ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

শেখ হাসিনা ও মোদি গোপালগঞ্জ আসছেন শনিবার

গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৩৩, ২৫ মার্চ ২০২১   আপডেট: ০৭:৪৭, ২৬ মার্চ ২০২১
শেখ হাসিনা ও মোদি গোপালগঞ্জ আসছেন শনিবার

আগামী শনিবার (২৭ মার্চ) গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি ও কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দি গ্রামের তীর্থস্থান ঠাকুরবাড়ি ভ্রমণে আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

ইতোমধ্যে তাদের আগমন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর সমাধি ও ঠাকুরবাড়িতে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। 

বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশে আসবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।  সফরকালে আগামী শনিবার (২৭ মার্চ) গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাবেন। সেসময় নরেন্দ্র মোদিকে স্বাগত জানাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও টুঙ্গিপাড়ায় আসবেন বলে জানা গেছে।

বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দির ঠাকুরবাড়ি পরিদর্শন করবেন। এসময় তিনি শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের মন্দিরে পূজা অর্চনা করে ঠাকুরবাড়ির সদস্য ও অন্য একটি মাঠে মঁতুয়া নেতাদের সঙ্গে মত বিনিময় করবেন।

তাদের আগমন উপলক্ষে ইতোমধ‌্যে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধ কমপ্লেক্স ও ঠাকুরবাড়ির বিভিন্ন মন্দিরে সংস্কার এবং সৌন্দর্যবর্ধনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধ কমপ্লেক্স চত্বরসহ পুরো এলাকা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে।

এদিকে, কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দির ঠাকুরবাড়ির আশপাশের পুরো এলাকা বাঁশ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। মোদিসহ অন‌্যান‌্য কর্মকর্তাদের বহন করা হেলিকাপ্টার নামতে ঠাকুরবাড়ির পাশে তৈরি করা হয়েছে চারটি হেলিপ্যাড। 

নবনির্মিত হেলিপ্যাড

হেলিপ্যাড থেকে ঠাকুরবাড়ি যাওয়ার সড়কসহ লিংক রোড ও ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক থেকে ঠাকুরবাড়ি যাওয়া আসার সড়ক সংস্কার করা হয়েছে। 

মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে পুরো ঠাকুরবাড়ি জুড়ে নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারির পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা লাগানো হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এ সফরে মতুয়া ভক্তসহ টুঙ্গিপাড়াবাসীর মধ্যে এক ধরনের চাঞ্চল‌্য দেখা দিয়েছে। ওড়াকান্দিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও উলু ও শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে মোদিকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত হয়ে আছেন। 

এলাকাবাসী গোবিন্দ কির্ত্তনিয়া ও ছবি রানী বিশ্বাস বলেন, ‘ঠাকুরবাড়ি বিশ্বের দলিত সম্প্রদায় মতুয়া ভক্তদের এক তীর্থভূমি। প্রতি বছর মতুয়া ভক্তরা পূর্ণলাভের আশায় এ তীর্থ ভূমিতে আসেন। এখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আসবেন- এতে আমরা আনন্দিত।’

ঠাকুরবাড়ির সদস্য অমিতাভ ঠাকুর বলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী আমাদের ঠাকুর বাড়িতে আসছেন, এটি আমাদের জন্য খুশির এবং গর্বের বিষয়। আমরা তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করেছি।’

বাংলাদেশ মতুঁয়া মহাসংঘের মহাসংঘাতিপতি (সভাপতি) সীমা দেবী ঠাকুর বলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী আমাদের ঠাকুরবাড়িতে আসছেন- এটা সব মতুয়া ভক্তদের কাছে গর্বের বিষয়। মোদিকে বরণ করে নিতে নানা প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে ঠাকুরবাড়িতে। সরকারের অনুমতি পেলে ধর্মীয় রীতিতে নরেন্দ্র মোদিকে বরণ করে নেওয়া হবে।’

ঠাকুরবাড়ি এলাকা পরিদর্শনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস‌্যরা

