ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

একটি বলদের অনুপ্রয়াণ

কবি স্বরলিপি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫৬, ১ অক্টোবর ২০২১  
একটি বলদের অনুপ্রয়াণ

এই ঝলমলে নীল আকাশ সাক্ষী— আমার পূর্বনারী এবং পুরুষ যুগে যুগে মাটি খুঁড়ে ফসল ফলানোর উপযোগী করে তুলেছে। যে সংসারে জন্ম নিয়েছি এবং বেড়ে উঠেছি আমার পিতামহ শুধু নয়, মাতামহীও এই সংসারে জমি চাষের কাজ করতো। আট সন্তান জন্ম দেওয়ার পর মাতামহীকে কুরবানী দেওয়া হয়েছিল। সেজন্য আমি সম্মানিত। কেননা, মাতামহীর মৃত্যুর দিন বাড়ির কর্তা-কর্তী আর ছেলে আর বিবাহীত মেয়েরাও নাকি তার স্মৃতিচারণ করেছিল। এই গল্প — আমার মা বলেছে।

মায়ের সারাদিন তেমন কোনো কাজ নেই। সে গোহাল ঘরের পাকা খাঁচায় তরতাজা কাঁচা ঘাস খায় অথবা খইল-পানিতে ভেজানো ধানের শুকনো খড় খায়। মায়ের এই আয়েশী জীবন পছন্দ নয়, মাঠে মাঠে চড়ে ঘাস খাওয়ার স্মৃতি সে আমাকে বলেছে। বিলের কাছাকাছি কিছু পতিত জমি পড়ে থাকতো, ধান পাকার আগ পর্যন্ত মুখে টোনা  লাগানো ছাড়াই তাকে এবং অন্যান্য গরুকেও নাকি দলবেঁধে মাঠে নেওয়া হতো। লেজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে মশা, মাছি তাড়াতো আর গোধূলীবেলায় বাড়ি ফেরার সময় ঢেঁকুর তুলতে তুলতে বাড়ি আসতো — এ সবই আমার কাছে গল্প।

মানুষের কাছাকাছি থেকে জেনেছি তাদের পরজন্ম আছে কিন্তু আমাদের নেই — থাকলে আমি সেরকম একটা মাঠে মায়ের সঙ্গে ভাই-বোনেদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ঘাস খেতাম, হয়তো একটি খয়েরি শালিক এসে আমার পিঠের ওপর বসতো। তখন আমি ওকে তাড়াতাম না, গল্প করতাম, জানতে চাইতাম ওর পাখা নাড়িয়ে নাড়িয়ে উড়ে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা। আমার জন্মের আগেই মা ঘরে ঢুকে গেছে। আমার পিতা কে, সে খবর মা জানে না কিন্তু আমার আগের দুই ভাইবোনের পিতাকে মা চেনে। ভাইবোনেরা এখন মায়ের সঙ্গে থাকে না। হাটের এক বেকুবমার্কা কসাই এসে ওদের দুজনকে একদিন নিয়ে গেছে।

এতক্ষণ যে পিতামহর গল্প বলেছি তার সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই, সে আমার ভাইবোনেদের পিতামহ। আমার জন্ম হয়েছে ইনজেকশনের মাধ্যমে। এজন্যই নাকি শরীরটা একটু নাদুস-নুদুস। মা বলে আমি রোদে গিয়ে দুই দিনও টিকবো না। আমার বড় হওয়া নিয়ে মায়ের চিন্তা, কয়েকদিন আগে ডাক্তার এসে মোটাতাজাকরণ ইনজেকশন দিয়ে গেছে, এখন তো শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। মা শুধু চোখের পানি ফেলে বলে, আর ক’টা দিন! ওরা তোকে বেচে দেবে। আমি বলি, বেচে দেবে না তো কী করবে, আমার কী কাজ? সংসারের কোনো কাজেই তো আসি না। সারাদিন খাওয়া আর ঘুমানো। দুপুরে সিদ্ধখুদ, ভাতের মার, কুড়ো — এসব শুধু আমি একা খাই, এই খাবার মাকে দেয় না ওরা। এদিকে মা আবারও মা হবে। বলি যে, কী বাছুর চাও তুমি? মা একটি মেয়ে বাছুর চায়। বলে মেয়েদের তবু আয়ু একটু বেশি। ছেলে বাছুর তো বছর গেলেই নাই।

