ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ছোটগল্প || ভিন্নধর্মী প্রেমের গল্প

পলাশ মজুমদার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৪৬, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১  
ছোটগল্প || ভিন্নধর্মী প্রেমের গল্প

বছরখানেক আগের কথা। তখন করোনা মহামারির কারণে দেশজুড়ে চলছিল সাধারণ ছুটি। অন্য সবার মতো আমিও ঘরবন্দী। সারা দিন ঘরে কাটাই; শুয়ে-বসে আর লেখালেখি করে। ইচ্ছে করলে বই পড়তাম। কখনো সিনেমা দেখতাম। গান শুনতাম কখনো। কেবল একটু হাঁটতে বের হতাম বিকেলের দিকে। তা-ও প্রতিদিন নয়।
সেদিন হাঁটছিলাম মোহাম্মদপুর টাউন হল ক্যাম্পের সামনের রাস্তায়। তখন শেষ বিকেল। সন্ধ্যা নামছিল ধীরে ধীরে। রাস্তায় মানুষজন তেমন একটা নেই। হঠাৎ খেয়াল করলাম, একটি অল্পবয়সী সুদর্শন ছেলে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। ছেলেটির সিগারেট খাওয়ার ভঙ্গিটি অন্য রকম; সচরাচর এভাবে সিগারেট খেতে ছেলেদের দেখা যায় না।

এমন সময় পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক হিজড়া ছেলেটির গাল টিপে দিয়ে বলল— এই ছেলে, তোমার মোবাইল নম্বর দাও না। রাতে কল দিব। 

এ কথায় ছেলেটি খুব বিব্রত বোধ করে। মুহূর্তে কয়েক পা পেছনে সরে আসে। তবে ভয় পেয়েছে বলে মনে হলো না। হাসতে হাসতে লালমাটিয়ার দিকে ছেলেটি এগিয়ে যায়। হিজড়াটা পেছনের দিকে তাকায়; কয়েকবার জোরে হাততালি দেয়। তারপর বিড়বিড় করে কিছু বলতে বলতে রাস্তা পার হয়ে চলে যায় টাউন হলের দিকে।
ওই সময় পান দোকানের বাঁ পাশে মোড়ার ওপর বসে থাকা এক মধ্যবয়স্ক বিহারি ছেলেটিকে বলল— নম্বর দাওনি কেন? তোমাকে পছন্দ করেছে মনে হয়। অবশ্য তুমি পছন্দ করার মতো ছেলে। নায়কের মতো কী সুন্দর চেহারা তোমার! সেক্স করতে পারবা ওর সঙ্গে। 
প্রত্যুত্তরে ছেলেটি কোনো কিছু না বলে নিজের পথে হাঁটতে থাকে। 

লোকটির মুখে এমন সাবলীল উচ্চারণে ‘সেক্স’ শব্দটি শুনে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। অবশ্য তার কথা বলার স্টাইল ও বাচনভঙ্গি বলে দিচ্ছিল, সে দালাল টালাল হতে পারে। যাক্, সে অন্য প্রসঙ্গ।

আমি গল্প লিখি; সংগত কারণে মানুষ ও মানুষের বিচিত্র রকমের আচরণের ব্যাপারে কৌতূহলী, সে যে ধরনেরই হোক না কেন; সেখানে নৈতিকতার প্রশ্ন অবান্তর। নতুন কিছু চোখে পড়লে খুব উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে যাই। পুঙ্খানুপুঙ্খ পরখ করে দেখি। অভিজ্ঞতা অর্জনের আশায় ইচ্ছে করে ঘটনা ঘটাই; নেপথ্যের কাহিনি জানতে কখনো জড়িয়ে পড়ি ঘটনার সঙ্গে।

ছেলেটাকে আমি অনুসরণ করি। কিছুদূর যাওয়ার পর পেছন থেকে ডেকে বললাম— ভাই, কিছু মনে না করলে আপনার সঙ্গে কি একটু কথা বলতে পারি?
ছেলেটি উত্তর দেয়— শিউর, কেন নয়। বলুন কী বলতে চান।
কথায় ছেলেটাকে বেশ স্মার্ট মনে হলো। আমি বললাম— আপনার সঙ্গে ওই লোকটা এমন ভাষায় কথা বলল, অথচ আপনি তাকে কিছু বলেননি। বেশ অবাক হলাম। আমি হলে কী করতাম জানেন? গালে দুইটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতাম।
ছেলেটি থতমত খেয়ে বলল— বিহারিটার কথা আপনি শুনেছেন তাহলে। আর বলবেন না। আমি আছি ভীষণ রকমের যন্ত্রণায়।
কেন? একটু খুলে বলবেন, যদি আপনার আপত্তি না থাকে। আমি বললাম।

