ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

একাধিক সশস্ত্র সম্মুখ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন কমান্ডার ফজলুল হক

হাসমত আলী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ৪ ডিসেম্বর ২০২১  
একাধিক সশস্ত্র সম্মুখ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন কমান্ডার ফজলুল হক

মো. ফজলুল হক (৭০), মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রুপ কমান্ডার। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন স্নাতক শ্রেণির ছাত্র। লেখাপড়া ঢাকায় করলেও থাকতেন গ্রামের বাড়ি গাজীপুর জেলা শহরের পূর্ব জয়দেবপুর (বরুদা) এলাকায়। ছাত্র জীবনই জড়িত হন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে। মার্চের প্রথম থেকেই সারাদেশে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ঢাকা ও গাজীপুরে প্রতিদিন চলতে থাকে মিছিল-মিটিং। যখন যেখানে থাকতেন, যোগ দিতেন কর্মসূচিতে। 

১৯ মার্চে দেশের ‘প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ’ হয় গাজীপুরে। ফজলুল হক প্রতিরোধ যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ২৫ মার্চ রাতে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সিদ্ধান্ত নেন মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে মুক্তিযুদ্ধে যাবেন। ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। দায়িত্ব পান গ্রুপ কামান্ডারের। দেশে ফিরে পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে একাধিক সশস্ত্র সম্মুখ যুদ্ধ করেন। তার অধীনে ছিলেন ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা। 

আলাপকালে বীরযোদ্ধা ফজলুল হক সেই দিন গুলোর স্মৃতিচারণ করেন রাইজিংবিডির সঙ্গে। 

মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ফজলুল হক বলেন- “জেলা শহরের ঐতিহ্যবাহী রানী বিলাসমনি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক ও ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করার পর স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন কায়দে আজম কলেজে। বাড়ি থেকে যাওয়া-আসা করে লেখাপড়া করতাম।

‘স্কুল জীবন থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতি জড়িত ছিলাম। এ কারণে ঢাকায়ও মিছিল মিটিংয়ে অংশ নিয়েছি। পাশাপাশি গাজীপুরেও তৎকালীন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা শহিদুল ইসলাম জিন্নাহ, শহীদুল্লাহ বাচ্চু, হারুন অর রশিদসহ অন‌্যান‌্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ ভাল ছিল। দলীয়সহ সব মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিতাম। ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলেও ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পশ্চিম পাকিস্তানীরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা করে। 

‘এসব বিষয় নিয়ে আন্দোলন প্রকট হতে থাকে। ৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম থেকেই সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দিলেন- এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

‘এদিকে বাঙালির আন্দোলন দমানোর লক্ষ্যে গাজীপুরের ভাওয়াল রাজবাড়িতে অবস্থিত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করার জন্য ১৯ মার্চ ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবার এক কোম্পানি পাকিস্থানী সৈন্য নিয়ে এ রেজিমেন্টে আসে। খবর পেয়ে হাজার হাজার মানুষ লাঠিসোটা, তীর-ধনুক, বল্লম, রড, শাবল ইত্যাদি নিয়ে হাজির হয়। 

‘নেতৃবৃন্দ ও লোকজনের সঙ্গে রাজবাড়ি সড়কের বাজার বটতলা রেলক্রসিং গেটে স্টেশন থেকে মালগাড়ীর বগি, রেল, আশপাশ থেকে ইট/পাথর এনে ব্যারিকেড তৈরি করি। এক পর্যায়ে ঢাকা থেকে আসা পাকিস্থানী সৈন্যরা অস্ত্রের আশা ছেড়ে দিয়ে ঢাকার পথে রওনা হয়। 

‘রাজবাড়ি থেকে বের হয়েই তারা প্রতিবোধের মুখে পড়ে। এক পর্যায়ে তারা গুলি শুরু করে। পাকবাহিনীর গুলিতে সেদিন শহীদ হন মনু খলিফা ও কিশোর নিয়ামত। আহত হন সন্তোষ মল্লিক, ডা. ইউসুফ, মো. শাহজাহানসহ আরও কয়েকজন। আমাদের পক্ষ থেকে পাল্টা গুলি ছোড়া হয়। কিন্তু টিকতে না পেরে আমাদের লোকজন ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।” 

