২ কোটি টাকা আত্মসাতে অভিযুক্ত শিক্ষক জেলায় শ্রেষ্ঠ, জনমনে ক্ষোভ
তারেকুর রহমান, কক্সবাজার || রাইজিংবিডি.কম
![২ কোটি টাকা আত্মসাতে অভিযুক্ত শিক্ষক জেলায় শ্রেষ্ঠ, জনমনে ক্ষোভ ২ কোটি টাকা আত্মসাতে অভিযুক্ত শিক্ষক জেলায় শ্রেষ্ঠ, জনমনে ক্ষোভ](https://cdn.risingbd.com/media/imgAll/2023May/jannat-2305260632.jpg)
খুরশীদুল জান্নাত। ছবি: সংগৃহীত
কক্সবাজারে ঈদগাঁওয়ের প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ ঈদগাহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের বিভিন্ন খাত থেকে পৌনে ২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠা প্রধান শিক্ষক খুরশীদুল জান্নাতই কক্সবাজার উপজেলা ও জেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
এদিকে এ বিষয়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠার পরও জেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসাবে নির্বাচিত হওয়া খুরশীদুল জান্নাতের ব্যাপারে মুখ খুললেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নাছির উদ্দিন। অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে সেই শিক্ষকের উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার নীতিমালাও ব্যাখ্যা করেন তিনি।
সদ্য ঘোষিত জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ-২০২৩ এ ঈদগাহ উপজেলা এবং কক্সবাজার জেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন ঈদগাহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খুরশীদুল জান্নাত। তার বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ের প্রায় পৌনে ২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের তদন্ত চলমান রয়েছে। খুরশীদুল জান্নাতের বিরুদ্ধে ওই বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির চার সদস্য ঈদগাহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছৈয়দ আলম, শহিদ উল্লাহ মিয়াজী, এসএম সরওয়ার কামাল ও রমজান আলী লিখিতভাবে শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা উপমন্ত্রী, দুর্নীতি দমন কমিশন, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক, জেলা শিক্ষা অফিসার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারসহ বিভিন্ন দপ্তরে বিদ্যালয়ের পৌনে দুই কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ দিয়েছেন।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে খুরশীদুল জান্নাত বিদ্যালয়ের প্রায় এক কোটি আটাত্তর লাখ সত্তর হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রফিডেন্ড ফান্ড থেকে ২৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, প্রশংসাপত্র, বোর্ড সার্টিফিকেট ও প্রত্যয়নপত্র খাত থেকে ২৫ লাখ টাকা, বিদ্যালয় মার্কেটের ৩৩টি দোকান বরাদ্দে সালামির অতিরিক্ত বিনা রশিদে ৩৩ লাখ টাকা, বিগত পাঁচ বছরে উন্নয়ন কমিটিবিহীন এবং বিনা টেন্ডারে উন্নয়নের নামে ৩০ লাখ টাকা, ২০২২ সালে বিধিবহির্ভূতভাবে বিনা রশিদে পুনঃভর্তি ফি তিন লাখ টাকা, বিনা রশিদে তিন বছর একটি দোকানের ভাড়া এক লাখ ৮০ হাজার টাকা, ২০২২ ও ২০২৩ সালের ভর্তি ফরম বাবদ দুই লাখ টাকা, ২০২২ সালে শুদ্ধ উচ্চারণ প্রশিক্ষণ থেকে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা, ২০২২ সালে জেএসসি এবং এসএসসি রেজিস্ট্রেশনে অতিরিক্ত নেওয়া দুই লাখ টাকা, ২০২৩ সালের ১৫০ জন এসএসসি পরীক্ষার্থী থেকে জামানত হিসেবে নেওয়া পাঁচ লাখ টাকা, ২০২৩ সালের এসএসসি ফরম পূরণে অতিরিক্ত নেওয়া এক লাখ টাকা এবং ২০২৩ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জোরপূর্বক এনে হোস্টেল বাণিজ্য থেকে এক লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