ছেলেটার মধ্যে কোনো জড়তা নেই। বেশ প্রাণবন্ত ও হাসিখুশি। জানতে পারলাম, ওর নাম সোহান। বাড়ি ফরিদপুরের মধুখালীতে। বিহারি ক্যাম্পের মধ্যে কয়েকজন মিলে মেস করে থাকে। পড়াশোনা বেশি করতে পারেনি। ছোটখাটো একটা চাকরি করত; লকডাউনের কারণে চলে গেছে সেটা। মতের দ্বন্দ্বের কারণে বাবা-মায়ের সঙ্গেও সম্পর্ক নেই। 

আমি ওকে চা অফার করলাম। দেখলাম, গল্প করতে ছেলেটির জুড়ি নেই। এ যুগের শহুরে ইঁচড়েপাকা ছেলেদের মতো একটু চাপাবাজও মনে হলো। তবে ওর কথা বলার ধরন ও কণ্ঠস্বর আকর্ষণীয়। কথা বলতে পারে বেশ গুছিয়ে; মানুষকে সহজে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতাও আমার নজর কাড়ে। কম টাকার চাকরি করে, গায়ে মলিন পোশাক বলে ছেলেটির মধ্যে কোনো ধরনের হীনম্মন্যতাবোধ নেই। বলা যায়, শত সমস্যার মধ্যেও বাঁচিয়ে রেখেছে প্রাণ।
কথোপকথন চলছিল একটি চা দোকানের বেঞ্চে বসে। 

আমার পরিচয় জানার পর ও প্রথমে একটু ইতস্তত বোধ করে। কী ভেবে পরক্ষণে আবার বলল, আপনি লেখক! খুশি হলাম আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে। জানি, লেখকরা মুক্তমনের মানুষ; তাদের কলমে কিছু আটকায় না। তবু ভয় লাগছে, সব শুনলে হয়তো আমাকে ধিক্কার দিবেন। ঘৃণায় ঠেলে দেবেন দূরে। আমি খুব খারাপ একটা ছেলে। সভ্য সমাজে মেশার অনুপযুক্ত।
অভয় দিয়ে ওকে বললাম, তোমার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমার কাছে সব স্বাভাবিক। সত্যি বলতে কী, মানুষের বিভিন্ন ধরনের মনস্তত্ত্ব ও কর্মকা- একজন লেখকের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে। তিনি অন্য দশজনের চোখে সমাজ ও মানুষকে পর্যবেক্ষণ করেন না; সবকিছুকে পরিস্থিতি বিবেচনায় বিচার বিশ্লেষণ করেন যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে। 
ওর বিশ্বাসের জন্য আমার দু-একটি কাজের উদাহরণ ওর সঙ্গে শেয়ার করলাম। এমনকি চলে আসে অনলাইন প্লাটফরম ব্যবহার করে অর্থোপার্জন ও যৌন চাহিদা মেটানোর বিভিন্ন প্রসঙ্গ।
আমার এসব কথায় সোহান বেশ স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। ঝেড়ে ফেলে অবশিষ্ট লজ্জা-সংকোচ। 

দুই

সোহানের বয়স বড়জোর বিশ হবে। ওর চেহারার মধ্যে এমন কিছু আছে, যা নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ছোটবেলা থেকে ওর প্রতি সকলের আলাদা নজর ছিল। প্রেমও এসেছিল বয়ঃসন্ধির আগে। শুধু মেয়েদের কাছ থেকেই নয়, ছেলেদের থেকেও। বাদ যায়নি পথেঘাটে ঘুরে বেড়ানো তৃতীয় লিঙ্গের বৃহন্নলারাও। সব মিলিয়ে ওর জীবন অজস্র ঘটনায় ভরপুর। ঘটনার জন্ম দিতে দিতেই ও এত দূর এসেছে! 
আজকের গল্পটি বৃহন্নলাদের নিয়ে।

