ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

চোর সন্দেহে দিনমজুরকে নির্যাতন

বাগেরহাট প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২৭, ১৫ মার্চ ২০২৩   আপডেট: ১০:৩৩, ১৫ মার্চ ২০২৩
চোর সন্দেহে দিনমজুরকে নির্যাতন

বাগেরহাটের মোল্লাহাটে এক দিনমজুরকে চোর সন্দেহে বেঁধে রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে স্থানীয়রা বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনার তিন দিন পেরিয়ে গেলেও নির্যাতনে জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

এদিকে, ঘটনার দুটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। এতে সমালোচনা শুরু হয়েছে।

এর আগে, গত শনিবার মোল্লাহাট উপজেলার গাংনী ইউনিয়নের ঘোষগাতি বাজারে ঘটনাটি ঘটে।

নির্যাতনের শিকার দিনমজুরের নাম শেখ মনিরুজ্জামান (৪২)। আহত অবস্থায় মোল্লাহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে তাকে। তিনি উপজেলার পূর্ব দারিয়ালা গ্রামের মৃত ইসলাম শেখের ছেলে। 

মনিরুজ্জামান ভূমিহীন হওয়ায় গাংনী মাতারচর আশ্রয়ণ প্রকল্পে সরকারের দেওয়া একটি বাড়িতে থাকেন।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, ভ্যান থেকে নামিয়ে আনা হচ্ছে মনিরুজ্জামানকে। এসময় এক ব্যক্তি তাকে ছাগল চোর আখ্যা দিয়ে একটি গামছা দিয়ে দুই হাত বাঁধছেন। এর মধ্যেই আরও কয়েকজন এসে লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করেন তাকে। মনিরুজ্জামান বারবার নিজেকে নির্দোশ দাবি করে কাঁদতে থাকলেও অভিযুক্তরা তাকে মারতে থাকেন। পরে কয়েকজন এসে তার পাও বেঁধে দেয়। 

অপর একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, আরও নির্মমভাবে আঘাত করা হচ্ছে মনিরুজ্জামানকে। বাঁধা অবস্থায় হাত, পা ও পিঠে আঘাত করতে করতে একজন হাপিয়ে গেলে আরেকজন এসে মারছেন তাকে। এক পর্যায়ে অচেতন হয়ে গেলেও মনিরুজ্জামানকে মারতে থাকনে অভিযুক্তরা। যারা মারছিলেন পাশে থাকা ব্যক্তিরা তাদের উপুর করে, সোজা করে, পায়ে, তালুতে মার বলে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন বলেও ভিডিওতে শোনা যায়। জ্ঞান ফিরলে কয়েকজন জড় হয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। তখন ছাগল চুরির পাশাপাশি এলাকায় গরুর চুরির ঘটনায়ও তাকে অভিযুক্ত করতে শোনা যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত শনিবার মনিরুজ্জামানকে নিয়ে স্থানীয় মাতারচর এলাকার জনৈক জাহিদ তার অসুস্থ ছাগল নিয়ে চিকিৎসার জন্য উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে যান। সেখানে অসুস্থ ছাগলকে চিকিৎসা করিয়ে ভ্যান করে বাড়ি ফেরার পথে ঘোষগাতী গ্রামের কয়েকজন তাদের চোর সন্দেহে গতিরোধ করেন।

আহত শেখ মনিরুজ্জামান বলেন, ‘একটা ছাগলের বাচ্চা নিয়ে আমি আর আমার এক চাচা জাহিদ মোল্লাহাট পশু হাসপাতালে যাই। সেখান থেকে ফিরে যাওয়ার সময় ছাগলের মালিক জাহিদ চাচাকে রানিং (ভ্যান চলন্ত) অবস্থায় কে বা কারা লাঠি দিয়ে একটা আঘাত করে। ওই বাজারের ওখানে কয়েকজন আগে থেকে দাঁড়ানো ছিলেন। পরে আরও লোক হয়। আঘাত পেয়ে সে (জাহিদ) দৌঁড় দেয়। তখন তারা বলে সে চুরি করে নিয়ে পলাচ্ছে। পরে লোকজন জড়ো হলে আমারে মারধর করে। আমি কাজ করি। আমাকে মিথ্যা চুরির অভিযোগ দিয়ে প্রচুর মারিছে। মারতি মারতি অনেকগুলো লাঠি ভাঙিছে আমার গায়। আমি জ্ঞান হারায় ফেলে ছিলাম। সেখানে লোক ছিল প্রচুর, প্রায় ৪০-৫০ জন। কিন্তু মারছে তিন চারজনে। সবাইরে চিনি না। একজন ছিল ওয়ার্কশপে কাজ করে। তার নাম মাহামুদ।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি বারেবারে হাতে পায়ে ধরে বলছি, আমারে মারার আগে একটু যাচাই করে নেও। আমি চোর না, কেই কোন কথাই শুনি নি। আমি শুধু শুধু মারছে।’

সেদিন ওই বাজারে মনিরুজ্জামানকে মারধরে ঘটনায় জড়িত কারো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। 

স্থানীয় দুই যুবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এলাকায় গরু চুরি বেড়েছে। এ বিষয়ে থানা পুলিশে অভিযোগ করেও কোনো সুরাহা হয়নি। তাই মানুষ আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। 

মনিরুজ্জামানের মা করিমন নেছা বলেন, ‘আমরা খুব গরিব। কিন্তু কখনো এমন অভিযোগ কেউ দিতে পারবে না। এই ভাবে মানুষ মানুষকে মারে। এর কী কোন বিচার পাবো?’

মোল্লাহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. নাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘গণপিটুনির শিকার এক ব্যক্তিকে গত শনিবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার শরীর জুড়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল। তবে কোথাও ক্ষত নেই। সবই ব্লাংক হুইপেনের (লাঠিজাতীয় কিছু) আঘাত। উন্নত চিকিৎসার জন্য গতকাল মঙ্গলবার তাকে গোপালগঞ্জ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়েছে।’

মোল্লাহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোমেন দাস বলেন, ‘ঘটনা জানার পর উভয় পক্ষকে থানায় ডাকা হয়। তাদের দাবি, ভুল বুঝাবুঝির কারণে এমনটি ঘটেছে। ভুক্তভোগীর পরিবার মামলা চালানোর আর্থিক সামর্থ্য নেই বলে জানিয়েছে। তারা কোনো অভিযোগ নেই মর্মে লিখিত দিয়েছেন। বিষয়টি মিমাংসা হয়ে গেছে।

তবে, স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, ২০ হাজার টাকা দেওয়ার আশ্বাস এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে পরিবারটিকে মামলা করা থেকে বিরত রাখা হয়েছে।

টুটুল/ মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়