ঠাকুরবাড়ির অপর সদস্য পদ্মনাভ ঠাকুর বলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হেলিকাপ্টারে করে ওড়াকান্দির ঠাকুরবাড়িতে আসবেন। পরে তিনি ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলবেন। এরপর তিনি ঠাকুরবাড়ির পাশের একটি মাঠে তিন শতাধিক নির্ধারিত মঁতুয়া নেতাদের সঙ্গে মত বিনিময় করবেন। এর আগেও তিনি ওড়াকান্দি ঠাকুরবাড়িতে আসার ইচ্ছাপোষণ করেছিলেন কিন্তু আসতে পারেননি।’

কাশিয়ানী উপজেলা চেয়ারম্যান ও হরিচাঁদ ঠাকুরের ষষ্ঠ বংশধর সুব্রত ঠাকুর বলেন, ‘আগামী ২৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওড়াকান্দির ঠাকুরবাড়িতে আসছেন। দেশ-বিদেশে হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের লাখ লাখ ভক্ত ও অনুসারি রয়েছেন। পুরো ঠাকুরবাড়ি গোয়েন্দা নজরদারিতে নেওয়া হয়েছে।’

টুঙ্গিপাড়া পৌরসভার মেয়র শেখ তোজাম্মেল হক টুটুল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে ঘিরে টুঙ্গিপাড়ায় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। সমাধি সৌধ কমপ্লেক্সসহ পৌর এলাকা পরিস্কার পরিচ্ছন, শোভাবর্ধন করা হয়েছে।’

টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. বাবুল শেখ বলেন, ‘সরকারি কর্মসূচি পালনের জন্য টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা কাজ করছেন। নরেন্দ্র মোদিকে বরণ করে নিতে নেতাকর্মীরা অধির আগ্রহে রয়েছেন। আশাকরি সরকারি অনুষ্ঠান সফল্যের সঙ্গে শেষ হবে।’

গোপালগঞ্জের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. এহসানুল হক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির সফরকে ঘিরে হেলিপ্যাড তৈরি, সড়ক সংস্কারসহ উন্নয়নমূলক কাজ শেষ হয়েছে। মোদিসহ অন‌্যান‌্য কর্মকর্তাদের বহন করা হেলিকাপ্টার নামতে ঠাকুরবাড়ির পাশে তৈরি করা হয়েছে চারটি হেলিপ্যাড। হেলিপ্যাড থেকে ঠাকুরবাড়ি যাওয়ার সড়কসহ লিংক রোড ও ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক থেকে ঠাকুরবাড়ি যাওয়া আসার সড়ক সংস্কার করা হয়েছে।’

ওড়াকান্দি মন্দির

গোপালগঞ্জ পুলিশ সুপার আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, ‘সফরকে কেন্দ্র করে জেলাজুড়ে গোয়েন্দা নজরদারি চলছে। বিশেষ করে ঠাকুরবাড়ি এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব‌্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সবার সহযোগিতায় সুন্দর একটি অনুষ্ঠান উপহার দেওয়া সম্ভব হবে বলে আশা করছি।’

জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর নির্বিঘ্ন করেত প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।’

ওড়াকান্দি কেনো তীর্থ স্থান : ওড়াকান্দি ঠাকুরবাড়ি হিন্দু দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে তীর্থভূমি। ধর্মীয় অনুশাসন ও আধ্যাত্মিক চিন্তা-চেতনার দিক দিয়ে বিএশষ এ সম্প্রদায়ের কাছে তীর্থস্থানটি অন‌্যন‌্য। 

নিপীড়িত ও অবহেলিত নিম্ন বর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের মুক্তির দূত হিসেবে খ‌্যাত আধ্যাত্মিক পুরুষ পূর্ণব্রহ্ম শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের কারণেই ওড়াকান্দি লাখ লাখ মতুয়াভক্তের তীর্থভূমিতে পরিণত হয়েছে। 

কথিত আছে হরিচাঁদ ঠাকুর ও তার ছেলে গুরুচাঁদ ঠাকুর প্রবল আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী ছিলেন। হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের জীবদ্দশায় তাদের আধ্যাত্মিক শক্তির প্রভাবে মানুষ রোগমুক্তি লাভ করেছেন। অনেক বন্ধ্যা নারী মা হতে পেরেছেন। এছাড়া কুষ্ঠরোগ ও বিপদে পড়লে তাদের নাম স্মরণ করলে মুক্তি মেলে বলে প্রচারিত আছে। 

