ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

দুর্গোৎসবের সূচনা রাজশাহীতে

শিরিন সুলতানা কেয়া, রাজশাহী সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ৫ অক্টোবর ২০২২  
দুর্গোৎসবের সূচনা রাজশাহীতে

শ্রী শ্রী গোবিন্দ ও দুর্গামাতা মন্দিরে ব্রোঞ্জ ধাতুতে তৈরি দুর্গাদেবী

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টির মধ্যেও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নাটোরের নলডাঙ্গা থেকে দেবী দুর্গার আরাধনায় রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার তাহেরপুরে এসেছেন রেবতী রাণী। শ্রী শ্রী গোবিন্দ ও দুর্গামাতা মন্দিরে ঢুকেই তিনি প্রণাম জানালেন দেবী দুর্গাকে।

এত দূর থেকে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে রেবতী রাণী বলেন, ‘এখান থেকেই প্রথম সার্বজনীন দূর্গাপূজার শুরু। তিন বছর ধরে এই মন্দিরে আসছি। তাছাড়া এখানে নতুন ঠাকুর বানানো হয়েছে। তাই এই মন্দিরের প্রতি আগ্রহ বেশি। তাই এই বৃষ্টির মধ্যেও এতদূর থেকে এলাম।’

শারদীয় দুর্গোৎসবের জন্য এখন ঢাকের বাদ্য, কাসর ঘণ্টা আর শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে রাজশাহীর প্রতিটি পূজা মণ্ডপ। দেবী দূর্গার আরাধনায় মত্ত সনাতন ধর্মালম্বীরা। সব মণ্ডপেই চলছে পূজা অর্চনা। এর মধ্যে রাজশাহী ও আশপাশের মানুষের কাছে তাহেরপুরের এই মণ্ডপ নিয়ে আগ্রহ একটু বেশিই। কারণ, রাজশাহী শহর থেকে ৪৮ কিলোমিটার দূরের তাহেরপুর থেকেই সার্বজনীন দুর্গোৎসবের প্রচলন শুরু বলে প্রচলিত আছে।

শ্রী শ্রী গোবিন্দ ও দুর্গামাতা মন্দিরে প্রবেশ করতেই দেখা গেল, নানা রকম আলোকসজ্জায় সাজানো হয়েছে ঐতিহাসিক এই মন্দিরটি। নানা বয়সী মানুষ বৃষ্টি উপেক্ষা করে মণ্ডপের ভেতরে প্রবেশ করছেন। মন্দিরে প্রবেশ করতেই একটি মাইলফলক চোখে পড়ল। সেখানে লেখা- এই মন্দির স্থাপিত ১৪৮০ খ্রিষ্টাব্দে। সে হিসেবে আজ থেকে ৫৪০ বছর আগে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। আবার অনেকের মতে ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে চালু হয় মন্দিরটি। সে হিসাবে এর বয়স ৪৪২ বছর। 

এই মন্দিরটিতে আগে মাটির প্রতিমায় পূজা হতো। কয়েকবছর আগে স্থানীয় সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক ব্রোঞ্জ ধাতু দিয়ে প্রতিমা বানিয়ে দিয়েছেন।

প্রচলিত আছে, অনেক আগে থেকে দূর্গাপূজার আয়োজন হলেও তা সার্বজনীন ছিল না। সবাই এ উৎসব করতেনও না। তাহেরপুরে সার্বজনীন দুর্গোৎসবের প্রথম আয়োজনটা করেন রাজা কংস নারায়াণ রায়। 

তাহিরপুর রাজবংশ বাংলাদেশের প্রাচীন রাজবংশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই রাজবংশের আদিপুরুষ ছিলেন মৌন ভট্ট। বংশের শেষ শাসক ছিলেন কংস নারায়ণ রায়। ষোড়শ শতকে রাজা কংস নারায়ণ রায় সাড়ে আট লাখ টাকা খরচ করে প্রথম দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। আর বলা হয়ে থাকে সম্রাট আকবরের শাসনামলে এই মন্দির স্থাপন করা হয়। সেবার তাহেরপুরে উৎসবটি হয়েছিল বারনই নদের পূর্ব তীরে রামরামা গ্রামের দুর্গামন্দিরে।

