জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি
একজন মুনীর চৌধুরী : চিরভাস্বর বাঙ্গালির মন ও মননে
মোমিন মেহেদী || রাইজিংবিডি.কম
মুনীর চৌধুরী (ফাইল ফটো)
মোমিন মেহেদী
ঢাকা, ২৬ নভেম্বর: মুনীর চৌধুরীকে ভুলতে বসেছে এই দেশ এই জাতি/ যিনি লিখেছেন যিনি বলেছেন ফুলিয়ে বুকের ছাতি/ নিজেকে নিয়ে কখনোই নয়; ভাবনা ছিলো দেশ/ সেই মানুষের সকল স্বপ্ন করলো যারা শেষ/ সেই হায়েনা- সেই রাজাকার- সেই পাকিদের গালে/ জুতা মারার দিন এসেছে মারবো তালে তালে/ আসো না সবাই এক হয়ে যাই গড়ে তুলি আজ যুদ্ধ/ এই যুদ্ধ-ই করবে ওদের দেখবে কারারুদ্ধ/ বিজয় হবে বাংলাদেশের বিজয় হবে আবার/ করতে দেবো না কোন হায়েনাকে সোনার স্বদেশ সাবার...
বাংলা সাহিত্যের জন্য নিবেদিত মানুষদের একজন মুনীর চৌধুরী। তিনি নিজেকে কখনোই জ্ঞান ও কাজের বাইরে রাখেননি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেশ ও মানুষের কল্যাণের কথা ভেবেছেন। ভেবেছেন নতুন করে দেশ, সমাজ ও মানুষকে সাজানোর কথা। তিনি একাধারে ছিলেন শিক্ষাবিদ, নাট্যকার , সাহিত্য সমালোচক ও ভাষাবিজ্ঞানী।
মুনীর চৌধুরীর জন্ম ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার মানিকগঞ্জে। মা বাবার চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন তিনি। বাবা আব্দুল হালিম চৌধুরী তখন মানিকগঞ্জের এস ডি ও। অবশ্য হালিম চৌধুরীর পৈত্রিক বাড়ি নোয়াখালী জেলায় রামগঞ্জ থানার গোপাইরবাগ গ্রামে।
১৯৪১ সালে মুনীর চৌধুরী ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকেই প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। বাল্যকাল থেকেই অসাধারণ মেধাবী ছিলেন মুনীর। তবে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনায় মনোযোগী তিনি কখনোই ছিলেন না। পাঠ্যবইয়ের ছকবাঁধা পাঠ্যক্রম তাঁকে কখনোই আকর্ষণ করেনি। বাল্যকাল থেকেই ছিলেন প্রচন্ড দুরন্ত স্বভাবের। কৈশোরে এসে তা আরো বেড়ে যায়।
যে বছর তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন সে বছরেই তাঁকে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে আই.এস.সি.-তে ভর্তি করানো হয়। ছেলের দুরন্তপনার কথা চিন্তা করে বাবা চেয়েছিলেন ছেলেকে ডাক্তারি পড়াবেন। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। আই.এস.সি এর চূড়ান্ত পরিক্ষায় দুই বিষয়ে পরিক্ষা না দিয়েই তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। দুই বিষয়ে পরিক্ষা না দিয়েও তিনি দ্বিতীয় বিভাগ নিয়ে পাশ করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ইংরেজি বিষয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর মুনীর চৌধুরীর জীবন কিছুটা অন্যদিকে বাঁক নেয়। নতুন পরিবেশ, পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট, নতুন অভিজ্ঞতা সব মিলিয়ে তাঁর শিক্ষা ও ব্যক্তিজীবন আরো সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ পেল। প্রতিভাদীপ্ত, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন তরুণ ছেলেগুলো তাঁকে আকর্ষণ করল। তাঁদের মেধা আর প্রজ্ঞা তাঁকে মুগ্ধ করল। রবিগুহ, দেবপ্রসাদ, মদন বসাক, সরদার ফজলুল করিম প্রত্যেকেই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক একটি উজ্জ্বল মুখ। এ সময় তিনি বাম ছাত্ররাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন।
তিনি এক সাথে রাজনীতি, সাহিত্যচর্চা, নাট্যচর্চা চালিয়ে যান। তখনই রণেশ দাশগুপ্ত, অচ্যুত গোস্বামী, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত প্রমুখ প্রগতিশীল লেখক ও রাজনীতিকদের সাথে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।