সোহানের জীবনে প্রথম ঘটনাটি ঘটে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়। তখন হেমন্তকাল প্রায় শেষ। শীতের আভাস পাওয়া যাচ্ছে প্রকৃতিতে। কয়েকদিন পর শুরু হবে বার্ষিক পরীক্ষা। নাকের নিচে সদ্য দেখা দিয়েছে গোঁফের রেখা; হঠাৎ করে ও অন্যদের ছাড়িয়ে লম্বা হতে শুরু করেছিল। ওই সময়েরই কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে রেল স্টেশনের ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল ওরা দুই বন্ধু। একটু আগে একটা ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে গেছে। চারদিক প্রায় জনশূন্য। দুইজন হিজড়া ওদের বিপরীত পাশে বসে গল্প করছিল। হঠাৎ একজন ওভারব্রিজ পার হয়ে এসে কিছু বুঝে ওঠার আগে ওকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে দুগালে টকাস টকাস চুমু খায়। তারপর ওর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাতাতে থাকে। প্যান্টের ওপর চাপ দিয়ে বলল, লাগাবি। তাহলে চল আমার সঙ্গে। এই বলে ওর ডান হাত ধরে টানতে থাকে।

এমন আচরণে সোহান কিংকর্তব্যবিমূঢ়। রাগে জ্বলে ওঠে ব্রহ্মতালু। তৎক্ষণাৎ কষে এক থাপ্পড় মারে হিজড়াটির ডান গালে; তারপর দুই বন্ধু মিলে মাটিতে শুইয়ে পেটাতে থাকে এলোপাতাড়ি। এই দৃশ্য দেখে সঙ্গী হিজড়াটি দৌড়ে পালায়; কোত্থেকে ডেকে নিয়ে আসে একদল হিজড়াকে। দলটিকে দূর থেকে দেখে দুজন লেজ তুলে দৌড়ায়; স্টেশন থেকে বেরিয়ে লুকিয়ে পড়ে এক দোকানের ভেতর। তারা ওদের আর খুঁজে পায়নি। পেলে হয়তো বড় কোনো অঘটন ঘটে যেত। 
তখন থেকে হিজড়া দেখলে ওর মনে পড়ত সেদিনের বিভীষিকা। আর ও ভয়ে পালাত কিংবা লুকিয়ে পড়ত। তারপরও কিছু ঘটনা যে ঘটেনি তা নয়। ওইসব মুহূর্তে ও বেঁচে যেত কেবল সাবধানতার জন্য। এভাবে হিজড়া-আতঙ্ক অনেকদিন পর্যন্ত সোহানকে তাড়িয়ে বেড়ায়।

এসএসসি পরীক্ষার পর সোহান ঢাকায় আসে। ওর বাবার ইচ্ছে ছিল ও ঢাকায় থেকে কলেজে পড়বে। উঠে চাচার বাসায়। রায়েরবাজারে। একদিন বিকেলে লেকের পারে ঘোরার উদ্দেশ্যে রিকশায় চড়ে যাচ্ছিল চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে। জ্যামে আটকা পড়ে হঠাৎ। পাশের রিকশা থেকে কে যেন ওর গাল টিপে বলল, এই, নম্বর লাগবে। ০১৭৯৫...

চোখ ফিরিয়ে হাত তালি দেয়া অবস্থায় দুইটা হিজড়াকে দেখে সোহান ভয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে, যেন কেউ ওর মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করেছে। ও প্রায় পড়ে গিয়েছিল রিকশা থেকে। চাচাতো ভাইও ভয় পায়। ভাইটি দুই হাতে জোর দিয়ে ধরে না রাখলে সেদিনও বড় বিপদ হতে পারত।

তার কয়েক দিন পরে চাচার ইলেকট্রিক সামগ্রীর দোকানে সোহান একা বসেছিল। দোকানটি মুক্তি সিনেমার ঠিক উল্টো দিকে। চাচা বাসায় খেতে গেছে; ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফিরবে। তখন ঠিক দুপুর। বাইরে খা খা রোদ যেন রুটি সেঁকছে। রাস্তায় তেমন মানুষজন নেই। হঠাৎ এক হিজড়ার উদয়। মেয়েলি বেশে খুব সেজেগুজে এসেছিল। প্রথমে ও ভেবেছিল মেয়ে। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারে আসল ঘটনা। পাশে দাঁড়িয়ে ওর সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয় হিজড়াটি। কেন জানি গল্প করতে ওর কাছেও খারাপ লাগছিল না।