এছাড়া বিদ্যালয়ে সংযুক্ত উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর বিনা রশিদে নেওয়া সহায়তা ফি দুই লাখ টাকা, শিক্ষার্থীদের জুতা ও টেইলার্স সিলেকশন বাবদ উৎকোচ গ্রহণ ৫০ হাজার টাকা, বই রাখার শোকেস কেনার জন্য ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের দেওয়া উপহারের ৪০ হাজার টাকা, ২০১০ সাল থেকে শিক্ষক কল্যাণ তহবিলের তিন লাখ টাকা, এসএসসি ব্যবহারিকের সময় বিধিবহির্ভূতভাবে নেওয়া এক লাখ টাকা, গোপনে সহকারী গ্রন্থাগারিক, ল্যাব সহকারী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগে উৎকোচ নেওয়া চার লাখ টাকা, এনটিআরসিএ কর্তৃক নিয়োগকৃত শিক্ষকদের ফাইল প্রসেসিংয়ের নামে আটজন শিক্ষক থেকে নেওয়া চার লাখ টাকা, ২০১৫ সাল থেকে শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ড, প্রবেশপত্র খাত থেকে ১০ লাখ টাকা, বিদ্যালয় মার্কেটের একটি অংশের দ্বিতীয় তলা বিনা টেন্ডারে নির্মাণ ও সালামি থেকে ২৫ লাখ টাকাসহ প্রায় দুই কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক খুরশীদুল জন্নাত বলেন, ‘গেল ৫ এপ্রিল তৎকালীন তদন্ত কমিটির সদস্যরা স্কুল পরিদর্শন করে আমাকে এবং অভিযোগকারীদের ডেকেছিলেন। অভিযোগকারীরা কিছু পেপার কাটিং ছাড়া কিছুই দেখাতে পারেননি। পরে তদন্ত কর্মকর্তা বদলি হন। নতুন যিনি এসেছেন তিনি ট্রেনিংয়ে রয়েছেন। ট্রেনিং শেষ হলে হয়তো তদন্ত কার্যক্রম শুরু করবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি এসব আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছুই না। তারা অভিযোগে আমাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছে। সেখান থেকে বুঝা যায় আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য এসব ষড়যন্ত্র এসব করছে তারা।’
এদিকে আত্মসাতের অভিযোগ ও উপজেলা-জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি আলাদাভাবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নাছির উদ্দিন বলেন, ‘খুরশীদুল জান্নাত নামের প্রধান শিক্ষককের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি নিয়ে অবগত আছি। যেহেতু জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচনের সময় তার বিরুদ্ধে অভিযোগের দোষ ও নির্দোষ কিছুই প্রমাণ পায়নি তাই তাকে এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অভিযোগ ও শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচন দুটি ভিন্ন বিষয়। এর আগে ওই শিক্ষক উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছেন।’
মো. নাছির উদ্দিন আরও বলেন, ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত করার জন্য উপজেলা থেকে শিক্ষকদের ভালো রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে নীতিমালা অনুসরণের মাধ্যমে শিক্ষকের ফাইল জেলা পর্যায়ে আসে। সেখান থেকে যাচাই-বাছাই করে শ্রেষ্ঠ নির্বাচিত করা হয়। জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহের প্রক্রিয়া তাদের নীতিমালা অনুসারে চলে। তদন্তাধীন অভিযোগের সঙ্গে শিক্ষাক্রম নীতিমালা সম্পূর্ণ আলাদা একটি প্রক্রিয়া। তবে ওই শিক্ষকের বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে তদন্তে ইতোমধ্যে উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে উপজেলা প্রশাসন।’
অভিযোগ সত্য তথা দুর্নীতি প্রমাণিত হলে সেই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা বা স্বীকৃতি বাতিল হবে কিনা বিষয়টি জানতে চাইলে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নাছির উদ্দিন বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ নির্ভর করবে শিক্ষা অধিদফতরের উপর। দুর্নীতি প্রমাণিত হলে সেই শিক্ষকের ব্যাপারে বিধি মোতাবেক সিদ্ধান্ত নিবে সংশ্লিষ্ট দফতর।’
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাকারিয়া বলেন, ‘ঈদগাহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককের বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু এর মধ্যে উপজেলা শিক্ষা অফিসার বদলি হয়ে গেছেন। নতুন যিনি যোগদান করেছেন তাকে এ বিষয়ে দ্রুত তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
/এসবি/
আরো পড়ুন