ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

কয়লা সংকটে ফরিদপুরে ইট উৎপাদন বন্ধ

ফরিদপুর সংবাদদাতা  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:০৭, ২ নভেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৫:০৮, ২ নভেম্বর ২০২১
কয়লা সংকটে ফরিদপুরে ইট উৎপাদন বন্ধ

কয়লার সংকট ও দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় চলতি মৌসুমে এখনো উৎপাদন শুরু করতে পারেনি ফরিদপুরে ইট ভাটার মালিকরা। আর এতে করে এ পেশার সঙ্গে জড়িত প্রায় বিশ হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।

গত মৌসুমে ভাটা মালিকরা ইট পুরানোর কাজে কয়লা টন প্রতি কিনেছিলেন সাড়ে ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকায়। কিন্তু চলতি মৌসুমে করোনার কারণে সেই কয়লা আমদানিতে সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়া কয়লার দাম বৃদ্ধি পেয়ে টন প্রতি হয়েছে ১৯ হাজার থেকে ২২ হাজার টাকা। 

জেলা ভাটা মালিক সমিতি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ফরিদপুর জেলায় ছোট বড় ১২৮টি ইটভাটা রয়েছে। তার মধ্যে ৮টি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। চালু রয়েছে ১২০টি। এর মধ্যে অটো ইটভাটা রয়েছে ৭টি। বাকি ১১৩টি ইটভাটা চলে কয়লা পুড়িয়ে। 

সরেজমিনে সদর উপজেলার ডিক্রিরচর, নর্থচ্যানেল ও চরমাধবদিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন ইট-ভাটায় গিয়ে দেখা যায়, গত বছরের উৎপাদিত ইটের বিক্রি প্রায় শেষ পর্যায়ে। কিন্তু নতুন করে উৎপাদনে না যাওয়ায় ফরিদপুরে ইট সংকট দেখা দিয়েছে। ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারি উন্নয়ন কাজে ঠিকাদাররা ইট কিনে কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। আর নতুন ইট উৎপাদনের পর যে দামে বিক্রি হবে তা বর্তমান বাজার দরের দ্বিগুন। তাই মাথায় হাত পড়েছে বাড়ি করতে চাওয়া সাধারন মানুষ ও নতুন করে কাজ পাওয়া ঠিকাদারদের। 

সাধারনত সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ইট উৎপাদনে যায় ভাটা মালিকেরা। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়েই মাটি কেনা, মাটি থেকে কাচা ইট তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়। কাচা ইট রোদে শুকিয়ে অক্টোবর মাসেই প্রথম কিস্তি ইট পোড়ানো শুরু করেন ভাটা মালিকরা। কিন্তু নভেম্বর মাস শুরু হয়ে গেলেও ইট উৎপাদন শুরু করতে পারেনি ভাটাগুলো। 

মালিকেরা বলছেন গত বছর একটন কয়লা কিনেছি সাড়ে ৮ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সাড়ে ৯ হাজার টাকা পর্যন্ত। অথচ সেই একই সময়ে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে এখন প্রকার ভেদে ১৯ হাজার থেকে ২২ হাজার টাকা দামে এক টন কয়লা বিক্রি হচ্ছে। তাও আবার পর্যাপ্ত না।

ডিক্রিরচর ইউনিয়নের ধলার মোড় এলাকার এম এ বি ব্রিকস-এর মালিক মো. আব্দুস সালাম জানান, একটি মৌসুমে ৮ রাউন্ডে ৭ থেকে ৮ লাখ করে মোট ৫০ থেকে ৬০ লাখ ইট তৈরী হয়। একেক রাউন্ডে ইট পোড়াতে ২০ থেকে ২৫ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। এ বছর কয়লার দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়ায় মৌসুমের প্রায় ৪৫ দিন পেরিয়ে গেলেও ইট উৎপাদন শুরু করেননি তিনি। 
শুধু তিনি নন কোন ইটভাটার চিমনিতে ধোয়া উড়ছে না। ইট প্রস্তুতকারী মাঠও ফাঁকা পড়ে রয়েছে।   

