ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

‘হাসপাতালে প্যারাসিটামল ছাড়া কিছুই দেয় না’

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:১৯, ১৫ জুলাই ২০২১   আপডেট: ১৫:২৮, ১৫ জুলাই ২০২১
‘হাসপাতালে প্যারাসিটামল ছাড়া কিছুই দেয় না’

খুলনার ১৩০ শয্যা বিশিষ্ট ডেডিকেডেট করোনা হাসপাতালের চিত্র

‘হাসপাতালে প্যারাসিটামল ছাড়া কিছুই দেয় না, সরকারি ওষুধের আশায় বসে থাকলে তো আর রোগী বাঁচানো যাবে না, তাই ধার করে হলেও টাকা জোগাড় করে স্ত্রী’র জন্য ইনজেকশন ও ওষুধ কিনতে বাধ্য হয়েছি।’

বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই) দুপুরে এ প্রতিবেদককে কথাগুলো বলছিলেন খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শরাফপুর ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামের কৃষক মো. মফিজুর রহমান। তার স্ত্রী সালমা বেগম (৩৫) করোনা আক্রান্ত হয়ে গত এক সপ্তাহ ডুমুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি আছেন।

কৃষক মফিজুর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, তার স্ত্রীকে ৮ জুলাই ডুমুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। আর ১৪ জুলাই তাকে বাড়িতে নেন। এ ৭ দিনের মধ্যে একদিন মাত্র দুটি প্যারাসিটামল ওষুধ দেওয়া হয়। বাকি প্রতিদিন ৪১৫ টাকা প্রতি পিসের একটি করে ইনজেকশন এবং অন্যান্য খাবার ওষুধসহ তার প্রায় ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার মত ব্যয় হয়। যা তিনি ধার-দেনা করে জোগাড় করেন।

‘উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যে চিকিৎসা দিয়েছে- তার চেয়ে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করাই ভালো’ এ মন্তব্য করে মফিজুর বলেন, ‘শুধুমাত্র অক্সিজেনের জন্যই হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম স্ত্রীকে। না হলে ভর্তি করতাম না। তার প্রশ্ন- সব ওষুধপত্র যদি নিজেদের কিনতে হয়, তাহলে সরকারি বরাদ্দ যায় কোথায়?’

অপরদিকে, করোনার প্রথম ঢেউয়ে মাসহ খুলনার করোনা হাসপাতাল (তৎকালীন ডায়বেটিক হাসপাতাল) থেকে চিকিৎসা নেয়া নগরীর সিমেট্টি রোড এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ সাঈদ আলীর মেয়ে লুৎফুন্নাহার পলাশীর অভিযোগও একই। তিনি বলেন, ‘মেরোপেন, নিনাভীর-১০০ ও কার্ডিনেক্স-৪’ এই ওষুধগুলো আমাকে বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে। এক দিনের ওষুধ পড়েছে ১৩ হাজারের বেশি টাকা। আর সরকারিভাবে দেওয়া হচ্ছে প্যারাসিটামলসহ কয়েকটি ওষুধ। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘সাধারণ জনগণ কিভাবে এতো দামের ওষুধ কিনে করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করবে?’

লুৎফুন্নাহার পলাশী বলেন, ‘আমাদের সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে। সবমিলে মাসহ দু’জনের কয়েক লাখ টাকার ওষুধ কিনতে হয়েছে।’ এ বিষয়টি তিনি ওই সময় কেসিসি মেয়রকে জানালে তিনি ডাক্তারদের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। ডাক্তাররা বলেছিল— ওষুধ সাপ্লাই নেই। আর রোগীর চাপ থাকায় ওদের কপাল খারাপ। তাই ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে বলেও জানান পলাশী।

এদিকে, সাধারণ বেডের তুলনায় সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ ও এসডিইউ’র চিকিৎসা আরও ব্যয় বহুল। যদিও বেসরকারি হাসপাতালে সেটি আরও কয়েকগুণ বেশি বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

খুলনার ১৩০ শয্যা বিশিষ্ট ডেডিকেডেট করোনা হাসপাতালের এসডিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন নগরীর হাজীবাড়ি এলাকার বাসিন্দা মো. এবরান আলী স্বপন (৪৬)। গত ১৩ জুন থেকে ২৬ জুলাই পযন্ত সাধারণ বেড ও এসডিইউতে চিকিৎসা নেন তিনি। যদিও শেষ পর্যন্ত ২৬ জুলাই লাশ হয়েই বাড়ি ফিরতে হয় তাকে।