কথায় কথায় সোহান বুঝতে পারে, এই হিজড়াটি অন্যদের মতো ক্ষতিকারক নয়। কথাও বলে খুব সুন্দর করে গুছিয়ে। মেয়েলি ভাবও প্রবল। আচরণ একদম মেয়েদের মতো। ওই সময়ে মেয়েদের প্রতি ওর তীব্র আকর্ষণ ছিল। যৌনাভিজ্ঞতাও এর মধ্যে কয়েকবার হয়েছে। বেশি গ্যাপ পড়ে গেছে ঢাকায় আসার কারণে। গ্রামে থাকতে এসব নিয়ে ওকে কখনো ভাবতে হয়নি; অনায়াসে ওর হাতে ধরা দিত মেয়েরা। 

হিজড়াটি নরম সুরে যৌন উত্তেজনাপূর্ণ বিভিন্ন কথা বলায় ওর সুড়সুড়ি লাগে। গ্রামের সেসব রাতগুলো হঠাৎ উঁকি দেয় মনের কোণে; মনে পড়ে অভিসারের কথা। সিনেমা হলের দেয়ালে সাঁটানো পোস্টারের অর্ধনগ্ন নায়িকার দিকে ইঙ্গিত করে হিজড়াটি ওকে বলে, আর কত লুকিয়ে লুকিয়ে এসব দেখবা। এবার প্রাকটিক্যালি শুরু করো। একপর্যায়ে হিজড়াটি ওর ডানহাত টেনে নিয়ে বলল, আমার বুক ধরে দেখ। ভালো লাগবে। 

সোহান ভয়ে ভয়ে ধরল। মেয়েদের স্তনের মতো নরম নরম লাগে। অবিকল একই রকম। একদলা মাংসপিণ্ড। ও বেশ আরাম বোধ করে। উত্তেজিত হয়ে যায় মুহূর্তে। 
সঙ্গে সঙ্গে ওর শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। হারিয়ে ফেলে হিতাহিত জ্ঞান। সোহান নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। হিজড়াটাকে ভেতরে এক চিপায় আসতে বলল। পরক্ষণে ওর মনে পড়ে, এটা দোকান; যে কোনো সময় চাচা এসে পড়তে পারে। কিংবা অন্য কেউ। তখন তো কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। ও বের হয়ে বাইরে চলে এলো। বলল, এখনই আমার চাচা চলে আসবে। পরে কোনো এক সময় হবে। এখন চলে যান। 

হিজড়াটা কোনোভাবে যেতে চায় না। নাছোড়বান্দার মতো খুঁটি গেড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ও অনেক বুঝিয়ে দোকান থেকে বের করে আনে।
যাওয়ার সময় হিজড়াটা ওকে বলল, আমার নম্বর রেখে দাও। ঢোকাতে ইচ্ছে করলে কল দিও। আমি চলে আসব। 
সোহান ঠিক আছে বলে সেদিন বিদায় দেয়।

উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর চাচা-চাচির সঙ্গে মনোমালিন্য করে সোহান বাসা ছেড়ে চলে যায়। বন্ধুদের সঙ্গে মেসে ওঠে। নিজে টুকটাক কাজ করে। বাড়ি থেকে অল্পস্বল্প টাকা আনে। টিউশন করে। সব মিলিয়ে কোনোরকমে চলে যাচ্ছিল। তবু মাঝে মাঝে পকেট হয়ে পড়ত গড়ের মাঠ। তখন ভীষণ খারাপ লাগত। কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করত না। মন খারাপের সময় লালমাটিয়ার ভেতর দিয়ে ও সংসদ ভবন বা চন্দ্রিমা উদ্যানে চলে যেত। বসে থাকত একা একা। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে চোখে অন্ধকার দেখত। আর উল্টাপাল্টা ভেবে সময় পার করত।

এমন একদিনে সোহান বসেছিল চন্দ্রিমা উদ্যানের একটি কৃষ্ণচূড়াগাছের নিচে। হঠাৎ গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলে ওর মন আরও খারাপ হয়ে যায়। ক্রিসেন্ট লেকের ধারে কাছে মানুষজন তেমন একটা ছিল না। কী করা যায়, দৌড় দিয়ে এখান থেকে চলে যাবে কি না যখন ভাবছে, এমন সময় এক হিজড়া এসে ওর পাশে বসে। ওর থুতনি আলতো করে টিপে দিয়ে বলল, এই ছেলে, তোমার মন খারাপ কেন? কী হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে, না কি কেউ কিছু বলেনি?