তবে কংস নারায়ণের পরবর্তী চতুর্থ পুরুষ লক্ষ্মী নারায়ণের সময় সম্রাট আওরঙ্গজেবের ছোট ভাই বাংলার সুবেদার শাহ সুজা বারনই নদের পূর্ব তীরে অবস্থিত রাজা কংসের প্রাসাদ ধ্বংস করে দিয়ে যান। পরে লক্ষ্মী নারায়ণ আওরঙ্গজেবের অনুকম্পায় নদীর পশ্চিম তীরে একটি পরগনা লাভ করেন। সেখানেই রাজবাড়ি নির্মাণ করে রাজত্ব করেন। ১৮৬২ সালে রাজা বীরেশ্বর রায়ের স্ত্রী রানী জয় সুন্দরী রাজবাড়ির সঙ্গে একটি দুর্গামন্দির নির্মাণ করেন। একপর্যায়ে রাজবাড়ির এই মন্দিরটি প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে যায়।  ১৯৬৭ সালে রাজবাড়িতে কলেজ করা হয়। রাজবাড়ির ভেতর থেকে মন্দিরে যাওয়ার ফটকটিও এক সময় বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে মন্দিরটি উদ্ধার হয়। মন্দিরের ভেতরে এখন তিন তলার একটি আশ্রম বানানোর প্রস্তুতি চলছে। এটিকে ঘিরেই এখন মূল আকর্ষণ।

মন্দিরের ভেতরেই বসে ছিলেন পরিচালনা কমিটির সভাপতি নিশিত কুমার সাহা। তিনি বলেন, ‘মন্দিরটি ইতিহাস নিয়ে একটা সংশয় তৈরি হয়েছে। মন্দিরে ঢুকতেই মাইলফলকে লেখা আছে স্থাপিত ১৪৮০ খ্রিষ্টাব্দ, ৮৮৭ বঙ্গাব্দ। এখানেই সর্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসবের শুরু বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু ষোড়শ শতক মানে ১০০ বছর পরে এর চালু করা হয়। সম্রাট আকবরের শাসনকালে ১৫৮০ এবং বাংলায় ৯৮৭ বঙ্গাব্দে পূজার চালু করেন রাজা কংস নারায়ণ। আমরা এখন ইতিহাস সংশোধন করার চেষ্টা করছি।’

তিনি বলেন, ‘রাজা কংস নারায়ণই প্রথম দুর্গাপুজার প্রচলন করেছেন তা না। হিন্দু পুরানে আগে থেকেই এর উল্লেখ আছে। কীতিবাস রামায়নেও পূজার কথা লেখা আছে। কিন্তু রাজা কংস নারায়ণ এই উপমহাদেশে প্রথম ব্যাপকভাবে এর আয়োজন করেন। সেই সময়ে প্রায় নয় লাখ টাকা ব্যয় করেন তিনি। তখন থেকে দুর্গোৎসব সার্বজনীন হয়। সে হিসেবে ধরে নেওয়া যায় যে তাহেরপুর এবং এই মন্দির একটি ঐতিহাসিক জায়গা।’

সাধারণ সম্পাদক চিরঞ্জিব রায় বললেন, ‘১৫৮০ বা তার দুই এক বছরের আগে পরে এই মন্দির নির্মাণ করা হয়। কারণ, সম্রাট আকবর মাত্র ১৩ বছর বয়সে ১৫৫৬ সালে সিংহাসনে আরোহন করেন। সেখানে ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে সার্বজনীয় যে দুর্গাপূজা সেটির প্রচলন রাজা কংস নারায়ণ রায় করেছেন। বারো ভুঁইয়াদের একজন ছিলেন রাজা কংস নারায়ণ।’

তিনি আরও বলেন, ‘সেই থেকেই এই মন্দিরে দুর্গাপূজা হয়ে আসছে। আগে রাজার আমলে বছরের দুটি করে পূজা হতো। রাজারা কলকাতায় অস্থায়ী বসবাস করার সময়েও কর্মচারী দিয়ে পূজা পরিচালনা করতেন। এরপর বছরের একটি পূজা শুরু হয়। ১৯৬৫ সালের পর এই মন্দির পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৩ সালে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আবার পূজা শুরু করি। দীর্ঘদিন ধরে এই মন্দিরটি কলেজের দখলে ছিল। মন্দিরের নামে নিজস্ব কোনো জমি নেই। এই মন্দিরের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে, তাই এর আশেপাশের জায়গা দখলমুক্ত হওয়া উচিত। তাই মনে করি মন্দিরকে বাঁচাতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।’

ঐতিহাসিক এই মন্দিরটি দেখতে এসেছিলেন সজল কুমার শীল। তিনি বলেন, ‘আমরা বন্ধুরা বাঘা থেকে প্রথমবার এই মন্দিরে এসেছি। এখান থেকেই রাজা কংস নারায়ণ দুর্গাপূজার শুরু করেন। এই মন্দিরের ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা শুনেই আগ্রহী হয়ে এখানে এসেছি।’

মন্দিরের ভেতরে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন পুরোহিত গোপাল চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘গত ১৬ বছর ধরে মন্দিরের পুরোহিত হিসেবে আছি। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে মা দুর্গার ভক্তরা এখানে আসেন। প্রতিবছর পূজার সময় অনেক ভিড় হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।’

মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়