স্বপনের বড় বোন আইনজীবী আক্তার জাহান রুকু রাইজিংবিডিকে জানান, সরকারি হাসপাতাল হওয়ায় আইসিইউ বা এসডিইউ’র জন্য কোনো ভাড়া লাগেনি। কিন্তু যাবতীয় সকল ওষুধই নিজেদের কিনতে হয়েছে। বিশেষ করে শেষ মুহূর্তে এসে অক্সিজেনের সংকট দেখা দেয়। এছাড়া সেখানে কোনো এক্সেরে মেশিন তো নেয়ই, বরং এক্সেরে করার মতও কোনো ব্যবস্থা নেই। আর চিকিৎসক-নার্সরা শুধু ওষুধ লিখে দিয়ে দূর থেকে দেখে চলে যায়, যা সেবা করার সবই রোগীর স্বজনদের করতে হয়। এভাবে আনুমানিক প্রতিদিন কমপক্ষে ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা করে তাদের ব্যয় করতে হয়েছে। এ টাকা জোগাড় করতে তাদের বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে। তারপরও তার ভাইকে বাঁচাতে না পেরে চিকিৎসা ব্যবস্থার করুণ চিত্র নিয়ে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।

সম্প্রতি ওপেন হার্ট সার্জারি পরবর্তী করোনায় আক্রান্ত হয়ে খুলনার ১৩০ শয্যা বিশিষ্ট সরকারি ডেডিকেডেট করোনা হাসপাতালের আইসিইউ থেকে চিকিৎসা নেওয়া স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মী মো. জাকিরুল ইসলাম জানান, তার দেড় লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়েছে। যার মধ্যে শুধুমাত্র একটা ইনজেকশন কিনতেই লেগেছে ৬১ হাজার টাকা। এ ব্যয় মেটাতে তারমত মধ্যবিত্ত পরিবারকে চরম বেগ পেতে হয়েছে।

অপরদিকে, খুলনায় করোনা চিকিৎসায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গাজী মেডিক‌্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে মা জিনাত আরার চিকিৎসায় একদিনেই ৫১ হাজার টাকা বিল গুণতে হয়েছে বলে অভিযোগ করেন নাহিদ রেজভী নামের এক যুবক। এ অবস্থায় বিব্রত হয়ে একদিন বাদেই মাকে নিয়ে তিনি খুলনার ১৩০ শয্যা বিশিষ্ট ডেডিকেডেট করোনা হাসপাতালে চলে যান। একদিনে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিল করায় তিনি চরম ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, এ অবস্থা হলে সাধারণ মানুষের কি হবে?

যদিও চিকিৎসা ব্যয়ের বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেননি গাজী মেডিক‌্যাল কলেজ হাসপাতালের সত্ত্বাধিকারী ডা. গাজী মিজানুর রহমান। তিনি রাইজিংবিডিকে জানান, অক্সিজেন এবং করোনা পরীক্ষায় উচ্চ আদালত কর্তৃক নির্ধারিত ফি নেন তারা। কিন্তু করোনা আক্রান্ত রোগী আইসিইউতে থাকলে সাধারণত প্রতিদিনের বিল বাবদ ২৫ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা হয়। তবে, ওষুধ এ খরচের বাইরে। কারণ: অনেক রোগীর একটি ইনজেকশনের দামই ৫১ হাজার টাকা পড়ে যায়। সে ক্ষেত্রে ওষুধ প্রয়োজন অনুযায়ী কিনতে হয়।

এ ক্ষেত্রে রোগীদের ওপর ব্যয়ের চাপ পড়ার বিষয়টিও স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘বেসরকারিতে সব খরচতো নিজেদেরই করতে হয়। এখানে সরকারি কোনো সহায়তা নেই। যে কারণে অতিরিক্ত কোনো প্রোফিট ছাড়াই আমরা এ সেবা দিয়ে যাচ্ছি।’ তবে, রোগীর স্বজনরা যেন বিভ্রান্তি বা হয়রানিতে না পড়েন, সে জন্য ভর্তির আগেই তাদের চিকিৎসা ব্যয় সম্পর্কে পুরো ধারণা দেওয়া হয় বলেও উল্লেখ করেন ডা. গাজী মিজানুর রহমান।

অপরদিকে, সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয়ের বিষয়ে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. মুন্সি রেজা সেকেন্দার রাইজিংবিডিকে জানান, করোনা চিকিৎসার ওষুধের মূল্য অতিরিক্ত। সবার পক্ষে এসব ওষুধ কেনা সম্ভব নয়। আবার সরকারিভাবে সবসময় সরবরাহও থাকে না। ওয়েল ফেয়ার (দরিদ্র) ফান্ড থাকলে রোগীকে ওষুধ কিনে দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে খুলনার সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ রাইজিংবিডিকে জানান, সরকারি সরবরাহ সাপেক্ষে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনে মিলে গেলে অবশ্যই রোগীকে সেই ওষুধ ফ্রি দেওয়া হয়। কিন্তু সরবরাহ না থাকলে তো দেওয়া সম্ভব না। তবে, সরবরাহ থাকা সত্বেও হাসপাতালে প্যারাসিটামল ছাড়া রোগীকে অন্য কোন ওষুধ না দেওয়ার সু-নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

খুলনা/ নূরুজ্জামান/বুলাকী

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়