ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

এক হাতেই চলছে আলমগীরের জীবন সংগ্রাম

বেলাল রিজভী, মাদারীপুর  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪৭, ২ আগস্ট ২০২২   আপডেট: ১১:৪৮, ২ আগস্ট ২০২২
এক হাতেই চলছে আলমগীরের জীবন সংগ্রাম

আলমগীর বেপারী

মাদারীপুর পৌরসভার কুলপদ্বি এলাকার আলমগীর বেপারী (৬৫)। প্রায় ৪০ বছর আগে দুর্ঘটনায় একটি হাত হারিয়ে পঙ্গু হন তিনি। এরপরও থেমে নেই তার জীবন সংগ্রাম। এক হাত দিয়ে টেনে চলছেন সংসারের ঘানি। বেঁচে থাকার তাগিদে সব বাধা বিপত্তিকে পেছনে ফেলে ইজিবাইক চালিয়ে রুজি রিজিক নির্বাহ করে চলেছেন তিনি। 

নিজের প্রচেষ্টা থাকলে শত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে সব কিছু করা সম্ভব, এমনটাই প্রমাণ করেছেন আলমগীর বেপারী। 

জীবনের দুঃখ-কষ্ট পেছনে ফেলে আলমগীর বেপারী কাজের মধ্যে আনন্দ খুঁজে নিয়েছেন। কারো কাছে হাত না পেতে দীর্ঘদিন ধরে ইজিবাইক চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন তিনি।

বয়সের ভারে এবং শারীরিক প্রকিবন্ধকতায় চলতে ফিরতে কষ্ট হয় আলমগীর বেপারীর। এরপরও পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে ৬৫ বছর বয়সে এসেও জীবিকা নির্বাহ করে চলেছেন তিনি।

আলমগীর বেপারীর দুই ছেলে তিন মেয়ে। মেয়ে তিনটির অনেক আগেই বিয়ে হয়েছে। এরমধ্যে ছেলেরা বিয়ে করে যে যার মতো করে সংসার পেতেছেন। তাদের কেউই এখন আর বাবা-মায়ের কোনো খোঁজ নেয় না। তাই বৃদ্ধ স্ত্রীকে নিয়ে সংসার চালাতে হয় আলমগীর বেপারীকে।

আলমগীর বেপারী বলেন, ‘১৯৮২ সালে মাদারীপুর পুরান বাজার পরান দাসের তেলে মিলে কাজ করতেন। অসতর্কতা বসত মেশিনের মধ্যে হাত ঢুকে যায়। এতে কেটে যায় একটি হাত। তবুও জীবন থেমে থাকেনি। ধরতে হয়েছে সংসারের হাল। ইজিবাইক চালানো অনেক ঝুঁকিপূর্ন এটা জানার পরও সংসারের কারণে এক হাত দিয়েই ইজিবাইক চালাতে হয়। এক হাত দিয়ে ইজিবাইক চালানো দেখে অনেক সময় যাত্রীরা আমার গাড়িতে উঠতে চান না।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘সংসারের ঘানি টানতে টানতে এখন আমি পুরোপুরি ক্লান্ত। কিন্তু কিছুই করার নেই। সংসারে তিন-চারটি মুখের খাবার আমাকেই প্রতিদিন জোগাড় করতে হয়। এক হাত দিয়ে ইজিবাইক চালাতে আর পারছি না, খুব কষ্ট হয়। তবুও চালাতে হয়। একা একা কান্না করি। কিন্তু এ কান্না দেখার কেউ নেই। সরকার ও বিত্তবান লোকের কাছে দাবি জানাই তারা যেন আমাকে একটি দোকান বা স্থায়ী কাজের ব্যবস্থা করে দেন। তাহলে আমি এই বৃদ্ধ বয়সে আমার পরিবার পরিজনকে নিয়ে দুমুঠো খেয়ে বাঁচতে পারবো। এতে কিছুটা হলেও আমার কষ্ট কমবে।’

পঙ্গু আলমগীর বেপারীর স্ত্রী জাহেদা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার স্বামীর হাত চলে যাওয়ার কারণে তিনি রিকশা, ইজিবাইক ও ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। এখন বয়স বাড়ায় তিনি এসব কাজ ঠিকমতো করতে পারেন না। আমাদের খাবার ব্যবস্থা করতে অনেক কষ্ট হয় উনার। সরকার যদি আমাদের একটা ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে উপকার হতো।’

অপর ইজিবাইক চালক রশিদ হাওলাদার বলেন, ‘আমরা দুহাত দিয়ে ইজিবাইক চালালেও গাড়িটি কন্ট্রোল করতে অনেক কষ্ট হয়। আর আলমগীর ভাই কিভাবে এক হাত দিয়ে ইজিবাইক চালায় তা দেখে আমাদের অনেক খারাপ লাগে। সরকার ও বিত্তশালী লোকজনের কাছে আমাদের দাবি তাকে একটি দোকান করে দেওয়া হোক। মানবিক কারণে হলেও তাকে যেন একটি দোকান করে দেওয়া হয়।’

মাদারীপুর পৌরসভার একটি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক কাজী ওবায়দুর রহমান বলেন, ‘জীবন বাঁচানোর তাগিদে প্রতিদিন ইজিবাইক চালায় আলমগীর বেপারীর। এক হাত দিয়ে ইজিবাইক চালাতে পারে না বলে তার গাড়িতে অনেকেই উঠতেও চায় না। সব মিলিয়ে দিনে আয় ২০০-২৫০ টাকা। এ সামান্য উপার্জন দিয়ে কোনো রকম সংসার চলে। কোনো কোনো দিন না খেয়েও থাকতে হয় তাদের। এত কষ্ট করার পরও তিনি ভিক্ষা করেন না। আজ পর্যন্ত কারো কাছে তাকে হাত পাততে দেখিনি। আত্মমর্যাদা নিয়েই বেঁচে থাকতে চান আলমগীর বেপারী। সরকার যদি তাকে স্থায়ী কাজের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে তিনি ঠিকমত জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন।’

‘প্রতিবেশী আশরাফ আলী বলেন, ‘আলমগীর বেপারী যেভাবে কাজ করেন এটা আসলে একটা জীবন মরণের খেলা। তিনি অনেক কষ্ট করে সংসার চালান। আমারা তাকে মাঝে মধ্যে সাহায্য সহযোগিতা করি। কিন্তু আমরা গরিব মানুষ কতক্ষণ তাকে সাহায্য সহযোগিতা করব। সরকার যদি তাকে স্থায়ী কাজের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে তিনি ঠিক মত বাঁচতে পারবেন।’ 

মাদারীপুর পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রেজাউল বেপারী বলেন, ‘ইজিবাইক চালক আলমগীর বেপারীকে আমাদের পৌরসভার থেকে সাহায্য সহযোগিতা করা হবে।’ 

মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাইনউদ্দীন বলেন, ‘উপজেলা পরিষদ থেকে আলমগীর বেপারীকে সাহায্য সহযোগিতা দেওয়া  হবে।’

মাসুদ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়