এভাবে হরিচাঁদ ঠাকুর ও তার ছেলে গুরুচাঁদ ঠাকুরের নামযশ দেশের সীমানা পেরিয়ে বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়ে। তৈরি হয় অগণিত অনুসারী। প্রতি বছর হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্ম তিথিতে লাখ লাখ মতুয়াভক্ত এখানে আসেন। রোগমুক্তির আশায় এবং বিভিন্ন মনোবাসনা পূরণের লক্ষ‌্যে স্নান করেন। এর মাধ্যমে ঠাকুরের সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করেন। এসময় যে যার সাধ্যমতো ঠাকুরের নামে দান করেন। এভাবেই ওড়াকান্দি তীর্থস্থান হিসেবে খ‌্যাতি লাভ করেছে।

কে এই হরিচাঁদ ঠাকুর : শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর ১২১৮ বঙ্গাব্দে ইংরেজী ১৮১১ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ কাশিয়ানী উপজেলা সাফলীডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। হরিচাঁদ ঠাকুরের বাল্য নাম ছিল হরি ঠাকুর। কিন্তু ভক্তরা তাকে হরিচাঁদ নামেই ডাকতেন। পিতা যশোবন্ত ঠাকুরের পাঁচ ছেলের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। পরে পার্শ্ববর্তী ওড়াকান্দি গ্রামে বসতি গড়েন হরিচাঁদ ঠাকুর। সেখানে হরিচাঁদ ঠাকুর অলৌকিকত্ব ও লীলার জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠেন।

হরিচাঁদ ঠাকুর

হরিচাঁদ ঠাকুর তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। পাঠশালা পেরিয়ে তিনি মাত্র কয়েক মাস স্কুলে গিয়েছিলেন। পরে স্কুলের গণ্ডিবদ্ধ জীবন ভালো না লাগায় স্কুল ছেড়ে তিনি মিশে যান সাধারণ মানুষের সঙ্গে। প্রকৃতির আকর্ষণে তিনি রাখাল বালকদের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান। তাঁর জীবদ্দশায় ওই এলাকার নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন। তখন নির্যাতিত হিন্দুদের পাশে দাঁড়ান এবং চৈতন্যদেবের প্রেম-ভক্তির কথা সহজ-সরলভাবে প্রচার শুরু করেন।

১৮৭২ সালের ব্রিটিশ আদম শুমারিতে ৩৬টি বর্ণের উদ্ভব দেখানো হয়েছিল। তার আগে থেকেই সমাজে বর্ণপ্রথা ও অস্পৃর্শতা প্রচলিত ছিল। তাই হরিচাঁদ ঠাকুর আদর্শ গার্হস্থ্য ধর্ম ও মতুয়াবাদ প্রচার করেছিলেন। এই মতুয়া মতবাদ প্রচার করতে গিয়ে তিনি নীল কুঠির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। সমাজে জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে লড়েছেন। 

জমিদারের লোকজন মতুয়া মতবাদ প্রচারে হরিচাঁদ ঠাকুরের অনুসারীদের বাধা দিয়ে বর্বর নির্যাতন করেছেন। তাদের বিপদ-আপদে সব সময় তিনি জাগ্রত থাকতেন। আর এভাবে হিন্দু নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের কাছে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন।

হরিচাঁদ ঠাকুরের মতুয়াবাদ ও মতুয়ার অর্থ কী : নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে এবং সাধনা করতে মতুয়াবাদ প্রচারের মাধ্যমে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের সংগঠিত করেন হরিচাঁদ ঠাকুর। তাঁর সাধন পদ্ধতিকে বলা হয় ‘মতুয়াবাদ’, আর এই আদর্শে যারা বিশ্বাসী, তাদের বলা হয় ‘মতুয়া’। মতুয়া শব্দের অর্থ মেতে থাকা বা মাতোয়ারা হওয়া। হরি নামে যিনি মেতে থাকেন বা মাতোয়ারা হন, তিনিই মতুয়া। মতান্তরে ধর্মে যার মত আছে, সেই মতুয়া।

বাদল সাহা/সনি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়