ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

ঝাড়ফুঁকে ক্যান্সারের চিকিৎসা, প্রতারণা বন্ধের দাবি স্থানীয়দের

বাগেরহাট প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:১৬, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২   আপডেট: ১৭:১৭, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২
ঝাড়ফুঁকে ক্যান্সারের চিকিৎসা, প্রতারণা বন্ধের দাবি স্থানীয়দের

রোগীকে চিকিৎসা দিচ্ছেন আব্দুল মুকিত

বাগেরহাটে নিম পাতার ঝাঁড়ফুক ও স্বপ্নে পাওয়া পরামর্শে ক্যান্সারসহ সব জটিল রোগের চিকিৎসা দিচ্ছেন কবিরাজ আব্দুল মুকিত। সপ্তাহের প্রতি শনি ও মঙ্গলবার রাতে চিকিৎসা পেতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েকশত মানুষ আসেন তার কাছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে চিকিৎসা নেন।

কয়েকজন মুকিতের চিকিৎসায় রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার দাবি করলেও চিকিৎসকরা বলছেন, এই চিকিৎসার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ওই কবিরাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কবিরাজ আব্দুল মুকিত (৫৫) বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার বলভদ্রপুর গ্রামের বাসিন্দা। এক মেয়ে ও স্ত্রী রয়েছে তার। বছর তিনেক আগে হার্ট এ্যাটাক হলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নেওয়ার পরে বছর খানেক আগে তিনি সুস্থ হন। গত ৮ মাস ধরে এলাকার লোকজনের ঝাঁড়ফুক দেওয়া শুরু করেন মুকিত। বর্তমানে ক্যান্সার, প্যারালাইসিস, পাইলস, স্ট্রোক, মাজাব্যথা, বাত-ব্যাথা, জন্ডিস, হাঁপানিসহ বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসা দেন তিনি। প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার রাতে তার বাড়ির অদূরে লক্ষ্মীকান্ত মন্ডলের বাড়িতে বসে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। তার চিকিৎসা নিতে দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসেন।

শনিবার (১০ সেপ্টেম্বর) রাতে কবিরাজের বাড়ি মোরেলগঞ্জ উপজেলার বলভদ্রপুর গ্রামে লক্ষ্মীকান্তের বাড়িতে গিয়ে শতাধিক নারী-পুরুষের ভিড় দেখা যায়। ছোট ঘরে থালার উপর মোমবাতি জ্বালানো। শরীরে ছোয়ায়ে সেই থালায় ৫ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত রাখছেন লোকজন। সেই ঘরের পরে আরেক ঘরে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে নিম পাতা দিয়ে রোগীদের ঝাঁড়ফুক ও পরামর্শ দিচ্ছেন কবিরাজ আব্দুল মুকিত। বেশিরভাগ রোগীকে পথ্য হিসেবে কালোজিরা, সরিষার তেল ও মধু খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। ভালো হলে জানাতে বলছেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পরে সেবা পেয়ে খুশি হয়ে বের হয়ে গন্তব্যে রওনা দিচ্ছেন রোগীরা।

চিকিৎসার প্রক্রিয়া সম্পর্কে কবিরাজ আব্দুল মুকিত বলেন, ‘‘আমি খুব অসুস্থ ছিলাম। প্রায় দুই যুগ আগে বিয়ে করলেও বাচ্চা হতো না আমার। দুই বছর আগে আল্লা আমাকে সন্তান দিয়েছেন। বছর খানেক আগে রাতে ঘুমের মধ্যে কেউ একজন এসে আমাকে বলেন— ‘তুই সুস্থ হয়ে যাবি। লাঠি ফেলে দে। তোর কাছে যারা আসবে তারাও সুস্থ হবে। তুই চিকিৎসা সেবা দেওয়া শুরু কর।’ তারপর থেকে আমি নিজেও সুস্থ হয়ে যাই। আর অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা দেওয়া শুরু করি। আল্লাহর রহমতে অনেকে সুস্থ হয়েছে।’’ ক্যান্সারের রোগীও সুস্থ হয়েছে বলে দাবি করেন মুকিত।

চিকিৎসা পদ্ধতি ও ফি সম্পর্কে মুকিত বলেন, ‘আমি কারও কাছ থেকে টাকা নেই না। যার যা ইচ্ছে, সামনে একটা থাল রাখা আছে, সেই থালায় রেখে যায়। এটা দিয়ে এই বাড়ির বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য ব্যয় বহন করা হয়। আমি কখনও এই টাকা ভোগ করি না।’

মুকিতের কাছে চিকিৎসা নিতে যাওয়া কচুয়া উপজেলার ভান্ডাকোলা গ্রামের ভ্যান চালক রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমার হাঁটু ফুলে উঠেছিল। অনেক চিকিৎসা করিয়েও যখন ভালো হয়নি, তখন এখানে আসি।’ তিনি দাবি করেন, ‘এখানে আসার পরে ভালো হয়েছি।’  

একই উপজেলার প্রতাপরু গ্রামের আব্দুল ওয়াদুদ মোল্লা বলেন, ‘শুনেছি এখানে সব রোগ ভালো হয়, তাই এসেছি। আল্লাহই ভালো জানেন কী হবে?’  

অঞ্জলী নারী নামের এক নারী দাবি করেন, ‘আমার এবং আমার মেয়ের শরীরে সমস্যা ছিল। এখানে এসে ভালো হয়েছি।’

তবে আব্দুল মুকিত কোনো চিকিৎসক নন, তিনি চিকিৎসার নামে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছেন বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বেশ কয়েকজন।

স্থানীয় জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘মুকিত নিজে অসুস্থ। তিনি নিজে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খান। আর তার কাছে শত শত লোক আসছে। এটা প্রতারণা ছাড়া কিছু না। দ্রুত এই ভন্ডামি বন্ধ না হলে মানুষ আরও প্রতারিত হবে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, এই চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র করে ৪০ সদস্যের কমিটি রয়েছে। এই কমিটিতে স্থানীয় ইউপি সদস্যসহ প্রভাবশালীরা রয়েছে। চিকিৎসা সেবা দিয়ে যে টাকা আয় হয়, সেই টাকা তারা ভাগ করে নেন। মুকিত তেমন কিছু পান না।

মোরেলগঞ্জ উপজেলার বনগ্রাম ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি স্বপন কুমার মুখার্জী বলেন, মুকিত ফকির যে চিকিৎসা দিচ্ছেন তা স্পষ্ট অপচিকিৎসা। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা কী, তিনি কি আইন মেনে চিকিৎসা দিচ্ছেন? এটা এক ধরনের প্রতারণা ছাড়া কিছুই না। প্রতিদিন কয়েকশত মানুষ এই লোকের কাছে প্রতারিত হচ্ছে। এই অপচিকিৎসা বন্ধের দাবি জানান তিনি।

বনগ্রাম ইউনিয়নের ৬নং (বলভদ্রপুর) ওয়ার্ড সদস্য প্রদীপ মজুমদার বলেন, ‘আমরা যতদূর জানি মুকিতের চিকিৎসায় লোকজন ভালো হয়। কীভাবে তিনি চিকিৎসা দেন, তা তিনিই জানেন। আমরা অন্যকিছু জানি না।’

বাগেরহাট সিভিল সার্জন ডা. জালাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এ ধরনের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। মুকিতের বিষয়টি আমাদের জানা নেই। খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

টুটুল/বকুল

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়