ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘ধুঁকছে’ হাসপাতাল, বাড়ছে দুর্ভোগ

জাহিদুল হক চন্দন, মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ১৬ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১৩:১৬, ১৬ অক্টোবর ২০২০
‘ধুঁকছে’ হাসপাতাল, বাড়ছে দুর্ভোগ

মানিকগঞ্জের হাসপাতাল, ৬ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মধ‌্যে তিনটিই ‘ধুঁকছে’ বহুমুখী সংকটে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব হাসপাতালের কোথাও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব, কোথাও বা নেই প্রয়োজনীয় লোকবল। আবার কোথাও চিকিৎসা সরঞ্জাম ও লোকবল থাকলেও হাসপাতাল-কমপ্লেক্স ভবন হয়ে পড়েছে ঝরাজীর্ণ। খসে পড়তে দেয়ালে দেয়ালে পলেস্তারা।  এতে সাধারণ রোগীদের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে।  

সরেজমিনে দেখা গেছে, মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতাল, ঘিওর ও  দৌলতপুর উপজেলা স্বাস্থ‌্য কমপ্লেক্সের অবস্থা সবচেয়ে বেহাল।  হাসপাতালগুলোর বহির্বিভাগ-আন্তঃবিভাগে স্বাস্থ্যসেবা-প্রার্থীদের প্রায় হতাশ হতে হচ্ছে। চিকিৎসকের পরামর্শ পেতে সাধারণ রোগীদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।  

সদর হাসপাতাল: নামে ২৫০ শয্যার, জনবল নেই ১০০ শয্যারও

মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতাল কাগজে কলমে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হলেও ১০০ শয্যারও জনবল নেই।  রোগীদের সেবা দিতে আধুনিক মানসম্মত নতুন ৮তলা ভবন তৈরি হলেও জনবলের অভাবে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সদর হাসপাতালে গড় হিসেবে ভর্তি হওয়ার রোগীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার শ।  আর বহির্বিভাগের রোগীর সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। একদিকে জনবল সংকট, অন্যদিকে বাড়তি রোগীর চাপ। এর ফলে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে রোগীদের।

হাসপাতাল-সূত্র বলছে, চিকিৎসক প্রয়োজন ১৮৬ জন। রয়েছেন মাত্র ২৬ জন। একইভাবে ২৭৩ জন নার্সের পরিবর্তে রয়েছেন ১৯০ জন। আর তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী প্রয়োজন ১৩৫ জন।  আছেন আছেন ১৬ জন।  চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী প্রয়োজন ২৫১ জন।  রয়েছেন ১৬ জন।

চিকিৎসা নিতে এসেছেন আলাউদ্দিন ও  সাইদুর রহমান নামে দুজন। তারা বলেন, ‘সকাল ৯টা থেকে ডাক্তারের অপেক্ষায় আছি।  এখন বেলা সাড়ে ১০টা বাজলেও ডাক্তার দেখাতে পারিনি। ’ তাদের অভিযোগ—‘এই হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।  হাসপাতালই নানা সমস‌্যায় ধুঁকছে।  রোগীর চিকিৎসা দেবে কী করে?’
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আরশাদ উল্লাহ্  বলেন, ‘জনবল সংকটের কারণে চিকিৎসা-সেবা ব্যাহত হচ্ছে। তবে, উন্নত চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকদের চেষ্টার কোনো কমতি নেই। ’

দৌলতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স: ৪ বছরেও চালু হয়নি ‘ওটি’

দৌলতপুর উপজেলার চিকিৎসা সেবার একমাত্র ভরসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এখানে প্রতিদিন প্রায় ২০০ রোগী চিকিৎসা নিতে আসনে।  ৪ বছর আগে সিজার অপারেশন করার জন‌্য নতুন ভবন তৈরির পাশাপাশি যন্ত্রপাতিও কেনা হয়েছে। তবে, প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় এখনো সিজার অপারেশন শুরু করা সম্ভব হয়নি। রোগীদের বেসরকারি হাসপাতাল থেকে সিজার অপারেশন করাতে হচ্ছে।  

দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৮ সালের মে মাসে ৩১ শয্যা থেকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি  ৫০ শয্যায় রূপান্তির করা হয়। শয্যা বাড়লেও জুনিয়র কনসালটেন্ট গাইনি, জুনিয়র কনসালটেন্ট অ‌্যানেসথেসিয়া, জুনিয়র কনসালটেন্ট মেডিসিন, জুনিয়র কনসালটেন্ট পেডিয়াট্রিক্স, মেডিক‌্যাল অফিসার-১ এবং ডেন্টাল সার্জন ও বিভিন্ন বিভাগের ২৯ পদ শূন্য রয়েছে।  এসব কারণে এখানে সিজার অপারেশন চালু করা সম্ভব হয়নি।  

স্ত্রীকে এই স্বাস্থ‌্য কমপ্লেক্সে এসেছিলেন রুবেল হোসেন। তিনি বলেন, ‘প্রায় ২ মাস আগে হঠাৎ আমার স্ত্রীর প্রসববেদনা শুরু হয়। উপজেলা হাসপাতালে তাকে নিয়ে এলে চিকিৎসক সিজার করার পরামর্শ দেন। তবে, এখানে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি থাকলেও জনবলের অভাবে বেসরকারি হাসপাতালে যেতে হয়েছে।’

চিকিৎসা নিতে আসা আসিয়া বেগম ও লোকমানের অভিযোগ—‘এই হাসপাতালে চিকিৎসক নেই বললেই চলে।  কোনো রকম দুই-একজন চিকিৎসক দিয়েই পুরো হাসপাতাল চলছে। ’
এসব অভিযোগ স্বীকার করে নেন দৌলতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা নাসরিন আক্তার লিনা।  তিনি বলেন, ‘জনবল সংকটের কারণে সিজার অপারেশন শুরু করা সম্ভব হয় না।  জনবল সংকট থাকলেও রোগীদের সেবা দিতে সব সময় কাজ করছেন চিকিৎসক-নার্সরা।’

ঘিওর উপজেলা স্বাস্থ‌্য কমপ্লেক্স: ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই চলছে চিকিৎসা

ঘিওর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ২০১৮ সালে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় রূপান্তরিত করা হয়।  তবে, পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় পুরনো ভবনে এখনো চলছে চিকিৎসা কার্যক্রম। এই ভবনের বেশিরভাগ রুমের পলেস্তারা খসে পড়েছে। পুরনো ভবনের দ্বিতীয় তলায় ‘মা ও শিশু বিভাগ’ চালু রেখে এখনো রোগী ভর্তি করা হচ্ছে।  এছাড়া, নিচ তলায় ল্যাব ও অন্যান্য কার্যক্রম ঝুঁকি নিয়েই করছেন কর্তব্যরতরা। সাধারণ রোগীরাও ঝুঁকি নিয়েই নিচ্ছেন চিকিৎসা সেবা।

দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, পুরনো ভবনের দেয়াল স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে গেছে।  ল্যাবসহ বিভিন্ন রুমের পলেস্তারা খসে পড়েছে।  ২০১৮ সালে নতুন ভবন তৈরি হলেও পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় এই ভবন ব্যবহার করা হচ্ছে।  এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৩৩ পদের বিপরীতে রয়েছেন ১০১ জন।

মেডিক‌্যাল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) তাপস কুমার বসাক বলেন, ‘ল্যাবের রুম দেয়ালে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে শ্যাওলা জমে গেছে।  ভবনটি জরাজীর্ণ হওয়ায় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়।’
চর ঘিওর এলাকার রত্না আক্তার বলেন, ‘পেটের ব্যথার কারণে মাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছি৷ নারী ওয়ার্ডের শয্যা পুরনো  ভবনে হওয়ায় ঝুঁকিতে আছি। ’

ঘিওর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সৌমেন চৌধুরী বলেন, ‘পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় পুরনো ভবনে ঝুঁকি নিয়েই সেবা দিতে হচ্ছে।’ 

জেলার সার্বিক চিকিৎসা সেবা নিয়ে এসব অভিযোগ আংশিক স্বীকার করেন সিভিল সার্জন ডা. আনোয়ারুল আমিন আখন্দ। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘জনবল সংকট থাকলেও সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে সবাই কাজ করছেন।  প্রতি মাসেই যেসব পদে জনবল নেই, সেসব পদের বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে জানানো হচ্ছে।’ শূন্য পদে জনবল নিয়োগ হলে সবাইকেই চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব হবে বলেও মন্তব‌্য করেন সিভিল সার্জন।

/এনই/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