ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

অযত্নে মরলো বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে রোপণ করা হাজারো গাছ

মাহমুদুল হাসান মিলন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১৭, ২৯ জুলাই ২০২১  
অযত্নে মরলো বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে রোপণ করা হাজারো গাছ

অনেক জায়গায় গাছের চিহ্ন পর্যন্ত নেই

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গত বছর ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।

কর্মসূচির উদ্বোধন করেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার। এরপর রোপণকৃত বৃক্ষ রক্ষণাবেক্ষণে পানি উন্নয়ন বোর্ড ময়মনসিংহকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বছর পার না হতেই রোপণকৃত চারার প্রায় অর্ধেকেই মরে গেছে। অনেক জায়গায় গাছের চিহ্ন পর্যন্ত নেই।

পানি উন্নয়ন বোর্ড ময়মনসিংহের দেওয়া তথ্য মতে, খাল ও জলাশয় পুন:খনন প্রকল্পের ১ম পর্যায়ে ময়মনসিংহ জেলায় ১২টি খাল ও ৩টি নদী পুন:খনন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে এই প্রকল্পের মধ্যেই গাছ লাগানোর বিষয়টি উল্লেখ ছিল। মোট ১২১.৫৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের খননকৃত খাল ও নদীর দুই পাশে এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কলোনিতে ১২ হাজার ফলজ, বনজ ও ভেষজ গাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই অনুযায়ী প্রত্যেক প্রকল্পে বৃক্ষ রোপণের জন্য আলাদা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রতিটি গাছ রোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ধরা হয় ৩৩৮ টাকা ২০ পয়সা করে। এসকল গাছ রোপণে নিয়োগ করা হয় ঠিকাদার। কিন্তু ১২ হাজার গাছের চারা রোপণের নির্দেশনা থাকলেও রোপণ করা হয় মাত্র ৫ হাজার ২৬২টি গাছের চারা।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রোপণকৃত চারা রক্ষণাবেক্ষণ না করায় প্রায় অধিকাংশই মরে গেছে। জীবিত চারা গাছগুলোর মধ্যেও অনেক গাছ মরার মত অবস্থায় রয়েছে। এক্ষেত্রে দেখা যায়নি ঠিকাদার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন কার্যকরি পদক্ষেপ।

গৌরীপুর উপজেলার সূর্যডোবা খালের ৪ কিলোমিটার পূন:খননের মধ্যে সম্পূর্ণ হয় ৯০ শতাংশ কাজ। এই খালের পাড়ে রোপণকৃত ২০০টি চারা গাছের মধ্যে বেঁচে আছে মাত্র ১২টি গাছ।

স্থানীয় শামীম খান বলেন, চারা রোপণের আগে গর্তে কোন জৈব সার দেওয়া হয়নি। আমরা দেখেছি তড়িঘড়ি করে গাছগুলো লাগানো হয়েছিল। বেড়াও দেওয়া হয়নি। তাহলে গাছগুলো টিকবে না, এটাই স্বাভাবিক। শুধু শুধু সরকারের টাকা নষ্ট।

ভালুকা উপজেলার চান্দরাটি (কাস্তাইল ও বাঘাইল বিলের সংযোগকারী) খালের ১ কিলোমিটার পুন:খননের মধ্যে ৭০ শতাংশ কাজ সম্পূর্ণ হয়। এ খালের পাড়ে ৮০টি গাছ লাগানো হয়। এর মধ্যে বেঁচে আছে ১টি মাত্র গাছ।

সেখানকার বাসিন্দা শাহজাহান মিয়া বলেন, খালে গাছ লাগাতে তারা কাউকে দেখেনি। হয়তো কিছু গাছ লাগানো হয়ে থাকতে পারে। তবে ৮০টি গাছ কখনোই হবে না।

