ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৮ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

দখলে-দূষণে মরছে তুরাগ, হুমকিতে জীবন-জীবিকা

রেজাউল করিম, গাজীপুর  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:৪৫, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩   আপডেট: ২১:৫২, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩
দখলে-দূষণে মরছে তুরাগ, হুমকিতে জীবন-জীবিকা

আবহমানকাল থেকে নদীর সঙ্গে আমাদের অস্তিত্বের সুখ-দুঃখ, জীবন-জীবিকা নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। তেমনি একটি নদী তুরাগ। যা গাজীপুরের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমানে সেই নদী মরতে বসেছে শিল্পকারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে, দূষণ ও প্রভাবশালীদের দখলে। তুরাগ নদীর মতো গাজীপুরের অন্য নদী, খাল-বিল হুমকির মুখে।

সরেজমিন দেখা গেছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কোনাবাড়ী, বিসিক, কড্ডা, বাইমাইল, সদর উপজেলার মনিপুর, টঙ্গীর বিসিকসহ বিভিন্ন এলাকার শিল্পকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে তুরাগ নদীতে। তুরাগ ছাড়াও শীতলক্ষ্যা, বানার নদী ও চিলাই, মখস বিলের অবস্থা ভয়াবহ। এসব নদীর পানি কালো বর্ণ ধারণ করেছে। দখল ও দূষণের ফলে সংকীর্ণ হয়েছে নদী, হারিয়েছে প্রবাহের গতি।

আরো পড়ুন:

এক সময় এসব নদী ও বিলে পাওয়া যেত অসংখ্য দেশি প্রজাতির মাছ। এ সব মাছের সঙ্গে জড়িত ছিল হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা। এ সব নদী ও বিলের পানি রান্নার কাজ ছাড়াও মানুষ কৃষি কাজে, কাপড় ধোয়া, গোসল করাসহ প্রায় সব কাজে ব্যবহার করতো। ওই সময় নদীর ছিল স্বচ্ছ পানি ঢেউ। বর্তমানে গাজীপুরে গড়ে উঠা বিভিন্ন শিল্পকারখানার দূষিত তরল বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে তুরাগ নদীতে।

বিভিন্ন কারখানার তরল বর্জ্য অপরিশোধিতভাবে নির্গত হওয়ায় দূষণের কবলে এখানকার নদী। দূষণের কারণে মাছসহ জলজ প্রাণীও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। পানি স্পর্শ করলেই চর্মরোগসহ নানা ধরনের রোগে ভোগেন স্থানীয়রা। নদী তীরবর্তী যেসব শিল্পকারখানা হচ্ছে, সেগুলো অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে। এসব কারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ায় পানি দূষিত হচ্ছে। তিন-চারটি রঙয়ের পানি প্রতিনিয়ত মিশছে নদীতে।

মহানগরীর কড্ডা এলাকার বাসিন্দা শাহেদ হোসেন বলেন, এক সময় নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত৷ এখন বর্ষাতেও তেমন মাছ পাওয়া যায় না। পানির রং পরিবর্তন হয়ে গেছে। মাছ পাওয়া গেলেও সেই স্বাদ পাওয়া যায় না। বিভিন্ন শিল্পকারখানার কালো পানি সরাসরি যুক্ত হয়েছে তুরাগ নদীতে।
টঙ্গীর আরিচপুর, মাছিমপুর, টঙ্গী বাজার, কামার পাড়া রোড়, কাকিল সাতাইশ, রুস্তুমপুর, কাশিমপুর ও মির্জাপুর বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান নদী দখল করে স্থায়ী অস্থায়ী স্থাপনা গড়ে তুলেছে। তাদের অধিকাংশ মালিক প্রভাবশালী ও স্থানীয় রাজনৈতিক শক্তিধর।

গত বছর ২৬ অক্টোবর গাজীপুর জেলার নদী দখল, দূষণ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া এবং বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনার দাবিতে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেন বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল গাজীপুর কমিটি। ৭ নভেম্বর ‘পরিবেশ দূষণে বিপর্যস্ত গাজীপুর: উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গনশুনানির আয়োজন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা)।

গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বেশ কিছু কারখানা রয়েছে যেগুলোর ইটিপি থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু তাদের ইটিপি নেই। এসব কারখানায় মাঝেমধ্যে অভিযান চালালো হয়। কিছু কারখানায় ইটিপি আছে, কিন্তু খরচ বাঁচাতে তা ব্যবহার করা হচ্ছে না। এসব কারখানা তাদের দূষিত পানি ইটিপির বাইরে বাইপাস করে সেই পানি নদী ও জলাশয়ে ফেলছে।

বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের এক পরিদর্শন শেষে তুরাগ নদী দূষণের ২২৪টি স্থান চিহ্নিত করে। যার মধ্যে শিল্প কারখানা বর্জ্য ৫৪টি, খাল-নালার ৪২টি, গৃহস্থালী ও অন্যান্য ১১৫টি, হাটবাজারের বর্জ্য ১৩টি।

বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, গাজীপুরের নদ-নদীগুলো ধারাবাহিকভাবে দূষিত হচ্ছে। দূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়ে চলছে। এক নদী আরেক নদীকে দূষিত করছে। শেষ পর্যন্ত সাগরেও এ দূষণ ছড়িয়ে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানিকেও দূষিত করছে। আর এ পানিতে লেড, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়ামের মাত্রা সহনীয় মাত্রা পার হয়ে যাচ্ছে। এতে মানবদেহ ও জলচর প্রাণীর উপর বিরুপ প্রভাব পড়ছে। ইদানিং এ অঞ্চলের মানুষের চর্মরোগ, ব্রঙকাইটিস ও শ্বাসকষ্ট জনিত রোগ বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কারখানায় ইটিপি স্থাপন ও নিযমিত চালনা নিশ্চিত করতে হবে। আর সিটি কর্পোরেশন, ইউনিয়ন পরিষদসহ যারা নাগরিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে যুক্ত, তাদের এসটিপি স্থাপন ও নিযমিত চালনা নিশ্চিত করতে হবে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন কঠোরভাবে প্রতিপালনে বাধ্য করতে হবে। দূষণ যারা করছে তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে গাজীপুর দূষণে সংকটাপন্ন হলে রাজধানী ঢাকাও বাঁচতে পারবে না। কারণ গাজীপুর হচ্ছে ঢাকার উজানের অঞ্চল। দূষণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দখলও বাড়ছে। বড় বড় দখল ছোট দখলকে উৎসাহিত করছে। সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে মানুষ ও জলজ প্রাণী। জলজ ও স্থলজ জীববৈচিত্র্য আজ বিপদের সম্মুখীন। দখল ও দূষণ থেকে তুরাগ নদীকে বাঁচাতে না পারলে এ জনপদের মানুষের সুস্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।
 

/বকুল/

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়