ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

৩০ বছর ধরে ঘানি টানছেন আজিজার দম্পতি 

ইয়াছিন মোহাম্মদ সিথুন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩২, ১ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১০:২৩, ১ নভেম্বর ২০২০

আজিজার রহমান (৭৫)। এই বয়সে আরাম-আয়াসে থাকার কথা। কিন্তু না। সংসার চালাতে স্ত্রীকে নিয়ে এখনও প্রতিদিন ৭ ঘণ্টা ঘানি টানেন তিনি।

আজিজারের বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকার উপজেলার গোলমুন্ডা ইউনিয়নে। লোকে তাকে আজিজার তেলী বলে ডাকেন। 
আজিজার রহমান প্রতিদিন ভোর ৫টার দিকে ঘুম থেকে ওঠেন। স্ত্রী রশীদা বেগমকে (৫২) নিয়ে গরুর পরিবর্তে নিজেরাই শুরু করেন ঘানি টানার কাজ।

আগে গরুর ঘানির সরিষার তেলের ওপর নির্ভারশীল ছিল সারা দেশের মানুষ। সরিষার দাম কম ছিলো। তেলও ভালো দামে বিক্রি হতো। গরু দিয়ে আজিজার রহমানের বাপ-দাদারা ঘানিতে তেল মাড়ানোর কাজ করতেন। লাভ ভালো হওয়ায় তাদের ছেলেরাও এটাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন।

আজিজারের বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের দায়িত্ব চলে আসে তার ওপর। ভালোভাবেই ঘানি সামলাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু সংসারের প্রয়োজনে ৩০ বছর আগে ঘানি টানা গরুটা বিক্রি করে দিতে হয়। এরপর আর তিনি গরু কিনতে পারেননি। টানা ৩০ বছরে ধরে স্ত্রীকে নিয়ে ঘানি টানছেন। প্রতিদিন ৭ ঘণ্টা ঘানি টেনে পাঁচ কেজি সরিষার তেল মাড়াই করান।

আজিজার দম্পতির চার মেয়ে। এরমধ‌্যে তিনজনের বিয়ে হয়েছে। বাকিজন প্রতিবন্ধী। তবে সে জলঢাকার একটি কলেজে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছেন। তাদের চিন্তা শুধু এই মেয়েটাকে নিয়ে।

রশীদা বেগম জানান, প্রতিদিন গরুর পরিবর্তে নিজেরাই ঘানি টেনে তেল মাড়াই করছেন। ফজরের নামাজ শেষে কাজ শুরু করেন। ঘানির সব জিনিস সেটিং করে দেওয়া হয় পাঁচ কেজি সরিষা। তারপর শুরু হয় ঘানি ঘোড়ানো। প্রথমে তার স্বামী পেটের সঙ্গে ঘানির কাঠটি নিয়ে আস্তে আস্তে ঘোড়াতে শুরু করে। বয়সের ভারে আর আগের মতো ঘানি টানতে পারেন না তিনি। কিছুক্ষণ টানার পর হাঁপিয়ে যান। তারপর শুরু করেন রশীদা বেগম। পাঁচ কেজি সরিষা তেলে পরিণত করতে সময় লাগে ৭ ঘণ্টা। যখন রাশিদা বেগম হাঁপিয়ে যান তখন আবার দুজন মিলে শুরু করেন।

আজিজার রহমান বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল ৮টার দিকে প্রতিবেশী মনছুরা বেগম (৪০)  আমাদের বাড়িতে আসেন ঘানি টানার কাজে সাহায‌্য করতে। এজন‌্য প্রতিদিন তাকে ১০০ টাকা পারিশ্রমিক দিতে হয়। পাঁচ কেজি সরিষা ৩০০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়। সেখান থেকে সোয়া লিটার তেল হয়। তা ৫০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। আর খৈল বিক্রি হয় কিছু টাকায়। ১০০ টাকা দিতে হয় মনছুরা বেগমকে। সব মিলে দিনে ২৫০ টাকা থাকে। এই দিয়ে সংসার চালাতে হয়। মেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছি। কেউ যদি একটা গরু দিতো তাহলে আমাদের আর এতো খাটতে হতো না।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে রশীদা বেগম বলেন, ‘বিয়ের পর থেকেই ঘানির জোঙাল ঘাড়ে নিয়েছি। ৩০ বছর ধরে স্বামীর সঙ্গে ঘানি টানছি। কোনো রকমে তিন মেয়ের বিয়ে দিতে পেরেছি। আর ছোট মেয়ে পড়াশোনা করছে। মরার আগে প্রতিবন্ধী মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পারলে জীবনে আর কোনো কিছু চাওয়ার নাই।’

ওই এলাকায় স্বেচ্ছাসেবী সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘জন্মের পর থেকে দেখছি এই দুজন মানুষ এভাবে খেটে যাচ্ছেন। তাদের কষ্ট দেখে চোখে পানি চলে আসে। যদি কেউ একটি গরু দিয়ে সহায়তা করতো তাহলে তাদের অনেক উপকার হতো।’

গোলমুন্ডা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে আজিজার রহমানকে বয়স্ক ভাতা’র কার্ড দেওয়া হয়েছে। আরও অন্যভাবে তাদের সহায়তা করার চেষ্টা করবো।’

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘বিষয়টি জেনেছি। সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে সহায়তা করার চেষ্টা করছি।’

নীলফামারী/ইভা 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়