ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

খুলনার কপিলমুনি মুক্ত দিবস আজ

নিজস্ব প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১০, ৯ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১১:১২, ৯ ডিসেম্বর ২০২০
খুলনার কপিলমুনি মুক্ত দিবস আজ

পাকিস্তানী দোসরদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত কপিলমুনির পরিত্যক্ত বিনোদ বিহারী সাধুর বাড়ি

আজ বুধবার ৯ ডিসেম্বর, খুলনার কপিলমুনি মুক্ত দিবস। টানা চারদিন মুখোমুখি যুদ্ধের পর এই দিন বেলা ১১টায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পন করে রাজাকার বাহিনী।

এদিকে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক আনুষ্ঠানিকভাবে কপিলমুনি যুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ কাজের উদ্বোধন করবেন।

মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর ৪৮ ঘণ্টা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৫৫ রাজাকারের আত্মসর্মপনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ খুলনার সর্ব বৃহৎ শত্রু ঘাঁটির পতন ঘটে। ঐ দিন উপস্থিত হাজার হাজার জনতার রায়ে আত্মসমর্পণকৃতদের মধ্যে ১৫১ জন রাজাকারকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে গুলি করে রায় কার্যকর করা হয়। তৎকালীন পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর দোসররা সারাদেশব্যাপী সাধারণ নিরীহ মানুষের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার ও নির্যাতন চালাতে থাকে। আর এ অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার মত জেলার পাইকগাছার সর্বত্র প্রতিরোধ দুর্গ গড়ে ওঠে। এ সময় পাক দোসররা বিশাল অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঘাঁটি করে ঐতিহ্যবাহী কপিলমুনিতে। অত্যাচারী বহু পরিবার সে সময় বিদেশে পাড়ি জমায়। কপিলমুনির পরিত্যক্ত বিনোদ বিহারী সাধুর সুরম্য বাড়িটি পাকিস্তানী দোসররা ঘাঁটি হিসেবে বেছে নেয় এবং এলাকায় নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। এ সময় তারা এলাকায় নিরীহ মানুষেদের ধরে ক্যাম্পে এনে শরীরের বিভিন্ন অংশে কেটে লবণ দিতো। এমনকি নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে লাশ নদীতে ফেলে দিতো। এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস বেশি থাকায় তাদের ওপর চলত অমানুষিক অত্যাচার ও নির্যাতন। এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে পাইকগাছার রাড়ুলি, বাঁকা, বোয়ালিয়া ও গড়ুইখালি মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প গড়ে তোলে।

খুলনা অঞ্চলের মধ্যে কপিলমুনির শত্রু ঘাঁটি ছিল সবচেয়ে বড় ঘাঁটি। সাড়ে ৩শ’র বেশি পাকসেনা ও তাদের দোসররা এখানে অবস্থান নেয়। ছাদের ওপরে সব সময় তাক করা থাকতো ভারী অস্ত্র, কামান ও মেশিনগান। ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর ক্যাপ্টেন আরেফিনের নেতৃত্বে একদল মুক্তি বাহিনী প্রথমে কপিলমুনি রাজাকারদের ঘাঁটিতে আঘাত করে। কিন্তু সুরক্ষিত দুর্গ আর রাজাকারদের শক্ত অবস্থানের কারণে সেই যুদ্ধে কোনো সফলতা পায়নি।

পরবর্তীতে পুনরায় পরিকল্পনা করে দক্ষিণ খুলনার বিভিন্ন এলাকার কমান্ডিং অফিসাররা উপজেলার রাড়ুলীর বাঁকা ক্যাম্পে এসে একত্রিত হন এবং কপিলমুনিকে রাজাকার মুক্ত করতে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ঐ সময় নৌ-কমান্ডার গাজী রহমত উল্লাহ দাদু, শেখ কামরুজ্জামান টুকু, স ম বাবর আলী, গাজী রফিক, ইউনুস আলী ইনু, শেখ শাহাদাত হোসেন বাচ্চু, মোড়ল আব্দুস সালাম, আবুল কালাম আজাদসহ অনেকে কপিলমুনি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন।