স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলতে থাকেন, “এরপর বাড়িতেই অবস্থান করতে থাকলাম। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা ঢাকায় নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নেই দেশকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে যাব। পার্বশ্বর্তী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা রমিজ উদ্দিন মাস্টারের সঙ্গে ভারতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য এপ্রিলের শেষ দিকে বাড়ি থেকে রওনা দিয়েছিলাম। 

‘হেঁটে ঘোড়ারশাল পৌঁছে দেখি পাকিস্তানী সৈন্যরা বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়েছে। পরে আমরা দুজনেই বাড়িতে ফিরে আসি। খোঁজখবর নিয়ে জানলাম সদর উপজেলার খুদে বরমী এলাকায় ক্যাম্প করা হয়েছে। সেখান থেকে রিক্রুট করে ভারতে প্রশিক্ষণে লোক পাঠায়। রাতে সেখানে গেলাম। কথা বলার পর জানানো হলো ১০/১২ জনের একটি গ্রুপ সিটি করপোরেশনের পূবাইল পর্যন্ত গেছে। পরদিন সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারলে যাওয়া যাবে। 

‘ক্যাম্প থেকে ফিরে চাচা সিরাজ উদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কথা জানালাম। পরের দিন একটি পাঞ্জাবী, লুঙ্গি, শার্ট, একটা বিছানার চাদর, দেড়শ’র মতো টাকা নিয়ে রওনা দিলাম। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মাকে বললাম, আমি পূবাইল যাচ্ছি। যদি সুযোগ হয় তবে প্রশিক্ষণ নিতে ভারত যাব। তুমি বাবাকে কিছু বলো না। মা এক রকম স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। আর কিছু না বলে বেরিয়ে পড়লাম আমি। 

‘পূর্বাইলে পৌঁছে খোঁজাখুঁজি করে ওই গ্রুপের সদস্যদের পেলাম। পরে তাদের সঙ্গে কখনো হেঁটে, কখনো নৌকায় কালীগঞ্জের পুটিনা গিয়ে এক বাড়িতে রাত্রি যাপন করলাম। পরদিন সেখান থেকে নরসিংদীর গোপালদি হয়ে দাড়িয়ারচর এলাকায় আরেক বাড়িতে পরে রাতে থাকলাম।

‘পরদিন কুমিল্লার সিএমবি (কুমিল্লা-সিলেট সড়ক) রোডের পাশে কালিগঞ্জ গ্রামে অবস্থান নিলাম। ওই রোড পাকিস্থানি সৈন্য এবং রাজাকাররা পাহারা দিত। গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে দুজন করে ওই রোড পার হতে শুরু করল। আমার পার হওয়ার সময় রাজাকাররা আমাকে ধরে ফেলল। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ এবং মারধর করতে থাকল। আমার সঙ্গে থাকা অপরজন পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদী পার হয়ে গেল। 

‘এসময় তাদের সঙ্গে থাকা এক বৃদ্ধ আমাকে বললেন- তোমারতো বয়স কম, তোমার যাওয়ার দরকার নেই, বাড়ি ফিরে যাও। এরপর চড় মেরে আমাকে ছেড়ে দিল। ফিরে এসে সঙ্গীদের বললাম। ১০/১৫ মিনিট পর আমাদের আরও দুজন ওই রোড পার হয়ে গেল। পরের ব্যাচে আবার আমি রওনা হলাম। কাছাকাছি গিয়ে দৌড়ে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে নদী পার হয়ে যাই। পরে সন্ধ‌্যা ৭টার দিকে কসবা সীমান্ত দিয়ে ভারতের হাপানিয়া ক্যাম্পে পৌঁছি।