স্বাধীনতার স্বপ্ন তখন দেখতে শুরু করেছে পুরো ভারতবর্ষের মানুষ। একটু একটু করে সবাই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে থাকে। এমনি করে এগিয়ে যেতে যেতে ১৯৪৩ সালে তিনি ঢাকার বামপন্থী সংগঠন `প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ`-এ যোগ দেন মুনীর চৌধুরী। ১৯৪৬ ও ১৯৪৭ সালে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৪৮ সালে মুনীর চৌধুরী প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং এই বছরেই তিনি কলকাতায় অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনে যোগ দেন। ১৯৪৯ সালে মুনীর চৌধুরী খুলনার দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক হয়ে খুলনায় চলে যান। আধুনিক, শিক্ষিত ও শিল্পী লিলি চৌধুরীকে বিয়ে করে অধ্যাপনার পাশাপাশি সংসার জীবনও শুরু করেন এ বছরেই।
১৯৫০ সালে ঢাকা জগন্নাথ কলেজের ইংরেজীর শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। জুলাই পর্যন্ত তিনি এ কলেজে ছিলেন। এরপর মুনীর চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য বিভাগের ইংরেজী ও বাংলার খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত এই বিভাগেই ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী জননিরাপত্তা আইনে মুনীর চৌধুরীকে দ্বিতীয়বারের মতো গ্রেপ্তার করা হয়। কারাগারে থাকা অবস্থাতেই মুনীর চৌধুরী ১৯৫৩ এবং ১৯৫৪ সালে বাংলায় এম.এ. প্রথম পর্ব ও দ্বিতীয় পর্ব পরীক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করেন।
সবচেয়ে আশ্চর্য করার বিষয়টি হলো- তিনি কারাগারের যে কক্ষে বন্দি ছিলেন সেখানে অন্য রাজবন্দিদের মধ্যে ছিলেন মোজাফ্ফর আহমদ, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অজিত গুহ, মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান। আর অন্য কক্ষে ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত সহ ষাট-সত্তর জন কমিউনিস্ট নেতা আর তাদের মাঝে বসেই তিনি নিজেকে করে তোলেন আরো সাহসী, আরো সংগ্রামী।
কমিউনিস্ট নেতারা জেলে ২১শে ফেব্রুয়ারি পালন করতে চাইলেন। রণেশ দাশগুপ্ত তাঁর পূর্বপরিচিত এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের সহকর্মী ছিলেন। তাই সবাই রণেশ দাশগুপ্তকে ধরলেন তাঁকে অনুরোধ করতে, তিনি যেন ২১শে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে একটা নাটক লিখে দেন। রণেশ দাশগুপ্ত তাঁর কাছে গোপনে চিঠি পাঠালেন, জেলখানায় করার মতো একটি নাটক লিখে দেয়ার জন্য। নারী চরিত্র থাকলেও পুরুষ যেন তা করতে পারে সেভাবে। রণেশ দাশগুপ্ত তাঁকে জানালেন রাত ১০টার পর আলো নিভে গেলে নাটকটি মঞ্চস্থ হবে।
তিনি নারী চরিত্র ছাড়াই জেলখানার মধ্যে বসেই রচনা করলেন একটি নাটক। যেসব ছাত্রবন্দী রাতে হারিকেন জ্বালিয়ে লেখাপড়া করে তাদের ৮/১০টি হারিকেনের আলোয় মঞ্চ সাজিয়ে তাঁর লেখা নাটকটি সেদিন মঞ্চস্থ হয়েছিল। এই নাটকটিই হলো ২১-এর অমর নাটক `কবর`।
‘কবর’ নাটকটি-ই ভাষা আন্দোলনের একমাত্র নাট্য দলিল। নাটকটি মুনীর চৌধুরী লেখা শেষ করেছিলেন ১৯৫৩ সালের ১৭ জানুয়ারি আর জেলখানায় মঞ্চস্থ হয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। ফণী চক্রবর্তীর নির্দেশনায় নাটকটির অভিনয়ও হয়েছিলো নান্দনিক।
সাহস-সংগ্রাম-সাহিত্য আর শিক্ষার আলো জ্বালতে জ্বালতে মুনীর চৌধুরী নিজেকে করে তোলেন একজন নিবেদিত বাঙালি। আর তাই তিনি যখন একের পর এক বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করে চলেছেন, তখন পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান মুনীর চৌধুরীকে চিঠি পাঠিয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি যেন রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজে জড়িত না হোন। স্ত্রী লিলি চৌধুরী ও তিন ছেলে ভাষণ, মিশুক, তন্ময়কে নিয়ে তিনি তখন ফুলার রোডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ কোয়ার্টারে থাকেন। চিঠি পাওয়ার পর সবদিক বিবেচনা করে গিয়ে উঠলেন সেন্ট্রাল রোডের পৈত্রিক বাড়িতে।
অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। খেতে বসতে যাবেন মুনীর চৌধুরী। ঠিক এই সময় একটা জিপ বাসার গেটে এসে থামলো। জিপের আরোহীদের সবারই কালো কাপড় দিয়ে মাথা ও মুখ ঢাকা, চোখ দুটো কেবল দেখা যায়, চিনবার কোনো উপায় নেই। কয়েকজন জিপ থেকে নেমে অনুমতির অপেক্ষা ছাড়াই বাসায় ঢুকে সরাসরি তাঁর কাছে গিয়ে একজন বলল, `আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে, আমাদের কমান্ডার আপনাকে যেতে বলেছেন।` কথা শুনে মুহূর্তেই একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল পরিবারের সবার মাঝে। মুখঢাকা মানুষগুলোর কথা শুনে মা আগলে দাঁড়ালেন পথ। কিছুতেই যেতে দিবেন না ছেলেকে।
ওদের একজন তখন বলল, `আপনারা শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন, আমাদের কমান্ডারের সাথে দেখা করে এখুনি তিনি ফিরে আসবেন। আমরাই তো দিয়ে যাব।` লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরা ছিল তাঁর। পাজামা-পাঞ্জাবি পরতে ঘরের ভেতরে যেতে চাইলে সাথে সাথেই মুখঢাকা একজন বলে উঠল, `আর কিছুই গায়ে দিতে হবে না স্যার। আপনি কেবল যাবেন আর আসবেন।`
এক মুহূর্ত ভাবলেন তারপর বললেন, `ঠিক আছে চলুন।` বেরিয়ে গেলেন কালো কাপড় দিয়ে মুখঢাকা ওদের সাথে, যারা তাঁকে একেবারে নিয়ে যেতে এসেছিল। পেছনে রেখে গেলেন মায়ের আদর, ভাইবোন, বিশ্ববিদ্যালয়, সহকর্মী, ছাত্রছাত্রী, স্ত্রী আর প্রিয় উত্তরাধিকার।
সেই যাওয়াই শেষ যাওয়া। আর ফিরে আসেননি তিনি। স্বাধীনতার জন্য নিবেদিত অসংখ্য বুদ্ধিজীবিদের মত তাকেও রাজাকার-আলবদর পাক বাহিনী নিয়ে গেছে না ফেরার দেশে।
আজ যারা যুদ্ধাপরাধী-রাজাকার-শিবির মুনীর চৌধুরীর ঘাতক, তারা জাতীয় পতাকা লাগিয়ে গাড়ি চালাতে চায়; তারা আমাদের পতাকাকে, আমাদের স্বাধীনতাকে পদদলিত করতে তৈরি হয় প্রতিনিয়ত। এই দেশ বিরোধী-ঘাতকচক্রকে প্রতিহত করতে হবে বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের কথা ভেবে। কেননা, আমরা যদি না জাগি তাহলে সকাল হবে না, বন্ধ হবে না দেশ বিরোধীদের রাজনৈতিক সহিংসতা, বন্ধ হবে না ওদের আস্ফালন। আর তাই মুনীর চৌধুরীর দূরন্ত সাহসকে পূঁজি করে গড়ে উঠতে হবে আমাদেরকে-নতুন প্রজন্মকে। যাতে আমাদের দেশ থাকে দেশ বিরোধী চক্রের কালো থাবা থেকে সবসময়-ই অক্ষত।
মুনীর চৌধুরী যে ক’দিন বেঁচে ছিলেন, বীরের মত বেঁচে ছিলেন। আর সেই বীর তাঁর বীরত্বের স্বীকৃতি হিসেবে পুরস্কার- সম্মাননাও পেয়েছেন। তিনি ১৯৬২ সালে নাটকের জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কার ও গবেষণা সাহিত্যের জন্যে ১৯৬৫ সালে দাউদ পুরস্কার লাভ করেন।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ, নাটকের তালিকায় আছে, রক্তাক্ত প্রান্তর (১৯৬২), চিঠি (১৯৬৬), কবর (১৯৬৫), দন্ডকারণ্য (১৯৬৫), পলাশী ব্যারাক ও অন্যান্য (১৯৬৯); অনুবাদ নাটক-কেউ কিছু বলতে পারে না (১৯৬৭), রূপার কৌটা (১৯৬৯), মুখরা রমণী বশীকরণ (১৯৭০); প্রবন্ধগ্রন্থ- ডাইড্রেন ও ডি. এল. রায় (১৯৬৩), মীরমানস (১৯৬৫), তুলনামূলক সমালোচনা (১৯৬৯), বাংলা গদ্যরীতি (১৯৭০)।
তিনি চলে গেলেও বেঁচে থাকবেন নিজের কাজের মাঝে। যে কাজ যুগযুগ ধরে বয়ে বেড়াবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-স্বাধীকার আর অধিকারের কথা। এই কিংবদন্তীর ৮৮তম শুভ জন্মদিন ২৭ নভেম্বর, বুধবার। তার জন্মদিনে জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি...
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট
Email: [email protected]
রাইজিংবিডি/এলএ
রাইজিংবিডি.কম