ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

খুলনায় পায়ে পাড়িয়ে তৈরি হচ্ছে ‘নিউ তপন ও রতন’ চানাচুর

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫৫, ২৯ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১২:৫১, ২৯ অক্টোবর ২০২০
খুলনায় পায়ে পাড়িয়ে তৈরি হচ্ছে ‘নিউ তপন ও রতন’ চানাচুর

করোনা মহামারি পরিস্থিতির মধ্যেও শরীরে এ্যাপ্রোণ, হ্যান্ড-গ্লাভস, মাস্ক ও ক্যাপ ব্যবহার না করা, মেঝেতে ধুলা-ময়লার মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা, এমনকি মিকচার মেশিন ব্যবহার না করে পা দিয়ে পাড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে চানাচুরের খামি (কাঁচামাল)। ফলে পায়ের ময়লা ও শরীরের ঘাম খামির সঙ্গে মিশে দূষিত হচ্ছে খাবার।

এ চিত্র খুলনার কথিত বিখ্যাত ও মজাদার চানাচুর ‘নিউ তপন ও রতন’ চানাচুর ফ্যাক্টরির। এভাবেই তৈরি করা হচ্ছে মানুষের খাদ্যদ্রব্য চানাচুর। যা চকচকে এবং সু-সজ্জিত প্যাকেটে ভরে বাজারজাত করা হচ্ছে। খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমনকি ভারতে রপ্তানিও করা হচ্ছে কথিত মানসম্পন্ন এ চানাচুর।

সম্প্রতি অনুসন্ধান এবং খুলনা সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সরেজমিন পরিদর্শনে উঠে এসেছে এ ফ্যাক্টরির উল্লিখিত নোংরা এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চানাচুর তৈরির বাস্তব চিত্র।

আলোচিত ‘নিউ তপন ও রতন’ চানাচুর ফ্যাক্টরিটি খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গায় অবস্থিত মেট্রোপলিটন কলেজ রোডের সবুজবাগ এলাকায় অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানটির মালিক সিদ্ধেশ্বর রায়। তিনি মৃত হরিপদ রায়ের ছেলে। আর ‘তপন’ ও ‘রতন’ তার দু’ ভাই। মূলত: তিন ভাই-ই এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। দীর্ঘ ১৫-১৬ বছর ধরেই তারা চানাচুরের ব্যবসা করছেন। তবে, রহস্যজনক কারণে কারখানায় সাইনবোর্ড ব্যবহার করা হয় না।

এদিকে, ফ্যাক্টরি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সু-নির্দিষ্ট ৬টি অনিয়মের পয়েন্ট উল্লেখ করে নোটিশ দিয়েছে খুলনা সিটি করপোরেশনের ভেটেরিনারি বিভাগ। একই সঙ্গে তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে ইস্যু করা প্রিমিসেস লাইসেন্স কেন বাতিল করা হবে না- তা জানতে চেয়ে আগামী ২ নভেম্বরের মধ্যে ফ্যাক্টরি মালিককে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে লিখিত জবাব প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বিএসটিআইসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও অবহিত করা হয়েছে।

এদিকে, গত সোমবার সাংবাদিকরা ফ্যাক্টরিতে প্রবেশের চেষ্টা করলে মালিকপক্ষ বাধা দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি তারা সাংবাদিকদের ছবি তুলতেও বাঁধা দেয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দীর্ঘ কয়েক বছর ধরেই সিদ্ধেশ্বর রায় ‘নিউ তপন ও রতন’ চানাচুরের নামে অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে খাদ্যদ্রব্য তৈরি করে তা বাজারজাত করে আসছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাব ও অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজসে বহাল তবিয়তে তার ব্যবসা অব্যাহত রয়েছে। চানাচুরের প্যাকেটে বিএসটিআই নম্বর (বিডিএস-১৫৬৪) এবং রেজিস্ট্রেশন নং-৪০৯৭৭ উল্লেখ রয়েছে।

এদিকে, বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে ১৯ অক্টোবর খুলনা সিটি করপোরেশনের ভেটেরিনারি অফিসার ডা. মো. রেজাউল করিমের নেতৃত্বে একটি টিম সরেজমিনে ফ্যাক্টরিটি পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা নানা অনিয়ম দেখতে পান। যার প্রেক্ষিতে ২০ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী সিদ্ধেশ্বর রায়কে নোটিশ করা হয়।