‘ওই ক্যাম্পে পরদিন দেখা হয় গাজীপুরের শহীদুল্লা বাচ্চুর সঙ্গে। তার সঙ্গে গেলাম আগরতলা শ্রীধর ভিলা ক্যাম্পে। সেখানে গিয়ে সাবেক সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা কাজী মোজ্জাম্মেল হকের দেখা পেলাম। সেখান থেকে আমাকে পাঠানো হলো গোকুলনগরে। পরদিন দুপুরে গিয়ে পৌঁছালাম সেখানে। সেখানকার মেঘনা ক্যাম্পে ডেপুটি ডাইরেক্টর ছিলেন বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক। ক্যাম্পে আমার নাম-ঠিকানা লেখা হলো। পরদিন সকালে আমাদের সবার পুরো নাম-ঠিকানা, শিক্ষাগত যোগ্যতা লেখা হলো। 

‘সকাল ১১টার দিকে আমাকে ডাকা হলো। যাওয়ার পর নাম-ঠিকানাসহ বিস্তারিত জিজ্ঞাসা করলেন। বললাম, এরপর আমাকে একটি প্লাটুনের (৫০ জনের) গ্রুপ কামান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হল। প্রতিদিন প্যারেড করাসহ আমার ওপর দেওয়া দায়িত্ব পালন করতে থাকলাম।
 
গোকুলনগর থেকে ১৮ দিন পর আমাকে নেওয়া হলো রামনগর পালাটানা ক্যাম্পে। সেখানে ২৮ দিন প্রশিক্ষণ নিলাম। এলএমজি, এসএমজি, লাইট মেশিনগান, থ্রি নট থ্রি, গ্রেনেড ইত্যাদি চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো। এরপর আমাকে রিলিজ দেওয়া হয়। অন্যদের সাথে ৩ নম্বর সেক্টর হেজামারা ক্যাম্পে গেলাম। ৩ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর সফি উল্যাহ এবং নূরুজ্জামান ছিলেন ক্যাপ্টেন। 

‘এখানেও আমাকে জয়দেবপুর-শ্রীপুর অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধাদের কামান্ডরের দায়িত্ব দেওয়া হলো। শুরুতে এ অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধা কম থাকলেও পরে ক্রমে ক্রমে বেড়ে যায়। শ্রীপুর অঞ্চল আদালা করে দেওয়া হলো। পরে ১০২ জন মুক্তিযোদ্ধা দিয়ে পাঠানো হলো বিজয়নগর বর্ডার এলাকায় যুদ্ধ করতে। মাস খানেক পাকিস্থানি সৈন্যদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ করে আবার হেজামারায় ফিরে যাই।”

তিনি বলতে থাকেন, ‘‘নভেম্বর মাসের শেষ দিকে আমার অধীনে পাঁচটি সেকশনে ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে দেশে প্রবেশ করি। নরসিংদীর শিবপুর, চরসিংন্দু এলাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ করে ডিসেম্বরে গাজীপুরে আসি। এখানে গাজীপুরের গাজীপুরা যুদ্ধে সিটি করপোরেশনের মেঘডুবি এলাকার আমাদের মুক্তিযোদ্ধা মাজেদ ও জসিম শহীদ হন। 

‘১৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানায় আমাদের সঙ্গে পাক সেনাদের হয় যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ভূরুলিয়া এলাকার নিজাম উদ্দিন শহীদ হন। এর তিন দিন পর ১৬ ডিসেম্বর মাতৃভূমি স্বাধীন হয়।”

ঘোর লাগা চোখে এতক্ষণ স্মৃতিচারণ করলেন কমান্ডার ফজলুল হক। তাঁর উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ যেনো চোখের সামনে বাস্তব হয়ে উঠেছিল। তিনি যেনো সেই দিনে ফিরে গিয়েছিলেন। মাতৃভূমির জন‌্য যেসব বীর সন্তান একদিন নিজের জীবন বাজি রেখে অস্ত্র ধরেছিল। তাদের ঋণ এ প্রজন্ম কী করে শোধ করবে?

গাজীপুর/সনি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়