মুক্তিযোদ্ধারা ৫টি ভাগে বিভক্ত হয়ে অবশেষে ৭ ডিসেম্বর রাতে চারিদিক থেকে কপিলমুনি শত্রু ঘাঁটি আক্রমণ করে। দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে ৯ ডিসেম্বর বেলা ১১টার দিকে অস্ত্র ফেলে সাদা পতাকা উড়িয়ে ১৫৫ জন রাজাকার পাকিস্তানি দোসররা আত্মসমর্পণ করে। সঙ্গে সঙ্গে পতন ঘটে খুলনাঞ্চলের বৃহত্তর শত্রু ঘাঁটির। এই যুদ্ধে খুলনার আইচগাতির আনোয়ার ও সাতক্ষীরার আশাশুনির গলডাঙ্গা গ্রামের গাজী আনসার আলী নামে দুই মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। শত্রুদের বন্দি করে নিয়ে আসা হয় কপিলমুনি সহোচর বিদ্যামন্দির ঐতিহাসিক ময়দানে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে, এলাকার হাজার হাজার জনতার ঢল নামে ময়দানে। জনগনের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাৎক্ষণিক যুদ্ধকালীন কমান্ডাররা সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজাকারদের প্রকাশ্যে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে জনতার রায় কার্যকর করা হয়।

স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা আটক করেন ১৫৫ জন রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীকে। রাজাকার ঘাঁটি থেকে উদ্ধার হয় তাদের হাতে লেখা এক হাজার ৬০১ জন শহীদের তালিকা। সেখানে দেওয়ালে পেরেকবিদ্ধ সৈয়দ আলী গাজীর ঝুলন্ত মরদেহ পাওয়া যায়। এ খবরে ফুঁসে ওঠে এলাকার আমজনতা। পাশের কপিলমুনি হাই স্কুলে মাঠে জনতার আদালতে গুলি করে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় ১৫১ জন রাজাকারের। যুদ্ধকালীন জনতার আদালতে রায়ের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার ঘটনা খুলনার পাইকগাছা কপিলমুনি ঘটনাই একমাত্র উদাহরণ। তবে স্বাধীনতা যুদ্ধের এই ঐতিহাসিক ঘটনার যথাযথ স্বীকৃতি মেলেনি।

কপিলমুনি মুক্ত দিবস উপলক্ষে স্থানীয় (খুলনা-৬ আসন) সংসদ সদস্য মো. আক্তারুজ্জামান বাবু জানান, কপিলমুনি যুদ্ধক্ষেত্রের স্মৃতি সংরক্ষণে বিগত দিনেও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দেওয়ালে পেরেকবিদ্ধ সৈয়দ আলী গাজীর পরিবার এবং বীরঙ্গনা গুরুদাসি মণ্ডল অবহেলিত রয়েছেন। তবে আশার কথা-প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়ে মুক্তিযুদ্ধের এই স্মৃতি ও জনতার রায় কার্যকরের ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখানে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স ও জাদুঘর নির্মাণ করা হবে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক আনুষ্ঠানিকভাবে এই স্মৃতি সংরক্ষণ কাজের উদ্বোধন করবেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় এখানে দুই কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক মিলনায়তন, পাঠাগার ও পর্যটনের সুব্যবস্থার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বীরঙ্গনা গুরুদাসিকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এছাড়া কপিলমুনি হাসপাতালকে আধুনিকায়ন, কপিলমুনিকে পৌরসভায় উন্নতিকরণ, সড়ক সংস্কার ও বিনোদবিহারী সাধু প্রতিষ্ঠিত কপিলমুনির ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণে উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।

খুলনা/নূরুজ্জামান/বুলাকী

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়