসিনের প্রথম-দ্বিতীয় ডোজ অনেকেই গ্রহণ করেছেন এবং অনেকেই অপেক্ষায় আছেন। পাশাপাশি আটকেপড়া ইপিএস কর্মীদের মধ্য থেকে কিছু প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছে। তারা মনে করেন, প্রস্তাবনাগুলো শর্ত হিসেবে মেনে নিয়ে হলেও কোরিয়া প্রবেশ করতে আগ্রহী।

হানিফ/হাসান/এসবি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়