সেদিক চিন্তা করলে আমার ভাগ্য একটু ভালো। বছর গেছে। বড় হয়েছি। শরীরের ভেতর কে যেন গান বাজায়। মা বলে, বাজান, গানে মনোযোগ দিও না। কেন মা? তুমি না ছেলে। তোমারে কেউ শরীরগত গান শোনার সুযোগ দেবে না বাজান। মাকে বলি, আমাকে বলো সেই গান কেমন? মা বলে না। সে বলে, এখন ভুলে যাবার সময় এসেছে সেই গান। সুতরাং কোনো প্রশ্ন করা চলবে না।

মা কি বোঝাতে চায় আমি হয়তো বুঝি! গোহালঘরের চালে লাউগাছ হয়, মিষ্টিকুমড়া গাছ হয়। ভোরে ভোরে এই বাড়ির কর্তা এসে নিজ হাতে গাছের ফুলে ফুল লাগিয়ে পরাগায়ন করে দেয়। 

মায়ের অভিশাপ মনে পড়ে আমার, মানুষ ভুলে গেছে তাদের জীবনের চিত্র কেমন হবে তা গাছেরা, পশুরা, পাখিরা আগে দেখিয়ে দেয়। এই পরিণতি মানুষেরও হবে। মানুষের মধ্যে যারা পুরুষ তারা প্রকৃতি থেকে সবার আগে ছিটকে যাবে। তারপর নারী। ছিটকে যাবেই, যেতে হবেই।

আমার সঙ্গে বেশি ভাব ছিল কর্তা-চাচার ছেলে হিজলের। ওর ছোট বোন অপরাজিতা আমাকে পছন্দ করে না। শুনেছি গরু নাকি ওর পছন্দ না। যাইহোক, হিজল ভাই মোটর সাইকেল অ্যাক্সিডেন্টে মরে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল সে, বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। এক রাতে বন্ধুদের সঙ্গে মোটর সাইকেলে ঘুরতে বের হয়ে লাশ হয়ে ফিরলো — এর বেশি জানা নাই। হিজলের মৃত্যুর পরেই আত্মীয় স্বজনেরা কর্তামায়ের শান্তির জন্য একটি পথ বলে দিল— মেয়ে বিয়ে দাও। জামাই ঘরে আনো। জামাইয়ের মুখ দেখলে পুত্রের শোক ভুলতে পারবা। অপরাজিতা বললো অন্য কথা — হিজল মরেছে, এই সম্পত্তির মালিক এখন আর আমি একা না। মালিকানা চলে গেছে চাচাতো-ভাইবোনদের হাতেও। তারা মূলত সম্পত্তি দখলে যেতে চাইছে।

সংসারে জায়গা-জমির অভাব নাই, মায়ের মুখে শুনেছি। সেসব জমিতে আউশ-আমন ধান হতো। তাও আবার একসাথে বোনা ধান, আউশ ধান আগে বাড়িতে আসতো। মোটা মোটা কাঁচা খড় হতো, রসে টইটুম্বুর থাকতো। এখন অবশ্য ইরি, বিরি, স্বর্ণা আরও কি কি ধান হয়। খড়ে আর আগের স্বাদ নাই। খাবারে শুধুই সারের গন্ধ।

সারা বাড়ি একদিন বিয়ের সরঞ্জামের শব্দে ঝমঝম করতে লাগলো। মসলার ঘ্রাণে আমার মগজে ঘোর লাগলো — এই ঘোর ভয়ঙ্কর। মা বললো, মৃত্যুর জন্য শোক করো না। আমার তো মৃত্যুর জন্য শোক নেই, শোক হয় জীবনের জন্য। হায়! আমার অদেখা ঘাসের ক্ষেত, এক দুপুর বিকেল, অস্পৃশ্য পাখির পালক, বিলের হাওয়া তোমরা আমাকে কোনো দিন ডাকলে না। হায়! আমার অনভিজ্ঞ নদীর স্নান, ঝাপ। বটের শেকড় ছুঁয়ে একটি রৌদ্রদিন যাপন করতে না পারার দুঃখ, আমার সঙ্গে যেও না। এ জীবন উৎসর্গ হতে যাচ্ছে অপরাজিতার বিয়ের আপ্যায়নে।

অপরাজিতা আমার কাছে এসে বললো, ক্ষমা করিস। আমি ভাই হারানোর দুঃখ ভোলার আগেই তারা আমার হাত মেহেদিতে রাঙিয়ে দিয়েছে। আমার দুঃখ ফুরালো। বিশ্বাস  করলাম অপরাজিতা আমাকে স্নেহ করে। এবার নিজেকে উৎসর্গ করে দিতে সমস্ত প্রস্তুতি শেষ করেছি। মাকে খুব কাছ থেকে দেখি, তবে তাকে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ খুব একটা হয়নি। আমাদের মাঝে ছোট্ট দেয়াল, সারাজীবনে টপকাতে পারলাম না।

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