নোটিশে উল্লেখ করা হয়, কারখানার কর্মচারীরা গায়ে এপ্রোন, হ্যান্ড-গ্লাভস. মাস্ক ও মাথায় ক্যাপ ব্যবহার করছে না। মাস্ক ব্যবহার না করাই খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মুখের ময়লা মিশে যাচ্ছে। এতে কর্মচারীদের মধ্যে করোনার ঝুঁকি বাড়ছে। এপ্রোন ব্যবহার না করাই গায়ের ঘাম খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। খাদ্যদ্রব্য ফ্লোরে ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় পড়ে আছে। ফলে ফ্লোরের ধুলা-বালি খাদ্য দ্রব্যে মিশে যাচ্ছে। কারখানার ভেতরের ড্রেনে দীর্ঘ দিনের ময়লা জমে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এতে মশা মাছির উপদ্রবও বেড়েছে। এমনকি চানাচুরের কাঁচামাল তৈরির জন্য মিকচার মেশিন ব্যবহার না করে কর্মচারীরা পা দিয়ে বাড়িয়ে খামি তৈরি করছে। ফলে পায়ের ময়লা এবং শরীরের ঘাম খামির সঙ্গে মিশে খাদ্যদ্রব্য দূষিত করছে। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এবং খুলনা সিটি করপোরেশন অধ্যাদেশ-২০০৯ এর তৃতীয় তফসিলের ৩৯ ও ৬২ ধারা এবং নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ এর ৩৩ নম্বর ধারা মোতাবেক জরিমানাসহ শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

নোটিশে আরও উল্লেখ করা হয়, শর্ত ভঙের কারণে ফ্যাক্টরিটির নামে ইস্যু করা প্রিমিসেস লাইসেন্স কেন বাতিল করা হবে না- তা আগামী ২ নভেম্বরের মধ্যে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে লিখিত জবাব প্রদানের জন্য বলা হলো। অন্যথায় ওই তারিখের পর ইস্যু করা প্রিমিসেস লাইসেন্স বাতিল বলে গণ্য হবে এবং সংশ্লিষ্ট ধারা মোতাবেক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এদিকে, বিষয়টি নিশ্চিত করে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের ভেটেরিনারি অফিসার (ফুড সেফটি) ডা. মো. রেজাউল করিম এ প্রতিবেদককে জানান, খাবার উৎপাদনের স্থান পরিষ্কার পরিচ্ছন্নসহ সার্বিক স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সিটি করপোরেশন প্রিমিসেস লাইসেন্স প্রদান করে থাকে। কিন্তু ‘নিউ তপন ও রতন’ চানাচুর ফ্যাক্টরিতে লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, তার নেতৃত্বে কেসিসি’র স্যানিটারি ইন্সপেক্টরসহ একটি টিম ১৯ অক্টোবর ফ্যাক্টরিটি পরিদর্শন করেন।

পরিদর্শনকালে দেখা যায়, মিকচার মেশিনের পরিবর্তে ফ্যাক্টরির মেঝেতে ফেলে চানাচুর তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়া কর্মচারীদের এ্যাপরোন পরা দেখা যায়নি। এমনকি মিকচার মেশিনের পরিবর্তে পা দিয়ে পাড়িয়ে খামির মেশানো অবস্থায় হাতে-নাতে ধরা হয়। যদিও তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা কাজ থেকে বিরত থাকে এবং মেঝেতে একটি পলিথিন দিয়ে খামি ঢেকে রাখে। 

এর আগেও এই ফ্যাক্টরিটি পরিবেশ স্বাস্থ্য সম্মত করতে এবং লাইসেন্সের নির্দেশনা মেনে চলতে একাধিকবার কর্তৃপক্ষকে মৌখিকভাবে বলা হয়- উল্লেখ করে তিনি জানান, বারবার নিষেধ করার পরও তারা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চানাচুর তৈরি অব্যাহত রাখে। ফলে এবার চূড়ান্ত পর্যায়ে তাদেরকে লিখিত নোটিশ করা হয়েছে। পরবর্তীতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের প্রোপেইটর সিদ্ধেশ্বর রায় জানান, তার কারখানায় সব নিয়ম মেনেই চানাচুর উৎপাদন করা হয়। এছাড়া খামি তৈরির জন্য ৪টি মিকচার মেশিন রয়েছে। সেখানে পা দিয়ে পাড়িয়ে খামি তৈরি হয় না। এগুলো ৮-১০ বছর আগে ছিল। এখন আর সেদিন নেই। তবে, কর্মচারিদের স্বাস্থ্যবিধি না মেনে খাদ্য পণ্য উৎপাদনের বিষয়টি স্বীকার করেন তিনি। 

খুলনা/নূরুজ্জামান/বুলাকী

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়