এতদিনে বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনায় সোহানের হিজড়া-ভীতি কেটে গেছে। এখন আর হিজড়া দেখলে দৌড়ে পালায় না। হিজড়াদের প্রতি এক ধরনের সহানুভূতিশীল মনোভাব তৈরি হয়েছে। ভাবে, ওরাও তো মানুষ; মানুষের গর্ভেই তাদের জন্ম। অথচ ওরা সমাজের সব থেকে সুবিধাবঞ্চিত অংশ এবং ভদ্রসমাজে বরাবরই নিগৃহীত। 
 সোহান কিছু বলছে না দেখে হিজড়াটা আরও কাছ ঘেঁষে গায়ে গা লাগিয়ে বলল, বুঝেছি টাকা নেই বলে তোমার মন খারাপ। তাই না? টাকা লাগবে। আমার কাছে আছে। কত লাগবে বলো। এই বলে পাঁচশ টাকার কয়েকটা নতুন নোট বের করে ওর চোখের সামনে তুলে ধরে।
ও সংকোচ করে বলল, না লাগবে না। আমার অস্বস্তি হচ্ছে; আপনি একটু দূরে সরে বসুন।

তখন হিজড়াটি আদুরে ভঙ্গিতে অনেকটা প্রেমিকার মতো ওর নাক টিপে দিয়ে বলল, ছেলের দেখছি অনেক লজ্জা। বুঝতে পারছি তোমার কাছে কোনো টাকা নেই। আমার সঙ্গে চলো। একটা কাজ করলে আমি টাকা দেব।
হঠাৎ ওর মনে পড়ে তিন বছর আগের দুপুরের ঘটনাটি। মুহূর্তে শরীর জেগে ওঠে। মুখের দিকে তাকিয়ে ও চিনতে পারল; হিজড়াটিই সেদিন দোকানে এসেছিল। নম্বর দিয়েছিল ওকে। কিন্তু ও কল দেয়নি। সে কথা মনে করে সোহান বলল, চলেন তাহলে। কোথায় যেতে হবে?
বেশি দূরে নয়। লালমাটিয়ায়। 

যেতে যেতে রিকশায় অনেক কথা হয় ওদের। ও জানতে পারে, হিজড়াটির নাম সুমনা। হিজড়া হলেও সে মা-বাবার সঙ্গেই থাকে। সুমনা মা-বাবার একমাত্র সন্তান। আগে তার নাম ছিল সুমন। বারো বছর বয়সে শারীরিক পরিবর্তনের পর ‘সুমনা’ নাম নিয়েছে সে। হিজড়ারা অনেকবার ওকে নিয়ে যেতে এসেছিল; কিন্তু ওর মা-বাবা দেয়নি। 
সুমনার কথা বলার ঢং অবিকল মেয়েদের মতো। সাজপোশাকে মেয়ে বলেই মনে হয়। ওর প্রথম প্রেমিকার নাম ছিল সুমনা। দুই সুমনার চেহারায়ও মিল আছে কিছুটা। এমন সাদৃশ্য আবিষ্কার করে ওর মনটা অকস্মাৎ ভালো লাগায় ছেয়ে যায়, যেন ফিরে পেয়েছে হারানো প্রেমিকাকে।
সুমনার বাসায় সেদিন কেউ ছিল না। ওর মা-বাবা কোথায় যেন বেড়াতে গেছে; ফিরতে রাত হয়ে যাবে। সোহানকে আপ্যায়নে একেবারে মুগ্ধ করে ফেলে। ও খেতে না চাইলে জোর করে নিজের হাতে ওকে সুমনা খাওয়ায়। সুমনার প্রতিটি আচরণ ছিল পতিব্রতা স্ত্রীর মতো। 

তারপর কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে ওকে বিছানায় নিয়ে যায়। সুমনার প্রতিটি পদক্ষেপ ওকে কেবল আনন্দই দেয় না, প্রবলভাবে বিস্মিত করে। সোহান অবাক হয়ে ভাবে, একটি মেয়ের সঙ্গে একটি হিজড়ার আচরণগত ও মনোগত এত মিল থাকে কীভাবে! তার মানে সমাজ স্বীকৃতি দিলে ওরাও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে; কিন্তু এই সমাজ তো তা কখনো দিবে না।

