ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

মেঘনা কেড়ে নিয়েছে বকুল-রহিমদের ভিটেমাটি

লক্ষ্মীপুর সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১০, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৩:১৬, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১
মেঘনা কেড়ে নিয়েছে বকুল-রহিমদের ভিটেমাটি

মেঘনা নদীতে ৪ বার ভাঙার পর পৌনে ২ লাখ টাকা দিয়ে সাড়ে ৪ গন্ডা জমি কিনে ঘর করেছি। কিন্তু ৬ মাসেই সেই ঘরটা ভেঙে গেছে। এখন কোথায় যাবো, কোথায় আশ্রয় নেব। কোনো কুল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছি না।

কান্না জড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন নদী ভাঙনের শিকার বকুল নেছা।

তিনি বলেন, আমার স্বামী নদীতে মাছ ধরেন। বহু কষ্ট করে ঘরটি করেছিলাম। কিন্তু শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে ফেলেছি। মেঘনা নদী সব কেড়ে নিছে, স্বামী সন্তানদের নিয়ে খোলা আকাশের নিচে রয়েছি।

তিন ভাঙার পর আড়াই গন্ডা জমিতে ঘর করেছিলেন আবদুর রহিম ও আবদুল করিম দুই ভাই। তাদের ঘরও নদীর ভাঙনের মুখে, তাই অন্যত্র ঘর সরিয়ে নিচ্ছেন।

তারা বললেন, এখানে জমি কেনার পর সাত মাস বসবাস করেছি, এখন নদীতে সব কেড়ে নিয়েছে। আমাদের আশ্রয়ের কোনো ঠিকানা নেই।

শুধু বকুল নেছা বা আবদুর রহিম কিংবা আবদুল করিম নয়, তাদের মতো একই অবস্থা ভাঙনকবলিত হাজারো মানুষের। মেঘনার ভাঙনে দিশেহারা নদীর তীরবর্তী মানুষ।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত তিনযুগ ধরে রামগতি ও কমলনগর উপজেলার ৩৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ২৬টি বাজারসহ বিস্তীর্ণ জনপদ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

এর মধ্যে গত ১ বছরে মেঘনা নদীর ভাঙনে কমলনগর উপজেলার নাছিরগঞ্জ ও লুধুয়া বাঘারহাট এবং রামগতি উপজেলার গোয়েন্দাপাড়া মাছঘাট বাজার ও উচখালী বাজার নদীতে বিলীন হয়েছে।

নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে- কমলনগর উপজেলার নাছিরগঞ্জ দারুল আমান কাওমি মাদরাসা, চরফলকন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লুধুয়া ফলকন ফয়জুন্নাহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও চরজগবন্ধুর মুন্সীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং রামগতি উপজেলার চরবালুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

বর্তমানে হুমকিতে রয়েছে চারটি বাজারসহ আরও ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গেল এক বছরের ভাঙনে দুই উপজেলার প্রায় এক হাজার পরিবার বসতবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। এই সময়ে বিলীন হয়েছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনাসহ কয়েকশ’ একর ফসলি জমি।

এ অবস্থায় ভাঙনরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নেওয়া প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

জানা যায়, চলতি বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকেই মেঘনা তীরবর্তী কমলনগর উপজেলার নাছিরগঞ্জ, কাদির পন্ডিতেরহাট, লুধুয়া ফলকন ও পাটারীরহাট এবং রামগতি উপজেলার পশ্চিম বালুরচর, জনতা বাজার, আসলপাড়া, চরআলগী, বিবিরহাট ও বড়খেরী গ্রামে নদী ভাঙনের ভয়াবহতা চলছে। ভাঙনে ওইসব এলাকার প্রতিদিন গড়ে অন্তত ১০-১২টি পরিবার বসতভিটা হারাচ্ছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ অন্য এলাকায় গিয়ে এক টুকরো জমি নিয়ে কোনো রকম মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গিয়ে থাকছেন। অন্যদের ঠিকানা হচ্ছে সরকারি বেড়িবাঁধের উপর।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান কমলনগর উপজেলার চর ফলকন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাজী হারুনুর রশিদ জানান, মেঘনার ভাঙনে প্রতিনিয়ত তার ইউনিয়নটি ছোট হয়ে যাচ্ছে।

রামগতি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ জানান, মেঘনার ভাঙন থেকে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন এলাকাবাসী। সম্প্রতি একনেকে ভাঙনরোধে প্রায় ৩১শ কোটি টাকার প্রকল্প পাশ হওয়ায় তারা আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু প্রকল্পটির কাজ এখনও শুরু না হওয়ায় তারা এখন চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।

একই উপজেলার চরআলগী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন লিটন চৌধুরী বলেন, ভাঙনের মুখে পড়ে তার ইউনিয়নের গোয়েন্দা বাজার মাছঘাটটি সম্প্রতি নদীগর্ভে চলে যায়। এতে ব্যবসায়ীরা চরম ক্ষতির শিকার হন। এছাড়া ইউনিয়নের মধ্য চরআলগী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির খুব কাছাকাছি ভাঙন চলে আসায় স্কুলটি এখন স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলছে।

কমলনগর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. মফিজুর রহমান জানান, গেল এক বছরে মেঘনার ভাঙনে তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীগর্ভে চলে গেছে। ভাঙন কবলিত বিদ্যালয়গুলো ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তর করা হয়েছে। এ কারণে বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীর সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক কমেছে।

লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক আহমেদ জানান, মেঘনার ভাঙনরোধে তিন হাজার ৮৯ কোটি ৯৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকার একটি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পেয়েছে। ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ইতোমধ্যে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়া শেষ করে আগামী নভেম্বর মাসে ভাঙনরোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে।

জাহাঙ্গীর লিটন/টিপু

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়