৮০’র দশকের ৩০০ টাকা বেতনের সেই শিক্ষক আজ অনাহারে
মোসলেম উদ্দিন, দিনাজপুর প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার ২নং মুকুন্দপুর ইউনিয়নের পটুয়াকোল গ্রামের ৮০ বছর বয়সী এক শিক্ষক মুজিবুর রহমান মন্ডল। ৩৪ বছর যাবৎ শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের মাঝে। জীবনের শেষ বেলায় আজ তিনি অসহায়। ক্ষুধার্ত পেট আর অসুস্থ শরীর নিয়ে ঘুরছেন মানুষের দ্বারে দ্বারে।
বুধবার (১৪ এপ্রিল) বিকেলে সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, এই প্রবীণ শিক্ষক ১৯৮০ সালে ফুলবাড়ী উপজেলার বলিভদ্রপুর দাখিল মাদ্রাসার প্রথম জীবনে মাত্র ৩০০ টাকা বেতনে শিক্ষকতা শুরু করেন। দীর্ঘ ৩৪ বছর শিক্ষাকতা শেষ করে ২০১৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন তিনি। চাকুরি শেষে সরকারিভাবে যে অর্থ পেয়েছিলেন, তা বিগত জীবনের করা ব্যাংক ঋণ কিছুটা পরিশোধ করেন। বাঁকি টাকা দিয়ে মেয়ের বিয়ে দেন তিনি।
সংসার জীবনে বাড়ি ভিটার ১২ শতক জায়গা ছাড়া কোন জমাজমি নেই তার। তাও আবার মোহরনা বাবদ ৬ শতক স্ত্রীকে দিয়েছেন, বাঁকি জায়গাটুকু একমাত্র ছেলেকে দিয়ে দিয়েছেন।
এখন তিনি একেবারে নিঃস্ব। টিনের বেড়া দিয়ে ছোট একটা খুপরি ঘর করে কোনরকমে স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করছেন তিনি।
বয়সের ভারে শরীর আজ অকেজো হয়ে গেছে এই শিক্ষকের। বিভিন্ন অসুখ তার দেহে বাসা বেঁধেছে। কোন কাজ করতে পারেন না। নিরুপায় হয়ে মানুষের কাছে একমুঠো চালের জন্য হাত বাড়ান তিনি। যে যখন যা দেয়, তা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে স্ত্রীকে নিয়ে চলেন তিনি। বিগত এক বছর ধরে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের কারণে বাহিরে কম বেড় হন তিনি। আবার নতুন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসার কারণে, সরকার ঘোষণা দিয়েছে সর্বাত্মক লকডাউন। এই লকডাউনে তিনি আরও বিপদে পড়েছেন।
ছেলে আবুল কালাম আজাদ একজন রাজমিস্ত্রি। বাবার দেওয়া সামান্য জায়গাতে বাড়ি করে স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কোনভাবে জীবিকা নির্বাহ করেন। তার স্বল্প আয় দিয়ে কোনরকমে সংসার চলে।
স্থানীয় তরিকুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘মুজিবুর চাচা একজন সৎ ও ভালো মানুষ। জীবন যুদ্ধে তিনি একজন পরাজিত সৈনিক। তার শিক্ষার আলো নিয়ে অনেক ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আজ তারা বড় বড় চাকরি করে এবং বিশাল বাড়িতে বসবাস করে। কিন্তু আজ তার বেহাল দশা। আমি আশাবাদী সরকার কিংবা দেশ এবং সমাজের বৃত্তবানরা যদি এই শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা অসহায় শিক্ষকে সাহায্য বা সহযোগিতা করেন, তাহলে বাঁকি জীবনটা সুখে থাকবে।
কথা হয় সেই শিক্ষাগুরু মুজিবুর রহমানের সাথে। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘জীবনে এক সময় শরীরে অনেক জোর-শক্তি ছিল। আজ বয়স আর শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যাথা বাসা বেঁধেছে। ঠিকমতো চলতে-ফিরতে পারি না। একসময় সাইকেলে চেপে প্রতিদিন ৭ কিলোমিটার রাস্তা পারি দিয়ে মাদ্রাসায় যাওয়া-আসা করতাম। চাকরি শেষ করে, সব সম্বল হারিয়ে, আজ আমি মানবেতর জীবনযাপন করছি। ব্যাংকের নিকট এখনও আমার লাখ খানেক টাকার ঋণ আছে। পেটে ভাত নেই, আবার ঋণের বোঝা। আজ বড় বিপাকে পড়ে গেছি। ভাঙাচোরা ঘর, ঝড় আর বৃষ্টি, কখন কি হয়? একটু বাতাসে ঘরটি কেঁপে উঠে। পাশাপাশি আমার বুকটাও থরথর করে নড়ে উঠে।’
এই মহান শিক্ষাগুরু মুজিবুর রহমানের বিষয়ে বিরামপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার পরিমল সরকারের নিকট জানতে চাইলে তিনি রাইজিংবিডিকে জানান, ‘ঐ প্রবীণ শিক্ষক মুজিবুর রহমানের বিষয় আমি জানতে পেরেছি। এটা একটা বড় নিদারুণ ও কষ্টদায়ক বিষয়। সমাজে এমনও ঘটনা আছে। তার একটা ঘরের বিশেষ প্রয়োজন, তবে বর্তমান সরকারি কোন বরাদ্দকৃত ঘর নেই। আগামীতে সরকারি বরাদ্দ আসলে তাকে একটা ঘর করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। এছাড়াও সরকারি যে কোন সুযোগ-সুবিধা তাকে দিবো।’
ঢাকা/আমিনুল
আরো পড়ুন