প্রায় দুই ঘণ্টা পর সোহান ওই বাসা থেকে বের হয়ে এলো। বিদায়ের সময় পরিতৃপ্ত সুমনা ওর হাতে এক হাজার টাকার দুইটা নোট গুঁজে দিয়ে দুই গালে চুম্বন করে বলল, তোমার যখন খুশি চলে আসবে; আমার দরজা তোমার জন্য সবসময় খোলা। যেকোনো প্রয়োজনে তুমি আমাকে পাশে পাবে। আমি বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে তোমার পাশে থাকতে চাই।

সেদিন থেকে সোহান প্রায়ই কল দিয়ে সুমনার বাসায় চলে যায়। কখনো সুমনা ওকে ডাকে। একসঙ্গে সময় কাটায়। ঘোরাঘুরি করে। ফেসবুক মেসেঞ্জার হোয়াটসঅ্যাপে চ্যাট করে। এভাবে একটা সময় ওরা দুজন পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সুমনা ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। বিয়ে করতে চায়। কখনো বলে, সন্তান দত্তক নেব প্রয়োজনে। মনে মনে হাসলেও ও সুমনাকে আর অস্বীকার করতে পারে না; দিনে দিনে সুমনা হয়ে ওঠে ওর সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

একদিন ওদের সম্পর্কের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। ওর মা-বাবা ছুটে আসে ঢাকায়। সুমনাকে তীব্র অপমান করে বাড়ি নিয়ে যায় ওকে। সুমনার আত্মাভিমানে ঘা লাগে। তারপর থেকে ওকে সুমনা কল করে না। ও কল দিলে বন্ধ পায় সুমনার ফোন। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সব ধরনের যোগাযোগ। তার কয়েক দিন পর সুমনার এক সঙ্গী হিজড়া ওকে কল দিয়ে জানায় যে, সুমনা আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যার আগে তাকে না কি সুমনা জানিয়েছিল, সোহানকে ছাড়া সে তার জীবনটাকে অর্থহীন ভেবেছিল।

সোহান নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না; ভুগতে থাকে তীব্র অপরাধবোধে। আবার বিবাগী হয়ে ঘুরতে থাকে পথে পথে। নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথাও ও কয়েকবার ভেবেছিল তখন। এক বন্ধু ওকে সেই যাত্রায় রক্ষা করে; বোঝায়, জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। সুমনার মতো আবার কাউকে অচিরে পেয়ে যাবি। বন্ধুটির কথায় ও আশ্বস্ত হয়।

সোহান আবার ঢাকায় ফিরে আসে। অনেকটা মা-বাবার অবাধ্য হয়ে। ওর বাবা চেয়েছিল, ও আর কখনো ঢাকায় না যাক। যদি এমন কোনো ঘটনা ও আবার করে, তখন তো মুখ দেখানো যাবে না। রাগে অভিমানে আত্মীয়স্বজন, পুরোনো বন্ধু-বান্ধব কারও সঙ্গে আর যোগাযোগ করে না ও। আশ্রয় নেয় বিহারি ক্যাম্পে। একা একা ঘুরে বেড়ায়। ওর ধারণা, সুমনা কোথাও না কোথাও ওর জন্য অপেক্ষা করছে। কোনো হিজড়া দেখলে ও তাকিয়ে খুঁজে সুমনাকে; কিংবা সুমনার মতো কাউকে। পথেঘাটে এত হিজড়া দেখে; কিন্তু কেউ যেন সুমনার মতো নয়। 

দিন দিন সুমনার স্মৃতি ম্লান হয়ে আসে। মনের চেয়েও ও বেশি টের পেতে থাকে শরীরের ক্ষুধা। মেয়েদের প্রতি নয়, হিজড়াদের প্রতি ও তীব্র আকর্ষণ বোধ করতে থাকে। বিশেষত মেয়েলি ঢঙের হিজড়া ওকে চুম্বকের মতো টানে। ও নিজে থেকে ওদের সঙ্গে কথা বলে। ভাব জমানোর চেষ্টা করে। 
ওর আগ্রহ দেখে হিজড়ারা খুশি হয়। ওকে ডেরায় নিয়ে যায়। নিভৃতে সময় কাটায়। খুশি হয়ে টাকা-পয়সা দেয়। হিজড়াদের কাছে ওর চাহিদা ব্যাপক বেড়ে যায়।