নান্দাইল উপজেলার বেকুয়া নদীর ৩ কিলোমিটার খননের মধ্যে ৯২ শতাংশ কাজ সম্পূর্ণ হয়। গত বছর নদীর দু’পাশে লাগানো হয় ২৪০টি ফলজ, বনজ ও ভেষজ গাছের চারা। এর মধ্যে বেঁচে আছে ১শটির মতো গাছের চারা। এর মধ্যেও অনেকগুলোরই মরার মত অবস্থা।

এই এলাকার বাসিন্দা লিটন মিয়া বলেন, প্রত্যাশা অনুযায়ী যেমন তাদের খাল খনন হয়নি, তেমনি গাছের চারা লাগানোর পর আর কেউ খোঁজ নেয়নি। তাই গরু ছাগলের অবাধ বিচরণ ও অযত্নে গাছের চারাগুলো নষ্ট হয়েছে।

ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বাকজুরী খাল খননের ঠিকাদার আতাউর রহমান বলেন, ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ৯ কিলোমিটার খাল খননের কাজ পাই। প্রকল্পে ৩ লাখ টাকা বৃক্ষ রোপণের জন্য বরাদ্দ ছিল। এর মধ্যে তিনি ৭শ চারা রোপণ করে স্থানীয় দু’জনকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন গাছ দেখার জন্য।

ঠিকাদার মির্জা মোস্তাফিজ বলেন, ইউনিক অ্যান্ড ব্রাদার্সের লাইন্সেসে ফুলপুর উপজেলার মুচারবাড়ি খাল, চড়ালডাংগা বিলের খাল এবং নান্দাইল উপজেলার বেকুয়া খালের পাড়ে প্রায় সাড়ে ৮শ বৃক্ষরোপণ করেছিলেন। লেবার খরচসহ প্রতিটি গাছ রোপণে খরচ হয়েছিল ২৫০ থেকে ৩০০ টাকার মতো।

তার ধারণা ৬০ শতাংশ গাছ বেঁচে আছে। তবে তদারকি করা গেলে আরো অনেক গাছ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ময়মনসিংহ গফরগাঁওয়ের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. ইউনুছ আলী বলেন, জেলায় বৃক্ষরোপণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১ হাজার ৮৭৬টি। ৫ হাজার ২৬২টি বৃক্ষরোপণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে কিছু বৃক্ষ মারা গেছে, মারা যাওয়া বৃক্ষসহ বাকি ৬ হাজার ৬১৪টি বৃক্ষ পর্যায়ক্রমে রোপণ করা হবে।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ময়মনসিংহের নির্বাহী প্রকৌশলী মো.মূসা বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে খাল এবং নদী পুন:খনন প্রজেক্টের মধ্যেই গাছ লাগানোর বিষয়টি উল্লেখ ছিল। গাছের চারা লাগানোর ৬ মাস পরে ঠিকাদাররা বিল পাবে। এ সময়ে গাছের চারা দেখাশোনার দায়িত্ব তাদের ছিল। বেশির ভাগ গাছের চারা মরে গেছে। এখন যার যে কয়টা গাছ বেঁচে আছে সে সেই পরিমাণ বিল পাবে।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে লাগানো গাছগুলোর তদারকি করা হয়নি বলে স্থানীয়দের অভিযোগের প্রেক্ষিতে মো. মূসা বলেন, ৫ জন অফিসার ও ১২জন ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট দিয়ে পুরো জেলা কভার করতে হচ্ছে। তাই লোকবলের অভাবে প্রজেক্টের তেমন খোঁজ খবর নেওয়া সম্ভব হয়নি।

ময়মনসিংহ পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়ন আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শিব্বির আহম্মেদ লিটন বলেন, বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে গাছ লাগিয়ে পরিবেশ রক্ষার নামে লুটপাট করা কোনভাবেই কাম্য নয়। সেখানে সরকারি কর্মকর্তাসহ ঠিকাদারের দায়বদ্ধতা রয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় কি পরিমাণ লুটপাট হয়েছে তা জাতির সামনে আনার দাবি জানাচ্ছি।

ময়মনসিংহ/টিপু

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়