আব্দুস সালাম অপর এক ভাটার মালিক জানান, প্রতি রাউন্ডে ৭ থেকে ৮ লাখ ইট পোড়াতে প্রায় ১৩০ টন কয়লার প্রয়োজন হয়। এতে ৮ রাউন্ড পোড়ালে ১ হাজার টনের বেশি কয়লা প্রয়োজন হয় আমার ইট ভাটায়। আমি ১ হাজার টন কয়লা কিনেছি ৮০ থেকে ৯০ লাখ টাকার মধ্যে। সেই কয়লা এবার কিনতে হবে সোয়া ২ কোটি টাকায়। আবার শুধু যে টাকা হলেই কয়লা মিলছে তাও না। টাকা দিয়েও সময় মতো কয়লা সাপ্লাই পাওয়া যাচ্ছে না। 

একই কথা জানালেন আরেক ভাটা মালিক আব্দুর রাজ্জাক মোল্লা। তিনি বলেন, গত মৌসুমে একটি ইটের উৎপাদন খরচ ছিল সাড়ে ৫ থেকে সাড়ে ৬ টাকার মধ্যে। কিন্তু চলতি মৌসুমে একটি ইট উৎপাদনে ১০ থেকে ১১টাকা খরচ হবে। নতুন এক হাজার ইটের দাম হবে ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকা। এতো দামে মানুষ ইট কিনবে কি না সে নিয়েও চিন্তায় রয়েছি। 

শহরতলীর সিএন্ডবি ঘাট এলাকার রউফ ব্রিকসের সুপারভাইজার মিজানুর রহমান জানান, ইট উৎপাদন করতে হলে বিভিন্ন জেলার ইট প্রস্তুতকারী শ্রমিকদের মৌসুমের কমপক্ষে ছয়মাস আগে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা অগ্রিম দিতে হয়। অগ্রিম নেওয়া শ্রমিকেরা কাজ করতে আসতে পারছে না। ফলে প্রতিটি ভাটায় প্রায় ৭০ থেকে ১০০ জন শ্রমিক কাজে আসার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। এখন কাজের ধুমপড়ে যাওয়ার কথা অথচ মৌসুমের শুরুতেই কাজে ভাটা পড়েছে। স্থানীয় শ্রমিকরাও কোন রকমে আবার কেউ বেকার হয়ে দিনাতিপাত করছে। 

ফরিদপুর জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি খলিফা কামাল উদ্দিন বলেন, ৮ হাজার টাকার কয়লা ২২ হাজার টাকায় কিনে ভাটা চালু করা ব্যবসায়ীক ঝুঁকি মনে করছেন ইটভাটা মালিকেরা। ফলে বেশিরভাগ ইটভাটা এই মৌসুমে ইট উৎপাদনে যেতে পারেনি। বানিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এখন উদ্যোগ না নিলে ২০২২ সালে শুরুতে বাজারে যে নতুন ইট আসবে সেই ইটের উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় সাধারনের নাগালের বাইরে চলে যাবে। শুধু তা-ই নয় সরকারি কাজেও ধীরগতি চলে আসবে। 

ভাটা মালিকদের এই নেতা বলেন, লাভ লোকসান যাই হোক ইটের দাম বৃদ্ধির ফলে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। তাই যতো দ্রুত সম্ভব বানিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 

একাধিক ইট ভাটা মালিক জানান, ফরিদপুরে ৫ থেকে ৭জন ব্যবসায়ী ইটভাটা গুলোতে কয়লা সরবরাহ করে থাকেন। এই ব্যবসায়ীরা ভরা মৌসুমে মংলা বন্দর থেকে নৌপথে ফরিদপুর সিএন্ডবিঘাটে (নৌ বন্দরের) কয়লা নিয়ে আসে। নদীর পানি কমে গেলে যশোরের অভয়নগর উপজেলার শিল্প এলাকা নওয়াপাড়া থেকে সড়ক পথে কয়লা আনেন। সাধারনত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলাতে নওয়াপাড়া থেকে কয়লা সরবরাহ হয়ে থাকে। 

ফরিদপুরের কয়লা ব্যবসায়ী মুজিবর মাতুব্বর বলেন, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কয়লা আমদানি করা হয় দেশে। আর্ন্তজাতিক বাজারেও কয়লার দাম ও শিপমেন্ট খরচ বেড়ে যাওয়ায় কয়লা আমদানিতে খরচ বেড়েছে। এছাড়া মংলা ও নওয়াপাড়ার আমদানি কারকদের কাছে থেকে কয়লা এনে ফরিদপুরে বিক্রি করি। ২০০ থেকে ৫০০ টাকা টন লাভে ফরিদপুরে কয়লা বিক্রি করে থাকি। এ বছর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ফরিদপুরে এখন ইটভাটা মালিকরা কয়লা কিনতে চাইছেন না।

উজ্জল/ মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়