গল্পটা এখানে শেষ করে দিতে পারতাম; কিন্তু শেষের পরও যে কিছু বাকি থাকে। তারপর পাঠকের মনে অতৃপ্তি ধরিয়ে আমরা গল্পের ইতি টানি। টানতে হয়। পাঠক চাইলে সেখান থেকে আবার শুরু করতে পারেন নতুন গল্প; উড়তে পারেন কল্পনার আকাশে।

তিন

সোহানের সব কথা শুনে আমি থ হয়ে গিয়েছিলাম। কোনো কথা আসছিল না আমার মুখে। এ কেমন জীবন? যে জীবনে স্বাভাবিক প্রেম-ভালোবাসা নেই, সুখ-দুঃখের জোয়ার ভাটা নেই, সাংসারিক জটিলতা নেই, দাম্পত্যের টানাপোড়েন নেই, সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নেই, নেই উত্তরাধিকারের সূত্র। 
আমার মনটা কেন যেন বিষাদে ছেয়ে যায়। কথা খুঁজে না পেয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণা করি। আমি সোহানকে বললাম, একবার টঙ দোকানের বেঞ্চে বসে চা খাওয়ার সময় এক হিজড়া আমার গায়ে বাড়ি দিয়ে বলেছিল, এ যে বেটাছেলে। সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীর কেঁপে ওঠে। চা ফেলে ভয়ে আমি দৌড়াতে থাকি; একবারের জন্যও পেছন ফিরে তাকাইনি।

এই কথা শুনে সোহান হো হো করে হেসে ওঠে। কিছুক্ষণ পর ও বলল, আপনি অনেক ভিতু।

আমি সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বললাম, কেবল হিজড়াদের বেলায়। আরো একবার বাসের মধ্যে হিজড়াদের পাল্লায় পড়েছিলাম। দ্রুত একশ টাকার নোট বের করে দিই যাতে অপমান না করে। কারণ আমার পাশের সিটের একটা ছেলে টাকা না দেওয়ায় সবার সামনে একরকম বেইজ্জত করে।
কী করেছিল?

গায়ে হাত বুলায়। কিস করে। ছেলেটি লজ্জায় লাল হয়ে দ্রুত টাকা বের করে দেয়। এসব দেখলে ভয় না পাওয়ার কী কারণ থাকতে পারে!
সেদিন সোহান আমাকে ওর মোবাইল নম্বর দেয়; কিংবা আমি নিজে থেকে চেয়ে নিই। বিদায় নেওয়ার সময় বলেছিলাম, আমি তোমাকে নিয়ে একটি প্রেমের গল্প লিখব। ভিন্নধর্মী প্রেমের গল্প। পাঠক বেশ মজা পাবে। লেখার পর গল্পটি তোমাকে দেখাব। 
এই কথা শুনে ও খুশি হয়ে বলে, সত্যি আপনি আমাকে নিয়ে গল্প লিখবেন।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, চেষ্টা করে দেখব।

চার

গল্পটা আর লেখা হয়ে ওঠে না। কারণ তখন আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি উপন্যাস নিয়ে। আত্মজৈবনিক উপন্যাস লেখায় ডুবে থাকার কারণে সোহানের কথাও ভুলে যাই। 
এই বছরের এপ্রিল মাসে আমি মোহাম্মদপুর নূরজাহান রোডে এসি কিনতে যাই; তীব্র গরমে অতিষ্ঠ হয়ে। দামের কারণে শেষ পর্যন্ত আর সাহস করিনি। মন খারাপ করে শোরুম থেকে বের হতে গিয়ে চমকে উঠি। দুজন হিজড়া ওখানে টাকা তুলতে এসেছে; তাদের মধ্যে এমন ভাব লক্ষ্য করলাম যেন ওরা প্রেমিক-প্রেমিকা।
একজনকে আমার খুব চেনা মনে হলো; বেশ পুরুষালি ভাব তার মধ্যে। কিন্তু কোথায় দেখেছি মনে পড়ে না। সে-ও আমার দিকে একবার তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ভাবে মনে হলো আমাকে সে চিনতে পেরেছে। 
স্মৃতি হাতড়ে আমি সোহানকে নিয়ে এলাম। একটু কাছে এসে ধীর স্বরে ওকে বললাম, তোমার নাম সোহান না?
মুখ কালো করে হিজড়াদের মতো বাজখাঁই গলায় ও বলল, আপনি ভুল করছেন। আমি সোহানা।

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়